পরিবারে মূল্যবোধ চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। পারিবারিক মূল্যবোধগুলো এমন নৈতিকতা যা একটি পরিবারের বিশ্বাস, মনোভাব ও আদর্শকে গঠনে সহায়তা করে; পরিবার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সততা বা কঠোর পরিশ্রম বা দয়ার মতো নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানগুলোর উপর ভিত্তি করেই মূলত ‘নৈতিক’ সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রতিটি পরিবারের মধ্যে ভালো নৈতিকতাকে উৎসাহিত করা হলে তা আচরণ, সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া, সম্পর্ক এবং পারিবারিক ঐতিহ্য ও অভ্যাসকে প্রভাবিত করে। পরিবারের নৈতিক মূল্যবোধগুলোই পাবলিক আচরণ, কর্মনীতি এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করে ও প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দখল করে থাকে।
মূল্যবোধের সংজ্ঞা কি?
মোতাহার হোসেন চৌধুরী লিখেছেন- মূল্যবোধের লক্ষণ হলো ‘নিকটবর্তী স্থূল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ জানা এবং তাদের জন্য প্রতীক্ষা ও ক্ষতি স্বীকার করতে শেখা’ আর যুক্তিবিচার হলো ‘জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা। যুক্তিবিচার আর মূল্যবোধ-এই দু’টি কথা আমাদের জপ মন্ত্র হোক; তাহলেই আমরা বর্বরমুক্ত হয়ে সুন্দর ও সুসভ্য হতে পারব’। মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে দূরবর্তী সূক্ষ্ম সুখ আর সৌন্দর্যই প্রধান, নিজ স্বার্থ কোনো বিষয় নয়-অপরের কল্যাণই যেন বড়। এরা আইনকে অবজ্ঞা নয়, মেনে চলে যদিও সেটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রও হয়। আর মূল্যবোধহীন ধনীও মানুষ হিসেবে নিতান্তই গরিব।
পারিবারিক মূল্যবোধ
কিছু পারিবারিক মূল্যবোধ হচ্ছে- সামাজিক মূল্যবোধ, সম্মান ও ভদ্রতা, স্বেচ্ছাসেবী কাজ, অন্যদের প্রতি দয়া, অন্যদের পাশে দাঁড়ানো, যথাযথ শৃঙ্খলা, অন্যদের প্রতি উদার মনোভাব, ভাষা পছন্দনীয়, নাগরিক মূল্যবোধ, সুযোগ, স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত অধিকার, আইনের প্রতি সম্মান, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, শ্রেষ্ঠত্বের অঙ্গীকার, সৃজনশীলতা ও আকর্ষণীয় অভিব্যক্তি, অর্জনের মাধ্যমে সন্তুষ্টি, আর্থিক নিরাপত্তা বা স্থায়িত্ব, আয়-খরচের ভারসাম্য ও সঞ্চয়, উৎপাদনশীলতা, শিক্ষা ও জ্ঞান, ধর্মীয় মূল্যবোধ, স্রষ্টার প্রতি সম্মান, আদেশের আনুগত্য, প্রার্থনায় উপস্থিতি, অবৈধ যৌন সম্পর্ক পরিহার, পোশাক ও মার্জিত চেহারা, মানবিক মূল্যবোধ, বিশ্বাসযোগ্যতা, পরদুঃখকাতরতা, সততা, কৃতজ্ঞতাবোধ, ধৈর্য, অধ্যবসায়, ইতিবাচক মনোভাব ও পরিবারের সাথে কোয়ালিটি সময় কাটানো।
ন্যায়পরায়ণতা, সমতা, উদারতা, সমবেদনা, অন্যকে মানুষ হিসাবে সঠিক মূল্যায়ন ও প্রয়োজনে অসহায়ের জন্য সহায়ক হাত বাড়িয়ে দেয়াই ‘মূল্যবোধ’ বলে বিবেচিত। যা বিকাশ ও প্রকাশে সহায়তা করে, আচরণকে চালনা করে। গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে মূল্যায়ন করা, অন্যের সাথে মতবিরোধ হলে শান্তভাবে আলোচনা করে তার সামষ্টিক সমাধান বের করা, কষ্টকর হলেও সৎ কাজ করা আর সৎ পথে বলিষ্ঠ থাকা, প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করা, সর্বাবস্থায় সততার পন্থা অবলম্বন করা, অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ও সমাজ গঠনমূলক কাজে অংশ নেয়াকে সাধারণত পারিবারিক মূল্যবোধ বলা হয়।
স্বভাবের গভীরে প্রথিত
পারিবারিক মূল্যবোধ ব্যক্তির স্বভাবের গভীরে প্রথিত হতে পারে। পারিবারিক মূল্যবোধগুলো বাড়িতে চর্চিত হলে সেগুলো নির্ধারণ করে আপনি কে এবং কিভাবে কাজ করেন। নৈতিক মূল্যবোধগুলো যখন ইচ্ছাকৃতভাবে শেখানো এবং অনুসরণ করা হয় তা একসাথে পারিবারিক সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে। নৈতিকতা প্রায়শই বাড়িতে শেখা হয়। সমাজ বা দল থেকেও কিছু মূল্যবোধ শেযার হতে পারে, কিন্তু এটি মূলত অন্যদের পরিবারে চর্চিত মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। নৈতিক মূল্যবোধ ঘর থেকেই সঞ্চারিত হয়,তাই মূল্যবোধ শেখানো পিতামাতার জন্য বড় দায়িত্ব।
