আনিসুর রহমান এরশাদ : ভেদাভেদে লিপ্ত হয়ে অনিষ্ট থেকে বাঁচা যায় না। ঝগড়া করে কষ্টকর পরিণতি এড়ানো যায় না। শয়তান প্রথমে গোপনে কুমন্ত্রণা দেয়। তারপর যখন মানুষের অন্তর কলুষিত হয়ে যায় তখন সে প্রকাশ্যে কু-মন্ত্রণা দিতে শুরু করে। এরপর যখন ঐ মানুষটিই অন্যদের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে তখন শয়তান চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। শয়তান তখন তাকেও নিজেরই দলভুক্ত মনে করে, সহযোগী-সহযুদ্ধা মনে করে এবং নিজে অন্য কাউকে প্ররোচিত করে অনিষ্ট করায় মনোনিবেশ করে।
মানুষ বোকা বলেই এত এত মৃত্যু দেখেও নিজের জীবনকে দীর্ঘস্থায়ী ভাবতে থাকে। অনেকের অনেকভাবে মৃত্যুও তাকে নিজের মৃত্যুর দিকে মনোযোগ ফেরাতে পারে না। ক্ষণস্থায়ী আশ্রয়কেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করে স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন করে। একটু ক্ষমতার নাগাল পেলেই অমুখাপেক্ষী মনে করেন। ফলে মূল্যবান সময় ও জীবনের বিনিময়ে কম দামি কিছু পেয়েও গভীর প্রশান্তি লাভ করেন।
আচরণে সীমালঙ্ঘনেই মর্যাদা কমে। অশান্তির কারণ না হওয়া উত্তম, বিদ্যমান অশান্তিকে শান্তিতে রুপান্তরিত করা অতি উত্তম। যেকোনো সৃষ্টিরই কল্যাণকর ব্যবহার হলে তা উত্তম আর ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে ব্যবহার হলে তা অধম। অসৎকাজ সম্পাদনকারীর কৃতকর্মের ফলাফল আর সৎকাজ সম্পাদনকারীর কৃতকর্মের ফলাফল ভিন্ন হবেই। যে সম্মান পাবার যোগ্য তাকে সম্মান করলে নিজেরও সম্মান বাড়ে আর যে সম্মান পাবার অযোগ্য তাকে সম্মান করলে নিজের সম্মান কমে।
অকৃতজ্ঞ মানুষ নিজের কাজ-কর্মের মাধ্যমেই প্রমাণ করে সে অকৃতজ্ঞ। কিন্তু মুখে কৃতজ্ঞ হবার ভান করে। আর কৃতজ্ঞ মানুষের কাজ-কর্মেই প্রমাণ হয় সে কৃতজ্ঞ; মুখে বলার প্রয়োজন হয় না। ধন-সম্পদের প্রতি খুবই আসক্ত ব্যক্তিও মুখে ধন-সম্পদের মোহমুক্ত থাকার কথা বলে বেড়ায় কিংবা অপরের সম্পদ লুণ্ঠন ও অন্যের প্রতি জুলুমকারীও মানবিকতার কথা বলে বেড়ায়। এই বলাটা মূলত নিজের নেতিবাচক ইমেজটাকে মুখোশে ঢেকে প্রকৃত রুপ আড়াল করার জন্যই। অন্তরে লুকানো সব প্রকাশ হলেও যিনি ভালো মানুষ বলেই পরিচিতজনদের কাছে বিবেচিত হবেন তিনি প্রকৃতই ভালো মানুষ।
সুখী জীবন-যাপনে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই বেশি মনোযোগী করে তোলে। অনিশ্চিত জ্ঞান মানুষকে নিশ্চিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। অতি কৌশলী ব্যক্তিও অধিক ক্ষমতাধরের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর দেয়া এড়াতে পারে না। যিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন, সমালোচনা করতে পারেন, সংশোধন করতে পারেন; তিনি অন্যের প্রশ্ন-সমালোচনা-সংশোধনী থেকে বেঁচে থাকতে পারেন বা সাবধান থাকতে পারেন।
একজনের দোষে যেমন আরেকজনকে শাস্তি দেয়া যায় না, একজনের ভালো কাজের জন্যও আরেকজনকে পুরস্কার দেয়া যায় না। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে চোর হলে সে চুরির শাস্তি পাবে, সম্মান-পুরস্কার তার প্রাপ্য নয়। আবার বাবা সুদী মহজন বা ঘুষখোর বলে ছেলের প্রতি বৈষম্য করা ছেলের প্রতি অবিচার। যার যার কৃতকর্মের ফল সেই ভোগ করবে; একজনের দায় আরেকজনের ওপর চাপানো অন্যায়।
দাদা সচিব হওয়াটা নাতির কেরানি হওয়ার যোগ্যতারও মাপকাঠি হতে পারে না। পূর্বপুরুষের ইতিহাস নয়, ব্যক্তির বর্তমান দেখাই যথেষ্ট। পূর্বপুরুষ হিন্দু ছিল বলে মুসলমান কাউকে যেমন ঘৃণা করা ঠিক না, পূর্বপুরুষ ভিন দেশি বলে জন্মগতভাবে বাংলাদেশিকে কেউ অবজ্ঞার চোখে দেখাও ঠিক না। কে কখন কোথায় জন্ম নেবে তা সে বা তার পিতা মাতা ঠিক করেনি; স্রষ্টা নির্ধারণ করেছে। ফলে জন্মের কারণে বৈষম্য করা স্রষ্টার নির্ধারিত বিষয়কে উপহাসেরই নামান্তর!
মানুষকে খুশি করার জন্য মানুষের যে পরিমাণ পেরেশানি, স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার ন্যূনতম পেরেশানিও দেখা যায় না। স্রষ্টার বিরুদ্ধে গিয়ে সৃষ্টি অন্যায়ে ঝুঁকলে স্রষ্টার কিছুই আসে যায় না, তা সৃষ্টির জন্যই আত্মঘাতী।
রূঢ় বাস্তব সত্যকে মানুষ জীবনে কখনো কখনো ঠিকই মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে তিক্ত ও কঠিন সত্যকে ভালোবাসার মতো আবেগ-অনুভূতি-ইচ্ছা খুব কম জনেরই থাকে। দুর্বল চিত্তের মানুষের ক্ষেত্রে- সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সংকোচ, সত্যের ওপর অটল-অবিচল থাকায় দ্বিধার জন্ম নেয়! আসলে সত্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য চারপাশে মিথ্যার নির্মমতাকে জানা-বুঝার প্রয়োজন হয়।
সত্যকে ভালোবাসার মতো সক্ষমতা অর্জনকারীরা দুঃখ–কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করতে পারেন, বেদনার আঘাতেও আরো শক্তি বাড়াতে পারেন, স্বপ্নভঙ্গেও আরো দৃঢ়তা-সাহস প্রদর্শন করতে পারেন, বঞ্চনাতেও ত্যাগের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করতে পারেন । কঠিন সাধনা ছাড়া সত্যকে সত্যিকারার্থেই সঠিকভাবে অনুভব করা যায় না । সত্যের স্বরূপ এমন যে- মায়াময় স্বপ্নকে উপেক্ষা, রূঢ় বন্ধুর পথে চলা, ঘাম ঝরানো ও রক্তাক্ত হওয়ায়ও সার্থকতা খোঁজা- সহজ হয়ে পড়ে।