জীবন-জীবিকার গল্প: ভিক্ষুক
স্বামী পরিত্যক্ত নারী নারগিস।
অসহায় দরিদ্র নারীটি শিশুকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছে।
কাজের আশায় গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। কাজ না পেয়ে সহজতম আয়ের পথ ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছে।
ঠিকানা বিহীন ভাসমান মানুষ, খুব কষ্ট করে থাকেন।
কাজ করে খেতে পারো না?
– বললো, গ্রাম-গঞ্জে কোনো কাজ-কাম নাই।
স্বামী রিক্সা চালক। আরেকটি বিয়ে করেছেন। ঘর থেকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
বাচ্চা মেয়েটার শরীরের কিছু অংশ পুড়ে গেছে।
কিভাবে পুড়লো?
– আগে বস্তিতে যে ঘরে থাকতাম তাতে আগুন ধরেছিল। আমি বাইরে কাজে গেছিলাম। এসে দেখি পুড়ে গেছে।
বাবা-ভাই নাই?
– বাবা আছে। কিন্তু সন্তানদের প্রতি বেখেয়াল। নিজেই ঠিকমতো চলতে পারেন না।
মা অসহায় বৃদ্ধা। বুড়ো বয়সেও ভিক্ষা করে তার চলতে হয়!
দুই ভাই আছে। কিন্তু বাবা-মাকে কেউ দেখে না।
কি আর বলব ভাই! কপাল খারাপ! সব কপালের দোষ!
কপাল খারাপ না হলে কি আর ভিক্ষা করা লাগে।
বাবা কেন চলতে পারেন না? সমস্যা কী?
-বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী। ভিক্ষাবৃত্তিকেই বেঁচে থাকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
বাবা ছোটবেলা থেকেই ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে গেছেন।
যারা ভিক্ষা করে সবাই কী আপনার মতো অসহায়?
– কী যে বলেন ভাই। অনেকের জমি-জমা আছে, টাকা-পয়সা আছে- তারপরও ভিক্ষা করেন।
একটা দুষ্টু চক্র অন্যদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করিয়ে অর্থও হাতিয়ে নেয়।
অনেকে ভিক্ষুকের বেশে থাকেন। কিন্তু এটা ছদ্মবেশ। বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত।
এমনও চক্র আছে যারা শিশুদেরকে ভিক্ষাবৃত্তির উপযোগী বানানোর জন্যে হাত-পা ভেঙ্গে বা খোড়া করে দেন।
চোখ উপড়ে ফেলতেও তারা দ্বিধা করে না!
এখন কোথায় থাকেন, কোথায় ঘুমান?
– আপনাকেতো বলালামই আগে বস্তিতে থাকতাম। বস্তিতে আগুন লাগার পর মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে।
যা ছিল সবকিছু পুরে ছাই হয়ে গেছে।প্রাণে বেঁচে গেছি সেটিই বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
এখন স্টেডিয়ামে থাকি। একা থাকলে মাথায় একটি ইট দিয়ে ধুলাবালির মধ্যে ফুটপাতে ঘুমালেও চিন্তা করতাম না।
যত চিন্তা এখন বাচ্চাকে নিয়ে।
একাই থাকেন? রাতে ঘুমাতে ভয় করে না?
– গরিবের আবার ভয়! ভয়তো করেই। কিন্তু কি করব উপায় যে নাই।
এখন এলাকার এক বড়ভাইও পাশে থাকেন। মাস খানেক আগে পরিচয় হয়েছে।
উনার বাম পা ৫ বছর পূর্বে এক দুর্ঘটনায় কেটে ফেলা হয়। এরপর সে গুলিস্তান এলাকায় ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে। আগে টোকাইয়ের কাজ করতো। তারও কোনো বিছানা নেই। সেও খুব গরিব। তারপরও সাহস পাই, ভরসা পাই।
আর অহন ভয়ের কী আছে? আমরার কি অইব? আমাদের কাছ থেইকা কি টেহা-পয়সা নিতে পারবো?
ঢাকায় আসছিলেন কেন?
আসলে ডিভোর্সের পরে খুব অসহায় হয়ে পড়ি। এক কাপড়ে স্বামীর ঘর থেকে বেড়িয়ে আসি।
কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে। তখন আশ্রয় নেয়ার মতো বাবার বাড়ি ছাড়া অন্য কোনো জায়গা ছিল না।
কিন্তু পরিচিতজনরাও নানা বাজে কথা বলতো, কটু কথা বলতো।
বাবা-মা নিজেরাই অক্ষম-অসহায়। তাদের আপদ হয়ে থাকতেও চাইনি।
ঢাকায় এসেছিলাম বাঁচার জন্য । কাজের জন্য। চাকরির জন্য। কিন্তু পরিচিত কেউ নাই। চাকরির লাইন-ঘাট নাই।
তারপরও কিছু কাজের আলাপ হইছিল। কিন্তু বাচ্চাটাকে কার কাছে রাখব? কোথায় রাখব?
