জীবন-জীবিকার গল্প : গৃহকর্মী
জরিনা বেগম। বয়স ৬০ বছর।
স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে না পেরে স্বামী-সংসার ছেড়ে ঢাকায় আসেন।
বিশ বছর ধরে ঢাকায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।
কেউ ডাকে খালা। কেউ ডাকে বুয়া। কেউ ডাকে আন্টি। কেউ ডাকে কাজের বুয়া! কেউ বলে গৃহকর্মী। কেউ বলে গৃহশ্রমিক।
এলাকা ছেড়ে সাভারে আসার কাহিনী খুব করুণ।
অভাবের সংসারে দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতে এক সময় ব্ল্যাক মার্কেটের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
ভারত থেকে কাপড় এনে দেশে বিক্রি করতেন।
অবৈধ ব্যবসা আরো বাড়াতে এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিল।
বড় এক চালানে ধরা খাওয়ার পর এনজিওর ঋণ ফেরৎ দিতে অসামর্থ্য হয়ে পড়েন।
ধরে নেয়ার জন্য বাড়িতে পুলিশ আসতো। এক কাপড়ে পালিয়ে সাভারে চলে আসেন।
গৃহকর্মী হিসেবে ঘরের সব কাজ করতে শুরু করেন। গৃহকর্মের তালিকা ছিল বেশ দীর্ঘ।
থালাবাসন মাজা। পোশাক-পরিচ্ছদ-কাপড় ধোয়া।
ঘর মোছা। গৃহ বা গৃহের আঙ্গিনা বা চত্বর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। বাজার করা।
বাচ্চা দেখাশোনা। রান্না করা। জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখা।
গৃহে বসবাসরত শিশু, অসুস্থ, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যত্ন নেয়া।
দিনকাল কেমন চলছে?
-একদিন ছুটি চাইলেই খেইপ্যা যায়। আমাগো শরীরেও অসুখ-বিসুখ হয়। সেইডা তারা বুঝতে চায় না।
দুই কাজ তিন কাজের কথা বইলা অনেকে অনেক বেশি কাজ করায়। অনেক বাড়িতে মাসের পনের তারিখ হইয়া গেলেও বেতন দেয় না।
ছুটি চাইলে কোনোদিন ছুটি দেয় না। সবার ছুটি আছে শুধু আমাগোই ছুটি নাই।
একদিন না গেলে বেটিদের মাথা গরম হইয়া যায়। আর ফোনের পর ফোন দিতে থাকে।
হামরা দিন আনি দিন খাই অবস্থা। কোনো জমানো টাকা নাই যে হামরা তাক ভাঙে ভাঙে খামো।
তাই কিছু কইতেও পারি না, সইতেও পারি না।
মনের দিক থেকে গরিব
মানুষ ধনী হলে বা শিক্ষিত হলেও অধীনস্থদের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে পারে না।
টাকাওয়ালার বাসাতেও ওয়ার্কিং স্টাফের জন্য কমদামি খাবার, আলাদা চাল, আলাদা রান্না হয়।
প্লেট-গ্লাসও আলাদা থেকে! এমনকি বসার জায়গাও আলাদা!
উচ্চশিক্ষিত ও ধনী পরিবারের মানুষও মনের দিক থেকে গরিব থাকতেও পারে।
পয়সাওয়ালা ও ক্ষমতাশালী মানুষও অমানুষ হতে পারে।
নাহলে কি সামান্য চুরি করে খাওয়ার দায়ে শিশু গৃহকর্মীকে পিটিয়ে মেরে ফেলে!
অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভবনের ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় গৃহকর্মীকে!
