আনিসুর রহমান এরশাদ
অনেক বড়বোন মায়ের মতো। ভাই যদি বেশি দক্ষ হয়, ভালো গেম খেলে, জোরে দৌড়ায়, ভালো রেজাল্ট করে, সম্মানজনক চাকরি পায় তাহলে বোন খুশি হয়। ছোটবেলায় অন্যদের সাথে ভাইয়ের মারামারি লাগলে বোন হন্তদন্ত হয়ে আগে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। আদর আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বোনের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্নেহময়ী নারীর মুখচ্ছবি, আহ্লাদ-আদর-ভালোবাসার স্পন্দন আর আবদারের প্রতিচ্ছবি। চঞ্চলতা আর মিষ্টি দুষ্টুমিতে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখা। বোনের ত্যাগ-মায়া-মমতা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কথা জানা আছে অনেকের। কথায় আছে ভাইয়ের জন্য বোনের মন কাঁদে সারাক্ষণ, ভাইয়ের মনে জাগে শুধু স্নেহের শিহরণ। আর জন্মদিনে বড় বোনের উপহার পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে যায় ছোটরা।
ভাইয়ের পছন্দকে প্রাধান্য দেয়
বোনেরা ভাইয়ের পছন্দ মতো নানান মুখরোচক আচার বানিয়ে দেয়, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়েও ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটাতে কষ্ট স্বীকার করেন। বোনের বানানো চায়ের স্বাদ ভাইয়ের জিহ্বায় লেগে থাকে আজীবন, টেবিলে অকারণেই তর্কের ঝড় কিংবা তুচ্ছ কথায় হাসির রোল কানে বাজে। ভাই খায়নি বলে নিজের পছন্দের খাবারটিও খাওয়া থেকে বিরত থাকা ছোটবোনদের পক্ষেই সম্ভব, ভাইসহ একসাথে খাবার জন্য ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমোঘুমো চোখে রাতে অপেক্ষা করার কারণে দেয়া বকুনি আসলে বকা নয়।
সম্পর্কে দুষ্টুমি থাকে আজীবন
বুড়ো বয়সেও একত্র হলে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণ, চেঁচামেচি, দুষ্টুমি করে থাকেন ভাইবোনেরাই। বড়দের অনেক সময় আম্মুর কথা শুনতে হয় ‘তুমি বড় হয়েছ। ছোট বোনের সাথে এসব করবে না’। অথচ মায়াময় জীবনটা মনে হলে আজীবন বড় ভাইবোনদেরও ভাবতে ইচ্ছে করে- ‘আমি এখনো ছোট। এখনো চোখ বন্ধ করে শুয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে ছোট বোন থাকলে কী করত এখন।’ ছোটবেলায় বোনের কোনো কথা ও কাজ খুব ভালোলাগলেও বা পছন্দ হলেও কিচ্ছু হয়নি বলা, ক্ষ্যাপায়ে মজা নিতে মুখে নেতিবাচক কথা বললেও ভেতরে ঠিকই খুশি হওয়া থাকে নিয়মিত ঘটনা। বড় হলে আর বকা দেয়া হয় না, ঝগড়া করা হয় না, রাগ-অভিমানের খেলা চলে না। তবু অনেক মিস করা হয় ছোট বোনের সাথে করা হইচই, মায়ের ফোলা চোখ, বাবার উদ্বেগ।
বাসার সবকিছু গুছায়ে রাখে