বাচ্চাকেও সাথে রেখে কাজ করা যাবে এমন কাজ খুঁজে না পেয়ে চেয়ে-চিন্তে চলার এই পথে নেমেছি।
বাচ্চাটা একটু বড় হলে এই কাজ ছেড়ে দেব।
আপনি বলছিলেন- এলাকার এক বড়ভাইয়ের কথা। তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।
– তিনিও অতিদরিদ্র। ঢাকায় আসেন ১০ বছর আগে। শুরু থেকেই স্টেডিয়ামেই রাত কাটান।
দিনে রাজধানীর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করেন। তার বাম হাত নেই।
গ্রামে দুই মেয়ে ও স্ত্রী আছে। আয়ের কিছু অংশ প্রতি মাসে পরিবারের জন্য পাঠান।
এই দিয়ে তার স্ত্রী ও কন্যা কোনো রকমে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটায়।
বছরে দুই-একবার ঈদের সময় স্ত্রী-মেয়েদের দেখতে গ্রামে যান। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা বলেন।
আমার সাথে মনের সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করেন। উনিও দুঃখেই আছেন।
আপনার কোনো বান্ধবী আছে?
– গ্রামেতো ছিলই। শহরে একজনের সাথে মনের কথা খুইলা বলি। সেও তার সব কথা আমাকে বলে।
নাম তার কমলা। ১২ বছর আগে ঢাকায় চলে আসে।
ছয় বছর আগে রিকশাচালক সিদ্দিকের সঙ্গে তাদের বিয়ে হয় স্টেডিয়াম এলাকায়।
দুই মেয়ে ও এক শিশু ছেলে তাদের। তবে কষ্টের কথা হলো- তার স্বামী তিন মাস ধরে অসুস্থ।
স্বামী কোনো কাজ করতে পারে না। কমলা ভিক্ষা করে কিংবা হোটেলে কাজ করে স্বামী ও সন্তানদের দু’মুঠো খাবার যোগান দিয়ে যাচ্ছে। স্টেডিয়ামে ছেঁড়া কাপড় বিছিয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে সেও রাত কাটায়।
অনেক সময় আমরা একসাথেই থাকি।
ঝড় বৃষ্টি হলে কী করেন?
– আসলে ফুটপাতে কিংবা পার্কে খোলা আকাশের নীচে যারা থাকেন তাদের বৃষ্টিতে ভিজতে হয়, রোদেও পুড়তে হয়।
যখন বৃষ্টি নামে তখন বিছানা উঠাইয়া রাস্তার পাশের দোকানের সামনে বসি, বৃষ্টি থামলে আবার শুই। কি করুম।
আপনি বললেন ভিক্ষুকদের মধ্যে দুষ্ট চক্রের কথা। এই চক্র বলতে আপনি কী ভিক্ষুকদের দালালদের বুঝাইছেন?
– হ্যাঁ। এরা অন্ধদের অপহরণ করে। পাগলদেরও সামান্য র্অথের বিনিময়ে কিনে নেয়।
শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরকে দালালরা ভিক্ষা করার জন্য নানা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে থাকে।
দালালচক্র কৌশলে অতি নিষ্ঠুরভাবে হাত-পা ভেঙ্গে বিকলাঙ্গ বানিয়ে এ কাজে লাগিয়ে থাকে।
তাদেরকে রাস্তার মোড়ে, মসজিদের সামনে, লোকালয়, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কবরস্থান, ঈদগাহের সামনে বসায়।
র্জীণ-র্শীণ সাজসজ্জায় ভিক্ষুক বেশে সাহায্য নেয়ার জন্য প্রেরণ করে। ভিক্ষা চাওয়ার বাচনভঙ্গি তারা আগে থেকেই শিখিয়ে দেন।
ভিক্ষুকরা যে র্অথ উর্পাজন করে তার সিংহভাগ অর্থই দালালরা নিয়ে নেয়।
ভিক্ষুকদের জন্যে কোনো রকমে বেঁচে থাকার মতো আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। ঠিকমতো চিকিৎসা করে না।
অনেক সময় রোগের ব্যথাকে আরো তীব্র করে রাস্তায় চিৎকার করতে বলা হয় যাতে মানুষ বেশি বেশি ভিক্ষা দেয়।
নগরের প্রত্যেক থানায় রয়েছে ভিক্ষুকদের আলাদা আলাদা সংঘবদ্ধ গ্রুপ। দিনের বিভিন্ন সময়ে ক্যাব, সিএনজি, অটোরিক্সা, রিক্সা এবং ট্রলিতে করে ভিক্ষুকদের বিভিন্ন স্পটে নামিয়ে দেন। তারপর দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেন কার্যক্রম।
স্পটের গুরুত্ব ও ভিক্ষুকের দক্ষতা এখানে বিশেষভাবে কাজ করে। ভিক্ষুকরা খুব কম টাকাই পেয়ে থাকে, টাকা নিয়ে ভিক্ষুকদের দালাল এবং বিভিন্ন স্পটের পুলিশ।
আপনি গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলেন। পড়ালেখা কোন পর্যন্ত করেছেন?
– আমি এইচএসসি পাস করেছি। তখন ভাবতাম শিক্ষিত হয়েছি।
জীবনটা সুখের হবে। ভালো সংসার হবে। কোনো আশাইতো পূরণ হলো না।
ভবিষ্যতে হবে। ভালো কিছু হবে ইনশাআল্লাহ।
– কবে আর হবে! তারপরও আপনার কথাই যেন সত্য হয়। দোয়া করবেন ভাই।
কথা বলে ভালো লাগলো। সময় দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
– আপনাকেও ধন্যবাদ।