শিশু গৃহকর্মী ও শিশুশ্রম
অনেক কর্মজীবী মা–বাবারা শিশুর কাছে শিশুকে দেখভালসহ পরিবারের অন্যান্য কাজের দায়িত্ব দেন।
একটি বাচ্চা আরেকটি শিশুকে কোলে রাখছে। অথচ বাচ্চার সঙ্গে খেলার জন্য আনা হয়েছে শিশুটিকে।
তাছাড়া কাজ যদি একটু এদিক-ওদিক হলে নিপীড়ন করেন।
নিজে নির্যাতন করে থানায় গিয়ে শিশুটির নামে চুরি করা মিথ্যা অভিযোগও দেন।
অথচ তাদের দরকার হয়। তাদের ছাড়া জীবন অচল হয়ে পড়ে।
তাদের শ্রমের ওপর ভিত্তি করেই টিকে থাকে আরাম–আয়েশের বেসাতি।
গৃহকর্মীর শরীরে দগদগে ক্ষতচিহ্ন
নিম্নশ্রেণির মানুষ নিয়ে আপত্তি ও অপছন্দের শেষ নেই!
গৃহকর্মীর নাম সুন্দর হওয়ায় গৃহকর্মীর মা–বাবার রাখা নাম পাল্টে দেন নিয়োগকর্ত্রী।
নতুন নাম নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় মারধর করেন। মেয়েটি দেয়াল টপকে পালানোর চেষ্টা করেন।
যে বয়সে স্কুলে পড়ার কথা, ছোটাছুটি করে ঘর মাতিয়ে রাখার কথা; সে বয়সেই হয়েছে গৃহকর্মী।
জীবনের তাগাদায় খেয়েপরে বেঁচে থাকতে কচি শরীর শহরে ঠাঁই পেয়েছিল গৃহশ্রমিক হিসেবে।
অথচ শরীরে দগদগে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে।
গৃহকর্ত্রী কর্তৃক গৃহকর্মী নির্যাতন
কাজে একটু ভুল হলেই কথায় কথায় নির্যাতন চালানো। লোহার খুন্তি গরম করে ছেঁকা দেওয়া।
রাতে মারপিটের পর ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে ঘরের মেঝের ওপর ফেলে রাখা হতো।
মেয়ের শ্রমের বিনিময়ে পরিবারকে দেওয়ার কথা থাকলে টাকা না দেয়ার ঘটনা ঘটে।
শিশু গৃহকর্মীকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেন না।
গৃহকর্ত্রী কর্তৃক গৃহকর্মীকে বারান্দার কার্নিশে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটে।
হাড়-মাংস খুলে যায়! চামড়ায় ছেঁকা পড়ে! তবু খাবারের আশায় বেঁচে থাকে নিপীড়ন মেনে নিয়ে।
ভালো পরিবারে গৃহকর্মীও নিরাপদ
ভালো গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীরা গৃহকর্মীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন।
তাদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করেন। নির্যাতন করেন না।
শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। প্রয়োজনে ছুটি দেন।
প্রণোদনাসহ সুবিধাদি দেন। অসুস্থ সময়ে কাজ থেকে বিরত রাখেন এবং চিকিৎসার দায়িত্ব নেন।
ভালো পরিবারে গৃহকর্মী নিয়োগকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হন না।
শারীরিক আঘাত পায় না। মানসিক নির্যাতনের শিকার হন না।
কেউ অশ্লীল আচরণ করেন না। যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতন করেন না।
ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বাধ্য করেন না।
নির্ধারিত নেই কর্মঘণ্টা
বেশির ভাগ গৃহকর্মীর জন্য কোনো ধরনের কর্মঘণ্টা নির্ধারিত নেই।
পরিবারের সকলে ঘুম থেকে ওঠার আগে গৃহশ্রমিকদের উঠতে হয়।
সবাই ঘুমানোর পর ঘুমাতে যান গৃহকর্মীরা। আট ঘণ্টা কাজ করার নিয়মের বালাই নেই।
নেই কোনো ন্যূনতম বেতনকাঠামো।
দুটো খাবারের জন্য অন্যের বাসায় কাজ করা খুব কষ্টের অনুভূতি। এরপর যদি গর্হিত অপরাধও এত সহজ হয়!