বিয়ের পর বোন সংসারী হলে তখন কেউ আর কিছু একটা বলে জবাব শুনার জন্য অনেকক্ষণ কান পেতে থাকে না, ভাইয়া বাড়িতে আসলে আনন্দের হিল্লোল বহে না। সারা বাড়িটা কী ভীষণ নিঃশব্দ। রাগ ভাঙাতে গালে চুমু খাওয়া, আদর করে চুল টেনে দেয়া, কেঁদে মার কাছে নালিশ করা, অসময়ে রুমে ঢোকার জন্য বকাবকি- থাকে না। বাইরে থেকে বাসায় ফিরে দেখা যায় না- টেবিলের ওপর এলোমেলো বইয়ের পাহাড় সুন্দরভাবে গুছানো, মেঝেতে থাকা অগোছালো কাপড়ের স্তূপ নেই, বিছানার এলোমেলো চাদরটাও চমৎকার টান টান রূপে। এসব কোনো জিন-ভূতের কাজ ছিল না, ছিল ছোটবোনের কাজ। বোনের বিয়ে হলে পছন্দের অনেক কিছুই অযত্নে পড়ে থাকে, শখের জিনিসেও ধুলার হালকা আস্তরণ জমে, কেউ যত্ন করে মুছে দেয় না। বেসুরো গান, ঝংকারহীন আবৃত্তি, চেঁচানোর মতো বয়ান হাসিমুখে মনোযোগ দিয়ে শুনে কানের ওপর অত্যাচার মেনে নেয় না কেউ।
মন ভালো করায় উদ্যোগী হয়
বোনকে ভালোবাসার কথা মুখে বলতে হয় না; তার দুঃখে চোখে ঠিকই পানি চলে আসে, তাকে ছাড়া বাড়িটা শুধু নয় মনটাও একদম নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে। যখন রিমোট নিয়ে মারামারি চলে না, লাঞ্চ রেডি করতে দেরি হলেও শাস্তি-তিরস্কার মিলে না। ভাইটি কোনোদিন চুপচাপ হয়ে গেলে, কিনে দেয়া কাপড়-জুতা পছন্দ না করলে, খেলতে বা মজা করতে রাজি না হলে, কারো খারাপ ব্যবহারে কষ্ট পেলে- সবার আগেতো বোনকেই ভাইয়ের মন ভালো করাতে উদ্যোগী হতে দেখা যায়। বয়সে বড় মানেই যে বেশি বোঝে, বেশি জানে, বেশি স্বপ্ন দেখে, বেশি স্মার্ট হয়, বেশি বকবক করে, পটিয়ে পটিয়ে আবদার পূরণ করে, গিফট বেশি পায়- এমনটি নয়।
দাবি পূরণে এগিয়ে আসে সহজেই
ছোটদের সুবিধে হচ্ছে- আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে, ঘর লুডু-সাপ লুডু-পৃথিবী লুডু খেলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে; বড় বোনের কাছে একটু ঘ্যান ঘ্যান করলেই সহজে রাজি করায়ে ফেলতে পারে। বড়ভাই কিংবা বোন যদি টিউশনি-চাকরি বা কিছু করে টাকা জোগাড় করতে পারে তাহলে তো আর কথাই নেই; আর না পারলেও বাবার কাছ থেকে আদায় করে দিতে পারে সহজেই। ভাই খেলায় জিতলে বোনের ভীষণ খুশি অনুভূত হয়, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে গর্ব অনুভূত হয়, সাফল্য অর্জন করলে পুরো আনন্দহীন বাড়িটাও ঝলমলে হাসিতে আনন্দময় হয়ে ওঠে। সব ভাইয়েরই বোন থাকে না, তবে বেশি সৌভাগ্যবান তারা যাদের ছোট-বড় বোন থাকে।
সবচেয়ে ভালো বন্ধু
বোনের সংস্পর্শ মানে পরিণত বয়সেও শিশুতোষ আবহ পাওয়া, গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বসে না থেকে কিছুটা সময়ের জন্য শিশুর মতো হয়ে যাওয়া, জীবনের জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে হাসি-আনন্দে থাকা, মজার কোনো কথায় হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়া। অনেক মধুর অনেক মজার, অনেক ভালোবাসার ও খুনসুটির সম্পর্কের কারণে ভাইবোন একজন আরেকজনের আয়নার মতো, জন্মের পর থেকেই