পারিবারিক মূল্যবোধগুলি এমন নৈতিকতা যা একটি পরিবারের বিশ্বাস, মনোভাব এবং আদর্শকে গঠনে সহায়তা করে। পরিবার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানগুলির উপর ভিত্তি করেই মূলত ‘নৈতিক’ সংজ্ঞায়িত করা হয়। প্রতিটি পরিবারের মধ্যে ভালো নৈতিকতাকে উত্সাহিত করা হলে তা আচরণ, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, সম্পর্ক এবং পারিবারিক ঐতিহ্য ও অভ্যাসকে প্রভাবিত করে।
পারিবারিক মূল্যবোধগুলি এমন গুণগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে যা আপনার পরিবারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সততা বা কঠোর পরিশ্রম বা দয়া। আপনার পরিবারের নৈতিক মূল্যবোধগুলিই পাবলিক আচরণ, কর্ম নীতি এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করে। পারিবারিক মূল্যবোধ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দখল করে থাকে।
পারিবারিক মূল্যবোধের কিছু উদাহরণ হচ্ছে- সামাজিক মূল্যবোধ, সম্মান এবং ভদ্রতা, স্বেচ্ছাসেবী কাজ, অন্যদের প্রতি দয়া, অন্যদের পাশে দাঁড়ানো, যথাযথ শৃঙ্খলা, অন্যদের প্রতি মনোভাব, ভাষা পছন্দ, নাগরিক মূল্যবোধ, সুযোগ, স্বদেশপ্রেম, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত অধিকার, আইনের প্রতি সম্মান, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, শ্রেষ্ঠত্বের অঙ্গীকার, সৃজনশীলতা, আকর্ষণীয় অভিব্যক্তি, অর্জনের মাধ্যমে সন্তুষ্টি, আর্থিক নিরাপত্তা বা স্থায়িত্ব, খরচের দর্শন, উৎপাদনশীলতা, শিক্ষা ও জ্ঞান, ধর্মীয় মূল্যবোধ, স্রষ্টার প্রতি সম্মান, আদেশের আনুগত্য, প্রার্থনায় উপস্থিতি, বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক পরিহার, পোষাক, চেহারা, সাধারণ মূল্যবোধ, বিশ্বাসযোগ্যতা, পরদুঃখকাতরতা, সততা, কৃতজ্ঞতাবোধ, ধৈর্য, অধ্যবসায়, ইতিবাচক মনোভাব ও একসাথে কোয়ালিটি সময় কাটানো।
ন্যায়পরায়ণতা, সমতা, উদারতা, সমবেদনা, অন্যকে মানুষ হিসাবে সঠিক মূল্যায়ন ও প্রয়োজনে অসহায়ের জন্য সহায়ক হাত বাড়িয়ে দেয়াই আমাদের ‘মূল্যবোধ’ বলে বিবেচিত। যা আমাদেরকে বিকাশ ও প্রকাশে সহায়তা করে, আমাদের আচরণকে চালনা করে।
পারিবারিক মূল্যবোধ ব্যক্তির স্বভাবের গভীরে প্রথিত হতে পারে। পারিবারিক মূল্যবোধগুলি যখন ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত হয় এবং বাড়িতে চর্চিত হয়, তখন সেগুলি নির্ধারণ করে আপনি কে এবং কীভাবে কাজ করেন। নৈতিক মূল্যবোধগুলি যখন ইচ্ছাকৃতভাবে শেখানো এবং অনুসরণ করা হয় তা একসাথে পারিবারিক সাধারণ লক্ষ্যে অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
নৈতিকতা প্রায়শই বাড়িতে শেখা হয়। সমাজ বা দল থেকেও কিছু মূল্যবোধ শেযার হতে পারে, কিন্তু এটি মূলত অন্যদের পরিবারে চর্চিত মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। নৈতিক মূল্যবোধ ঘর থেকেই সঞ্চারিত হয়,তাই মূল্যবোধ শেখানো পিতামাতার জন্য বড় দায়িত্ব।
পারিবারিক মূল্যবোধ পরিবারকে সুখী ও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। পারিবারিক মূল্যবোধ ব্যক্তির আচরণকে প্রভাবিত করে। পরিবারে চর্চিত সুনির্দিষ্ট মূল্যবোধগুলো ব্যক্তির পছন্দ–অপছন্দ গঠনে সরাসরি সাহায্য করে। পরিবার থেকে শেখা কোনটি সঠিক এবং কোনটি ভুল এ সংক্রান্ত ধারণেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে।
প্রাথমিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও পরিবার থেকে শেখা নৈতিকতাগুলোই বৃহত্তর জীবনে প্রবেশের পরও শক্তিশালী হতে পারে । মূল্যবোধ আমাদের নৈতিক লক্ষ্যের কিছু বিবৃতি যা আমরা পরিবার থেকে শিখি । অনেক সময় পারিপার্শিক অবস্থার কারণে মূল্যবোধের সাথে আপোষ করলেও মূল্যবোধ কোন না কোন ভাবে ধরে রাখে।
মূল্যবোধগুলি পারিবারকে সংহতি এবং পরিচিতি নির্মাণে সহায়তা করতে পারে। পরিবারের পরিচয়ে মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যবোধগুলিই ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এবং পরিবারকে শক্তিশালী রাখতে সহায়তা করে। পারিবারিক মূল্যবোধগুলিই আপনার সম্পর্কে অন্যদেরকে ধারণা দেয়। আপনি সম্মান করেন এমন পরিবারের মধ্যে কোন মূল্যবোধ রয়েছে? দৃঢ় নৈতিকতা এমনি এমনি হয় না।