গৃহকর্মীরাও মানুষ, দাস নয়
যখন শিক্ষিত-ভদ্র নারী মাংস চুরি করে খাওয়ায় কিশোরী গৃহকর্মীকে মারতে মারতে মেরেই ফেলেন।
তখন মনে হয় গৃহকর্মী মানে যেন দাস! অথচ গৃহ হওয়া উচিত আস্থার জায়গা।
পরে যখন এক লাখ টাকা দিয়ে মানুষ হত্যার শাস্তি থেকে পার পান তিনি। তখন বুঝা যায় মানুষের মূল্য কত কম!
তবে ছোট ছোট সন্তানরা গৃহকর্ত্রী মায়ের এই অপরাধ ক্ষমা করতে পারেনি।
তাদের কাজের ঠিক নেই, সুনির্দিষ্ট মজুরি ঠিক নেই। অনেকের কাজতো দিনমজুরের মতো।
সাপ্তাহিক ছুটি নেই। কোনো নিয়োগপত্র নেই। দরকষাকষির সুযোগ নেই। এরা অনিশ্চিত জীবন যাপন করে৷
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকে৷ মাঝে মাঝেই বেকার থাকে৷ অল্পবয়সী এমনও গৃহকর্মী আছেন- যারা পেটে-ভাতে কাজ করেন, কোনো মজুরি পান না।
যাদের কাজের নিশ্চয়তা নেই, নেই মজুরির কোনো নিশ্চয়তা৷
গৃহকর্মী বাড়ীর আলিশানসম বিভিন্ন রুম এবং বিছানা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন।
তিনি থাকেন বাড়ীর সবচেয়ে অবহেলা ও অযত্নে থাকা একটি বিছানায়।
তাতে একটি হোগলা, তেল চিটচিটে একটি বালিশ এবং কাঁথা।
অনেক সময় রান্না ঘর, বারান্দা, ড্রইং রুমে কিংবা ডাইনিং রুমের মেঝেতে থাকতে হয় তাকে।
খারাপ আচরণ ও নিপীড়ন
গৃহকর্মীর গায়ে হাত তোলা কখনো সভ্য আচরণ হতে পারে না।
পছন্দ না হলে বিদায় করে দিতে পারে। খারাপ আচরণ কখনো যৌক্তিক হতে পারে না।
বাড়িতে থাকা সাহায্যকারী মানুষটিকে পরিবারের সদস্য মনে করলে তিনিও নিজেকে সেভাবে তৈরি করবেন।
কেন নির্মম নির্যাতনের শিকার হবে? কেন নিপীড়নের ঘটনা একটার পর একটা ঘটেই চলবে?
সহিংসতা নির্যাতন বিচারহীনতা
দুঃখজনক ব্যাপার হলো- বাসায় থাকার পরও শারীরিক নির্যাতন। মানসিক নিপীড়ন। অত্যাচার।
অর্থনৈতিক নিষ্পেষন। যৌন সহিংসতা। ধর্ষণ। ধর্ষণের পর হত্যা। আত্মহত্যা।
গৃহকর্মী নির্যাতিতের সংবাদ যা আসছে, বাস্তবে এর চেয়েও বেশি নির্যাতিত হচ্ছে।
অধিকাংশ নির্যাতনের ঘটনার কোনো মামলা ও বিচার হয় না।
নিজেদের সময় থাকে না
গৃহশ্রমিকদের কোনো পরিচয়পত্র বা নিয়োগপত্র থাকে না।
বেতনের মাপকাঠি নেই। কাজের নির্দিষ্ট সময় নেই।
বাসাবাড়িতে যারা স্থায়ীভাবে কাজ করেন, তাদের নিজেদের সময় বলে কিছু থাকে না।
দরিদ্র অসহায় বঞ্চিত
যারা ছুটা বা অস্থায়ী কাজ করেন, তাদের সারাদিনে অন্তত ১০ থেকে ১৫টা কঠিন কাজ করতে হয়।
এরা দরিদ্রের মধ্যে আরো দরিদ্র। নিরক্ষর। অসহায়। সব অধিকার থেকেও বঞ্চিত।
তিন বেলা খাবারের জন্য কাজে এসে কপালে মারধর ও সহিংসতাও জোটে।
অথচ অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না।