তাদের সাথে বন্ধুত্ব, সুখ-দুঃখ-উত্থান-পতনের প্রত্যক্ষদর্শী। পরিবারে অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটলে, দুঃখ-দুর্দশা নেমে এলে পরস্পরের সান্নিধ্য বেশি দরকার হয়। তাই সুখের সময়কে আরো আনন্দময় করতে, ভিতরের হতাশা দূর করতে, হাহাকার কমাতে, না বলা কথাগুলো বলতে বোনকে বেছে নিন। বোন আপনাকে দেখলেই অনেক কিছু ভালোভাবে বুঝতে পারবে, তার মুখের ভাবভঙ্গি হবে আপনার মনেরই প্রতিচ্ছবি। স্বভাবজাত কোমলতা, সবকিছু দ্রুত বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা আর রক্তের সম্পর্কের কারণে যথাযথ অনুভব করার মাধ্যমে বোনই হতে পারে আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
মনের কথা বলা যায়
বোনেরা বড় হলেও বড় বড় ভাব ধরে না। বোনকে না বলা কথাগুলো প্রাণখুলে বলা যায়, মনে জমানো অনেক কথা বলায় মন হালকা হয়। বড় বোন না থাকলে পাওয়া যায় না দুলাভাই আর হওয়া যায় না শ্যালক। বড় হলে এতো কাছের একজনও আরেকজনকে আশেপাশে পায় না, একেকজন শিক্ষা বা কর্মের জন্য একেদিকে ছুটে যায়, হাতটা ধরতে বড় ইচ্ছে করলেও পাওয়া যায় না। দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝে মাঝে রাতে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে একজন উঠে পড়লে আরেকজনের হাতের স্পর্শে ভয় কেটে যায়। বোনদের মাঝে যেমন কিছু কমন মিল থাকে, আবার অনেকক্ষেত্রে একেক জনের একেক রুচি হয়। কেউ মাথায় ফুল দিতে চায় তো কেউ টিকলি। আত্মীয়-স্বজনের বিয়ে অনুষ্ঠানে বোনের সাথে যাওয়া, বোনের সাথে খাওয়া, বোনের সাথে ঘোরাঘুরি, বোনের সাথে গল্প করা, বোনের সাথে পড়া-লেখা করা।
বড় আদরের ছোটবোন
যেকোনো পরিস্থিতিতে বোনের সাথে সম্পর্ক কোমলতা-কঠোরতার অপূর্ব সংমিশ্রণ, অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকা, প্রচণ্ড রাগের কিছুক্ষণের মধ্যেই ম্যাগি নুডুলস রান্না করে নিয়ে এসে কিংবা আইসক্রিম কিনে নিয়ে এসে অবাক করে দেয়া মধুর চাইতেও মধুর। বোনের সাথে আদর-ভালোবাসার মধুর সম্পর্ক। বোন হচ্ছে অতি আপনজন ঘনিষ্ঠ মহল সেলায়ে রেহমীর অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ এক-মাতৃগর্ভজাত সন্তান-একই মায়ের কোলে যাদের অবস্থান ছিল। একটা খেলার পুতুল ভাঙলে, জানালা দিয়ে একটা বল ফেললে এই সম্পর্ক ভেঙে যায় না। শর্তহীন-নিখাদ ভালোবাসা থাকে সবসময়, সবখানে। বোনের সাথে আনন্দ-বেদনার ভালোবাসার অনেক স্মৃতি থাকে, আনন্দ আড্ডায় জমজমাট থাকে বাসা, মাতিয়ে রাখে সব সময়। অর্থের অভাব থাকলেও শ্রদ্ধা-ভালোবাসার অভাব থাকে না। বোনেরা বাসায় ভাইদের সবকিছু খেয়াল রাখে। অধিকাংশক্ষেত্রে বোনেরা মানুষ হিসেবে অসাধারণ, আশপাশের মানুষের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল, অনেক বেশি দায়িত্ব নেয়, অনেক পরিশ্রম করে।