আচরণে প্রভাব
পরিবারে চর্চিত সুনির্দিষ্ট পারিবারিক মূল্যবোধ পরিবারকে সুখী ও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, ব্যক্তির আচরণকে প্রভাবিত করে এবং ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ গঠনে সরাসরি সাহায্য করে। পরিবার থেকে শেখা কোনটি সঠিক ও কোনটি ভুল সংক্রান্ত ধারণা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। প্রাথমিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও পরিবার থেকে শেখা নৈতিকতা বৃহত্তর জীবনে প্রবেশের পরও শক্তিশালী হতে পারে। মূল্যবোধ নৈতিক লক্ষ্যের কিছু বিবৃতি যা পরিবার থেকে শিখি। অনেক সময় পারিপাশির্^ক অবস্থার কারণে মূল্যবোধের সাথে আপস করলেও মূল্যবোধ কোন না কোনোভাবে ধরে রাখে।
সংহতি ও পরিচিতি নির্মাণ
মূল্যবোধগুলো বজায় রাখতে সহায়তা করে পরিবার। পরিবারের পরিচয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধগুলোই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এবং পরিবারকে শক্তিশালী রাখতে সহায়তা করে। পারিবারিক মূল্যবোধগুলোই আপনার সম্পর্কে অন্যদেরকে ধারণা দেয়। আপনি সম্মান করেন এমন পরিবারের মধ্যে কোন মূল্যবোধ রয়েছে? দৃঢ় নৈতিকতা এমনি এমনি হয় না। পরিবারই মূল্যবোধের সাথে জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে।
নারীদের গর্ভাশয় পরবর্তী প্রজন্মকে ধারণ করতে প্রস্তুত, তার স্তনযুগল প্রস্তুত যার পুষ্টিদানে, হৃদয়ের স্নেহ-মমতা প্রস্তুত যার মনের বিকাশ সাধনে, সেই সমাজের নারী আজ সন্তান কোলে ধারণ করতে আগ্রহী নয়। বেশি উপার্জন করা ও উন্নত ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তায় সন্তানের জন্ম, লালন-পালনকে বাধা ও ঝামেলাপূর্ণ মনে করাটা মূল্যবোধ পরিপন্থী। এতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কোমলতা ও প্রশান্তি নষ্ট হয়ে যায়।
সমাজকে দৃঢ় রাখা
পারিবারিক মূল্যবোধ সমাজকে দৃঢ় রাখতে সাহায্য করে। মূল্যবোধের চর্চাহীন পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ সহজেই হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সমাজের মানুষও তার কুফল ভোগ করে। যারা খারাপ তারা ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো বলে। যখন মানুষের ন্যূনতম নৈতিকতা বা মূল্যবোধ থাকে না তখন সে অন্যদের জন্য হয় বিপজ্জনক। খারাপ সবকিছু থেকে সমাজকে মুক্ত করতে চাইলে পরিবারগুলোকে মূল্যবোধ শিক্ষার একেকটি কেন্দ্র বানাতে হবে।
পারিবারিক স্থিতিশীলতাও যে কোনো বিচারেই গুরুত্বপূর্ণ। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পারিবারিক মূল্যবোধগুলো ছড়িয়ে পড়ে। নৈতিক মূল্যবোধগুলো মূলত গৃহেই শেখা হয় এবং সাধারণত পরিবারের বড় সদস্যের কাছ থেকে ছোটরা শিখে থাকে। বাবা-মা তাদের শিশুদের জন্য রোল মডেল; যারা সাধারণত মূল্যবোধ চালু করেন। যাদের কাছ থেকেই সন্তানরা নীতি-নৈতিকতার অনেক কিছু শিখেন এবং নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সার্থক পরিবার গঠন
সফল বিবাহ ও সার্থক পরিবার গঠনে একই ধরণের মূল্যবোধ থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মূল্যবোধগুলো এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে। নৈতিক মূল্যবোধ কারো কাছে অপরিহার্য হলে তার কাছে সেই আকর্ষণীয় বিবেচিত হবে যার একই মূল্যবোধ রয়েছে।
বিয়ের সিদ্ধান্তের আগেই নিজের মানসিকতা এবং নৈতিক প্রত্যাশা নিয়ে অন্যের সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বলুন। বিয়ের পর কিছু মূল্যবোধ একসাথে ঠিক করুন যা আপনার নতুন পরিবার পরিচালনায় নির্দেশনা দিবে। পারিবারিক জীবনকে অধিকারের কষাকষিতে না ফেলে স্বামী-স্ত্রীকে প্রীতি-ভালোবাসা, হৃদ্যতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবনযাপন করতে হবে। শিশুকালেই সন্তানদের পারিবারিক মূল্যবোধ বিষয়ে ধারণা দিতে হবে।
