আনিসুর রহমান এরশাদ
করোনা অনেকের মুখোশকেই উন্মোচন করে দিয়েছে। ফাঁকা বুলি, হম্বিতম্বি, বাগাড়ম্বরের লাগাম টেনে ধরেছে। নানা ধরণের মানুষ আছে। অনেকে নিজের ব্যাপারে সচেতন, পরের ব্যাপারে উদাসীন; অনেকে নিজের ব্যাপারে সচেতন, পরের ব্যাপারেও সচেতন; অনেকে নিজের ব্যাপারে উদাসীন, পরের ব্যাপারেও উদাসীন; অনেকে নিজের ব্যাপারে অসচেতন, পরের ব্যাপারে সচেতন। এই দুর্দিনেও যারা নিজের লোভ ও ভোগকে সামলাতে পারছে না, তারা মানুষ নয়; দেখতে মানুষের মতো হলেও আসলে পশু। করোনায় অদৃশ্য কারাগারে যখন বন্দী মানবতা, ৮৮ হাজার ৫২৯ জন মারা গেছে; তখনও থেমে নেই দুর্নীতিবাজরা, মুনাফালোভীরা, ভোগবাদীরা।
চরম দুর্ভোগের মাঝেও স্বার্থপর ও লোভী মানুষদের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় জনসংখ্যা বাড়লেও মানুষ কমছে। যদিও হিসাবে বর্তমানে ৭৭৭ কোটি ৬৫ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ জন মানুষ আছে, তবে মানবিক মূল্যবোধহীন মানুষ প্রকৃত মানুষ নয়। ১৮০৪ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। ১৯২৭ সালে তথা ১২৩ বছর পর হয় ২০০ কোটি, ৩৩ বছর পরে ১৯৬০ সালে হয় ৩০০ কোটি, ১৪ বছর পর ১৯৭৪ সালে হয় ৪০০ কোটি, ১৩ বছর পর ১৯৮৭ সালে হয় ৫০০ কোটি, ১২ বছর পর ১৯৯৯ সালে হয় ৬০০ কোটি, ১২ বছর পর ২০১১ সালে হয় ৭০০ কোটি। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে ঠিকই তবে মানুষ বাড়ছে না।
জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ৭ কোটি ৮ লাখ মানুষ করোনায় খুবই ঝুঁকিতে আছেন। সংঘর্ষ, যুদ্ধ ও নিপীড়নের কারণে নিজের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫৯ লাখ। এদের মধ্যে ৬৭ লাখ সিরিয়ান, ২৭ লাখ আফগান, ২৩ লাখ দক্ষিণ সুদানের শরণার্থী; অর্থাৎ তিন দেশেরই মোট শরণার্থীর ৫৭ ভাগ। নিজ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন এবং আন্তর্জাতিক সুরক্ষা গ্রহণ করছেন, কিন্তু শরণার্থী মর্যাদা পাওয়ার আবেদনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন এমন আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা ৩৫ লাখ। নিজ দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এমন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা ৪ কোটি ১৩ লাখ। প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন করে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। রাষ্ট্রহীন মানুষের নেই জাতীয়তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কাজের সুযোগ ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার মতো মৌলিক অধিকার। কিছু লোভী মানুষের পাপের খেসারত দিচ্ছে অনেক নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষ।
যে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন করোনার ঝুঁকিতে তারাও আছেন! যুক্তরাষ্ট্রে ২১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯৮, চীনে ১৭ লাখ, ব্রাজিলে ৭ লাখ ৭৩ হাজার ১৫১, রাশিয়ায় ৮ লাখ ৭৪ হাজার ১৬১, ভারতে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪, থাইল্যান্ডে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৯০২, ইন্দোনেশিয়ায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৩৮৭, তুরস্কে ২ লাখ ৮৬ হাজার, ইরানে ২ লাখ ৪০ হাজার, মেক্সিকোতে ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৫০ ও ফিলিপাইনে ২ লাখ ১৫ হাজার ২৭৮, দক্ষিণ আফ্রিকা ১ লাখ ৬৪ হাজার ১২৯, ইউক্রেনে ১ লাখ ৬২ হাজার ৬০২, ভিয়েতনামে ১ লাখ ৩০ হাজার ২, কলম্বিয়া ১ লাখ ২২ হাজার ৮৫, ইথিওপিয়া ১ লাখ ১৩ হাজার ৭২৭, মিসর ১ লাখ ৬ হাজার, আর্জেন্টিনা ১ লাখ ৩ হাজার ২০৯, মিয়ানমার ৯২ হাজার, পেরু ৯১ হাজার ২৮৩, বাংলাদেশ ৮৮ হাজার ২১১, জাপানে ৭৯ হাজার ৫২, জার্মানিতে ৭৭ হাজার ১৬৬ জন, পোল্যান্ড ৮৯ হাজার ৫৪৬ জন, ইংল্যান্ড ৮৩ হাজার ১৮৯, পাকিস্তানে ৭৭ হাজার ২৭৫ জন বন্দি আছেন। সব বন্দিই যে অপরাধী (!) এমনটা নয়; রাজনৈতিক বন্দিরাও আছেন।
আসলে মানুষের জীবনের দাম মানুষই কমিয়েছে। সিরিয়ায় যুদ্ধে নিহত হয়েছে ৫ লাখের বেশি। ইয়েমেনে সামরিক আগ্রাসনে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছে, আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে ১ লাখেরও বেশি শুধু বেসামরিক নাগরিকই নিহত হয়েছে। ইরাক যুদ্ধে ৩৪ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। আরব ও ফিলিস্তিনি লাখ লাখ মুসলমানকে হতাহত করেছে ইসরাইল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে; শুধু আর্মেনিয়াতেই ৩৪ লাখ মানুষের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষকেই মেরে ফেলা হয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার স্ট্যালিন যুগে প্রায় ২ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৮ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। হলোকাস্ট গণহত্যায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। হিরোশিমা ও নাগাসাকি গণহত্যায় ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ মারা যায়। ন্যানকিং গণহত্যায় ৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, এক তলোয়ারে ১০০ মানুষকে জবাই করা হয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নামে প্রায় ২০ লাখ সাধারণ কম্বোডীয়কে হত্যা করেছিল খেমাররুজ সরকার। স্বাধীন ঘোষণার অপরাধে বসনীয় গণহত্যায় কমপক্ষে ১ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। রুয়ান্ডায় গণহত্যায় ১০০ দিনে তুতসি সম্প্রদায়ের ৮ লক্ষাধিক নারী-পুরুষ মারা যায় হুতু সম্প্রদায়ের হাতে। সুদানে দারফুর গণহত্যায় দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। চীনের গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবে ১৯৪৯-১৯৭৬ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ থেকে ৭০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। তাইপিং বিদ্রোহে ২ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়।
সূত্র: en.wikipedia.org/ www.worldometers.info/ www.unhcr.org/ www.statista.com/ www.prisonstudies.org