জীবন-জীবিকার গল্প : ক্লিনার
নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী তোরাব।
দুবেলা খাবার জোগাড় করতে বেছে নিয়েছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ।
টিকে থাকার সংগ্রামে দীর্ঘ এক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে।
ভেবেছিলেন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আপাতত এ কাজ শুরু করি।
ভালো কোনো ব্যবস্থা হলে ছেড়ে দেব!
ছেড়ে দেয়ার চিন্তা নিয়ে শুরু করলেও ত্রিশ বছরেও ছাড়তে পারেন নি এ কাজ!
কেউ বলে ক্লিনার, কেউ বলে পরিচ্ছন্নতা কর্মী। কেউ ডাকে ময়লাওয়ালা! কেউ ডাকে সুইপার!
অদক্ষ এসব শ্রমিকদের অধিকাংশই অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান।
দৈনিক মজুরিভিত্তিক কাজ করেন।তাদের কাজ করলে মজুরী না করলে নেই।
চাকরির ধরন বেশিরভাগই অস্থায়ী! বেতনের পরিমাণ স্থায়ী! বছরের পর বছর যাবে, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়বে; বেতন বাড়বে না।
বেসরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী তোরাবের কাজ নিয়মিত! তবে ভবিষ্যত অনিশ্চিত।
তবে যে সব ক্লিনারের জীবন একরকম- ব্যাপারটি এমন নয়।
দেশ ভেদে, প্রতিষ্ঠান ভেদে সুযোগ-সুবিধায় রয়েছে ভিন্নতা।
যোগ্যতা ও পারদর্শিতার ওপর ভিত্তি করে কোথাও কোথাও বেতন–ভাতাও বাড়ে। উৎসব ভাতাও পায়।
তবে সুবিধাভোগী এদের হার খুবই কম!
বস্তির এক কামরায় মা, বোন আর বউ নিয়ে থাকেন তোরাব।
সবার ক্ষোভ যেন তার ওপর। সে সবার জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, তারপরও স্ত্রী-মা-বোন উঠতে বসতে তাকে কটু কথা শোনায়।
অভাবের সংসারে অভিযোগের শেষ নেই। অনেকের মাঝে থেকেও তোরাব একা! তাকে জানার-বুঝার যেন কেউ নেই!
কেমন চলছে জীবন?
-ক্লিনারের আবার জীবন! কোনোরকমে চলে। মাঝে মাঝে নিজে চলি, আর মাঝে মাঝে আল্লায় চালায়।
কোনো সমস্যা আছে?
-আরে ভাই কন কী? আমাগো জীবনডাইতো সমস্যার। কখনো গভীর রাতে, কখনো ভোর সকালে আবর্জনা পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে দিন শুরু করি। সকাল ৮টা পর্যন্ত বাসাবাড়ির ময়লা নেওয়ার কাজ করি। নয়টা থেকে অফিসে সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ করি। ফ্লোর পরিষ্কার করি, সিঁড়ি পরিষ্কার করি, গ্লাস পরিষ্কার করি, ধুলাবালি পরিষ্কার করি, চেয়ার-টেবিলসহ সকল ফার্নিচার পরিষ্কার করি। আমরা ভালোভাবে সবকিছুর পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করি। কিন্তু আমাগো মনের দুঃখ-কষ্ট কেউ পরিষ্কার করে না।রুটি-রুজি যে কত কষ্টের তা হাড়ে হাড়ে টের পাই!
এই যে এত ময়লার সাথে বসবাস- স্বাস্থ্য সমস্যা হয় না?
– ডাস্টবিন, র্বজ্য, দুর্গন্ধের মধ্যেই আমাদের জীবন। প্রথম দিকে ময়লার ভেতর থেকে বের হয়ে সাদা সাদা পোকা দেখলে বমি আসতো। এখন আর গা ঘিনঘিনে পরিবেশেও সমস্যা হয় না। ময়লার সাথে থাকতে থাকতে গায়ে রংও নষ্ট হয়ে যায়, আর জামা-কাপড় ও শরীর থেকেও গন্ধ বের হয়।
এই যে ডাস্টবিন ও ময়লাকে ঘিরে জীবন কাটানো। ময়লা আর গন্ধের মধ্যে ডুবে থেকে সবাইকে ময়লা আর গন্ধমুক্ত রাখা। এত কষ্ট! আপনি কেন এই কাজে এলেন?
– আমার বাবা ডাস্টবিনের ময়লা, আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ করতেন, এখন আমি করি। আমি আমার জম্মের পর থেকে এ কাজ করে আসছি। মাঝে মাঝেই শরীরে বিভিন্ন চর্মরোগ হয়। অসুখ বিসুখ হয়। তবু কাজ করে যেতে হয়। সাপ্তাহিক ছুটি নেই। কোনো ছুটি নেই। ঈদ নেই! শুধু কাজ আর কাজ! অসুখ-বিসুখ হলে কাজে না আসলে জরিমানা হয়ে যায়।
করোনার কোনো প্রভাব কী পড়েছে?
-খুব ভালোভাবেই পড়েছে। অনেককে লাইনে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতেও দেখা যাচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব মানছে না। সুরক্ষা উপকরণ পরছে না। অনেকে হালকা অসুস্থ-টসুস্থ হচ্ছে। তবে করোনার সংক্রমণ খুব ছড়িয়ে পড়ছে এমন নয়। আরে করোনাতো বড়লোকের রোগ, গরিব মাইনষের করোনা অয় না। পেটে ভাত না থাকলে কি আর ভাইরাস-টাইরাস গুনার টাইম থাকে বলেন!
আনন্দ বা দুঃখের কিছু বলবেন কী?
-আমরা কষ্ট করে চললেও হালাল খাই। পরকে ঠকাই না। ঋণী নই।–এতই আনন্দ! তাছাড়া আমগো জীবনডাই দুঃখের। সমাজের মানুষ আমাদের ছোট চোখে দেখে। নিম্নশ্রেণির মানুষ বলে হেয় করে। সমাজে কোনো মূল্য নেই। মানুষ উপেক্ষা করে, অবহেলা করে। কোথাও আমাদের পাত্তা নেই। আসলে কাজ কাজই! পরিশ্রম করে খাই! কে কি বলল যায় আসে না। তারপরও এ কাজে নিজের ছেলেকে আসতে দিব না। লেখাপড়া শেখাব। যাতে চাকরি-বাকরি করতে পারে।