আত্মপরিচয় নির্মাণ
পারিবারিক নৈতিকতার উপর আপনার একটি প্রভাব সবসময় থাকতে পারে। পরিবারের সবার জন্য নৈতিকতার ব্যাপারে নির্দেশনা সুস্পষ্ট থাকতে হবে। কারো অস্পষ্টতা থাকলে আপনিই পরিবারের একটি ইতিবাচক শক্তি হতে পারেন, আপনার ক্রিয়াকলাপ আপনার নিকটতম লোকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এক্ষেত্রে সংবেদনশীল হতে হবে। মূল্যবোধ ব্যক্তির আত্মপরিচয় নির্মাণ করে, কারো মূল্যবোধ আক্রমণকে সে ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে করতে পারে। অন্যকে হঠাৎ ভিন্ন ও ব্যতিক্রমধর্মী মূল্যবোধে পরিবর্তনের চেষ্টার পরিবর্তে সাধারণ মূল্যবোধগুলোকে শক্তিশালীভাবে চর্চা করুন।
মূল্যবান আচরণ
কিভাবে একটি পরিবারে ভালো মূল্যবোধকে স্থাপন করবেন? আপনাকে আশাবাদী হতে হবে। কাছের মানুষেরা আপনার আচরণ মূল্যবান মনে করলে নিজেরাও তা বেছে নেবে। মানুষ ব্যবহারিক জীবন দেখেই মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা নিবে। নৈতিকতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে, তবে কাজে প্রমাণ করাই বেশি কার্যকরী। পারিবাকিভাবে নীতিবোধের চর্চা ও মূল্যবোধ গড়ে না উঠলে পারিবারিক সুখের বন্ধনগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ধর্ষণ, স্বজন হত্যা, মায়ের হাতে সন্তান খুন, সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন, পারিবারিক খুনাখুনি ও আত্মহননের ‘সংস্কৃতি’ বন্ধ করতে চাইলে পারিবারিক মূল্যবোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মূল্যবোধ চর্চা
নিজেকে মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তৈরি করুন। নিজের পরিবারকে কেমন দেখতে চান? মানুষ আপনাকে কেমন বলবে বলে আপনি আশা করেন। এখন থেকে ২২-২৩ বছর পর কী আশা করবেন, সন্তানরা কিভাবে বড় হয়ে উঠবে এবং তারা আপনার কাছ থেকে কী শিখবে? সত্যিকারের মূল্যবোধ চিহ্নিত করুন এবং যেগুলো পরিবারে ফোকাস করতে চান সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিন।
বিবাহিত হলে নিশ্চিত করুন যে দু’জনেই একই লক্ষ্যে কাজ করবেন। আপনি যদি মূল্যবোধগুলো স্পষ্ট করতে না পারেন তবে সন্তানের জন্য আপনার কাছে স্পষ্ট প্রত্যাশা থাকবে না। পরিবারের মূল্যবোধগুলো লিখুন এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করুন। কারণ মানবিকতা ও মনুষ্যত্ববোধহীন মানবাকৃতির প্রাণীরা আসলে মানুষ নয়।
১৮০৪ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। ১৯২৭ সালে তথা ১২৩ বছর পর হয় ২০০ কোটি, ৩৩ বছর পরে ১৯৬০ সালে হয় ৩০০ কোটি, ১৪ বছর পর ১৯৭৪ সালে হয় ৪০০ কোটি, ১৩ বছর পর ১৯৮৭ সালে হয় ৫০০ কোটি, ১২ বছর পর ১৯৯৯ সালে হয় ৬০০ কোটি, ১২ বছর পর ২০১১ সালে হয় ৭০০ কোটি। বর্তমানে ৭৭৬ কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০১ জন। পরিসংখ্যান বলে মানুষ বাড়ছে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- লোভের কারণে মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ কমছে।
পরিকল্পিত জীবন যাপন
বাবা-মায়েরা বাজে স্বভাব থাকলে পরিবর্তন করুন, সন্তানকে সাহসী ও মানবিক করে গড়ে তুলুন। যার যা কিছু পাওনা তা উত্তম আচরণের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়ার চর্চা বাড়ান। সৎ কাজে ব্যস্ত থাকুন, অনেক কিছুরই সুন্দর অর্থ খোঁজে পাবেন। অর্থের জন্য জীবনকে বিপদাপন্ন করা ঠিক নয়; জীবনের জন্য অর্থ, অর্থের জন্য জীবন নয়। পরিবারে থাকতে হবে- পরিতৃপ্ত মন তৈরির আয়োজন, সৎ-সুন্দর-কর্মময় জীবনের প্রণোদনা, লজ্জা-ভারসাম্য-দূরদর্শিতার আয়োজন। যৌবনকে নষ্ট করে, স্বাস্থ্যকে ক্ষয় করে, সচ্ছলতায় বিলাসিতা করে, সময়ের অপব্যবহার করে, অবসরকে হেলা-খেলায় নষ্ট করে- অর্থবহ জীবনের সন্ধান মিলবে না।