আনিসুর রহমান এরশাদ
মানুষ বেশি কর্মমুখী হচ্ছে, ক্যারিয়ারমুখী হচ্ছে; ফলে পারিবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে। পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে অনেক নারী ও পুরুষ মানিয়ে নিতে না পেরে পারিবারিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ছে; যা সামাজিক বিশৃঙ্খলারও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পারিবারিক বিশৃঙ্খলার ফলাফলই হচ্ছে: পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি, বিবাহ বিচ্ছেদ, পারিবারিক কলহ, শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে বাধা, নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক অবনতি, সম্পদের অপব্যবহার ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি। পারিবারিক বিশৃঙ্খলার প্রভাব খুব মারাত্মক। এজন্য গণসচেতনতা, শিক্ষার হার বৃদ্ধি করতে হবে ও সবার মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে।
বন্ধন নষ্ট করে
মা-বাবার অবৈধ সন্তান থাকলে তা পরবর্তীত অনেক পরিবারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ও হানাহানি পর্যন্ত গড়ায়। বাবা-মা বা পরিবারের কোনো সদস্যের পলায়নে সমাজে পরিবারের সম্মান নষ্ট হয়। পরিবারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে- বিভিন্ন রকম যৌনব্যাধি, ঠিকমতো পরিচালনা করার ব্যর্থতা ও বহু বিবাহ। সুশিক্ষার অভাবে পরিবার বা পরিবারের গুরুত্বও ঠিকমত বুঝতে পারে না। ন্যায় অন্যায় নির্ধারণ করতে না পারায় সমাজেও অসঙ্গতি দেখা দেয়। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কুসংস্কার সমাজের ভালর কথাও বুঝতে পারে না। পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজ ও পরিবারের জন্য হুমকি স্বরূপ। ভারতীয় বিভিন্ন সিরিয়াল নাটক আমাদের পারিবারিক বন্ধন নষ্ট করছে ও পরিবার থেকে চিন্তা-ভাবনা দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
বিকাশের অন্তরায়
পারিবারিক বিশৃঙ্খলা সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়। তাই যেকোনো মূল্যে পারিবারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতেই হবে। পরিবারের মাধ্যমেই প্রতিটি ব্যক্তি তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে চায়। কিন্তু যদি কোনো কারণে পরিবারের সদস্যগণ তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয় তখন পরিবারের মধ্যে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পারিবারিক বন্ধনই পারে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া থেকে পরিবারগুলোকে বাঁচাতে। বিভিন্ন ধরণের পারিবারিক বিশৃঙ্খলা হচ্ছে- অবৈধ সন্তান, পলায়ন, যৌনব্যাধি, দাম্পত্য কলহ, বাল্য বিবাহ এবং বহু বিবাহ ইত্যাদি। পারিবারিক বিশৃঙ্খলার কারণ হচ্ছে- শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার, অপসংস্কৃতির সংমিশ্রণ, বিয়ে পূর্ব প্রেম, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, সামঞ্জস্যহীন বিয়ে, বিবাহে অনিচ্ছা, সন্তান নিতে অনাগ্রহী ইত্যাদি।
বাবা-মায়ের ঝগড়া
দুই বছর বয়স থেকে কিংবা তার আগে থেকে শিশুরা বাড়িতে তাদের বাবা-মায়ের আচরণের ওপর নজর রাখতে শুরু করে। বাবা-মায়ের ঝগড়ায় মেয়েদের বেলায় মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেশি আর ছেলেদের বেলায় আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। শিশুর আবেগ-অনুভূতি ও সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রেও তখন সমস্যা হতে পারে, বিষণ্নতায় ভূগতে পারে, খারাপ করতে পারে লেখাপড়ায়। সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সংগতিপূর্ণ ও সংযত আচরণ সন্তানের বেড়ে উঠাকে দারুণভাবে সাহায্য করে। ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’ মনে করে কড়া শাসন ঠিক না।
স্বামী-স্ত্রী কেন্দ্রিক সমস্যা
দুই পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানের ভিন্নতা, দুজনার আধ্যাত্মিক অবস্থানের ভিন্নতা, বয়সের বড়ো ব্যবধান, লেখাপড়ায় অসামঞ্জস্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, বোঝাপড়ার অভাব, যৌথ পরিবারে সমন্বয়হীনতা, অতিরিক্ত বর্হিমুখিতা, একে অপরের প্রতি অতি নির্ভরতা, বড়ো পরিবারে কাজের অসম বণ্টন, সামর্থ্যরে বাইরে আর্থিক খরচ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যৌতুকের জন্য চাপ সৃষ্টি, পরশ্রীকাতরতা, সবসময় অপ্রাপ্তির অভিযোগ, পারিবারিক সিদ্ধান্তের বাহিরে বিয়ে ও তা নিয়ে দুই পরিবারের মাঝে মনোমালিন্য, পর নর-নারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক, শারীরিক ও মানসিক পীড়ন, একে অপরের থেকে দীর্ঘ সময় দুরে অবস্থান, পরিবারের প্রধানকে মান্যতার ঘাটতি, সন্তান গ্রহণে সময়ক্ষেপণ ও মনোমালিন্য, একে অপরের আত্মীয়-স্বজনকে সহ্য করতে না পারা, কাজের লোকের প্রতি অতি নির্ভরশীলতা, স্ত্রীর আয়ের ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল, ছোটোখাটো সমস্যায় তৃতীয় পক্ষকে জড়ানো, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন ও স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ।
সন্তানকেন্দ্রিক সমস্যা
সন্তানকে সময় না দেওয়া, নিজের প্রত্যাশা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে বাবা-মায়ের মতের ভিন্নতা, নিয়মিত সন্তানকে সামনে রেখে ঝগড়া বিবাদে জড়ানো, সন্তানের অতি কাছের মানুষ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপনে ব্যর্থতা, অতিরিক্ত কড়া শাসন, সন্তানের মনস্তত্ব না বোঝা, লিঙ্গভেদে সন্তানদের মাঝে বৈষম্য, সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জেদের বসে সন্তানকে নির্মম শাস্তি দেওয়া, নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছার আগেই পড়াশোনার জন্য চাপ দেওয়া, নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া, সন্তানের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে অবজ্ঞা করা, স্বাভাবিক সময়ের পরে সন্তান হওয়া এবং একক সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠা।
পরিবারকেন্দ্রিক সমস্যা
মূল্যবোধ চর্চার ঘাটতি, পরনিন্দা বা পরচর্চা, মিথ্যার প্রশ্রয়, ধর্মী অনুশাসনে গাফলতি ও বাড়াবাড়ি, পারিবারিক পরিবেশ আকর্ষণীয় না হওয়া, পরিবারের সদস্যদের একে অপরের প্রতি বিরূপ আচরণ, বউ-শাশুড়ির মনোস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, ননদ-ভাবির মনোস্তাত্ত্বিক বিরোধ, বউ-শাশুড়ির বিরোধে স্ত্রী বা মায়ের যেকোনো একজনের প্রতি স্বামীর ভারসাম্যহীন ঝোক, বিবাহিত সন্তানকে বাবা-মায়ের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ও স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।