পরিবারই মূল্যবোধের সাথে জীবন যাপনে অ্ভ্যস্ত করে। নারীদের গর্ভাশয় পরবর্তী প্রজন্মকে ধারণ করতে প্রস্তুত, তার স্তনযুগল প্রস্তুত যার পুষ্টিদানে, হূদয়ের স্নেহ-মমতা প্রস্তুত যার মনের বিকাশ সাধনে, সেই সমাজের নারী আজ সন্তান কোলে ধারণ করতে আগ্রহী নয়। বেশি উপার্জন করা ও ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করার চিন্তায় সন্তানের জন্ম, লালন-পালনকে বাধা ও ঝামেলা মুক্ত মনে করাটা মূল্যবোধ পরিপন্থী। এতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কোমলতা ও প্রশান্তি নষ্ট হয়ে যায়।
পারিবারিক মূল্যবোধ সমাজকে দৃঢ় রাখতে সাহায্য করে। মূল্যবোধের চর্চাহীন পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ সহজেই হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সমাজের মানুষও তার কুফল ভোগ করে। যারা খারাপ তারা ভালকে মন্দ এবং মন্দকে ভাল বলে। যখন মানুষের নূন্যতম নৈতিকতা বা মূল্যবোধ থাকে না তখন সে অন্যদের জন্য হয় বিপদজনক।
খারাপ সবকিছু থেকে সমাজকে মুক্ত করতে চাইলে পরিবারগুলোকে মূল্যবোধ শিক্ষার একেকটি কেন্দ্র বানাতে হবে। পারিবারিক স্থিতিশীলতা যে কোনো বিচারেই গুরুত্বপূর্ণ। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পারিবারিক মূল্যবোধগুলি ছড়িয়ে পড়ে।
নৈতিক মূল্যবোধগুলি মূলত গৃহেই শেখা হয় এবং সাধারণত পরিবারের বড় সদস্যের কাছ থেকে ছোটরা শিখে থাকে। বাবা-মা সাধারণত মূল্যবোধ চালু করেন। মাতাপিতা তাদের শিশুদের জন্য রোল মডেল। পিতামাতার কাছ থেকেই সন্তানরা নীতি-নৈতিকতার অনেক কিছু শিখেন। নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সফল বিবাহ ও সার্থক পরিবার গঠনে একই ধরণের মূল্যবোধ থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিবাহের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মূল্যবোধগুলো এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে। নৈতিক মূল্যবোধ কারো কাছে অপরিহার্য হলে তার কাছে সেই আকর্ষণীয় বিবেচিত হবে যার একই মূল্যবোধ রয়েছে।
বিয়ের সিদ্ধান্তের আগেই নিজের মানসিকতা এবং নৈতিক প্রত্যাশা নিয়ে অন্যের সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বলুন। বিয়ের পর কিছু মূল্যবোধ একসাথে ঠিক করুন যা আপনার নতুন পরিবার পরিচালনায় নির্দেশনা দিবে। পারিবারিক জীবনকে অধিকারের কষাকষিতে না ফেলে মী-স্ত্রীকে প্রীতি-ভালোবাসা, হূদ্যতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবনযাপন করতে হবে। শিশুকালেই সন্তানদের পারিবারিক মূল্যবোধ বিষয়ে ধারণা দিতে হবে।
পারিবারিক নৈতিকতার উপর আপনার একটি প্রভাব সবসময় থাকতে পারে। পরিবারের সবার জন্য নৈতিকতার ব্যাপারে নির্দেশনা সুস্পষ্ট থাকতে হবে। কারো অস্পষ্টতা থাকলে আপনিই পরিবারের একটি ইতিবাচক শক্তি হতে পারেন, আপনার ক্রিয়াকলাপগুলি আপনার নিকটতম লোকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
এক্ষেত্রে সংবেদনশীল হতে হবে। মূল্যবোধ ব্যক্তির আত্মপরিচয় নির্মাণ করে, কারো মূল্যবোধ আক্রমণকে সে ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে করতে পারেন। আপনার থেকে পৃথক যে কেউ এর মান পরিবর্তন করার চেষ্টা করার পরিবর্তে সাধারণ মান শক্তিশালী এবং নির্মাণ করার উপায়গুলির জন্য সন্ধান করুন।
আপনি কিভাবে একটি পরিবারে ভালো মূল্যবোধকে স্থাপন করবেন? আপনাকে আশাবাদী হতে হবে। আপনার কাছের মানুষেরা আপনার আচরণ মূল্যবান মনে করলে নিজেরাও তা বেছে নেবে। মানুষ আপনার ব্যবহারিক জীবন দেখেই আপনার মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা নিবে। নৈতিকতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে, তবে কাজে প্রমাণ করাই বেশি কার্যকরী।
পারিবাকিভাবে নীতিবোধের চর্চা ও মূল্যবোধ গড়ে না উঠলে পারিবারিক সুখের বন্ধনগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ধর্ষণ, স্বজন হত্যা, মায়ের হাতে সন্তান খুন, সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন, পারিবারিক খুনাখুনি ও আত্মহননের ‘সংস্কৃতি’ বন্ধ করতে চাইলে পারিবারিক মূল্যবোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আপনাকে মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে তৈরি করুন। আপনি আপনার পরিবারকে কেমন চান? মানুষ আপনাকে কেমন বলবে বলে আপনি আপনি আশা করেন। এখন থেকে ২২-২৩ বছর পর আপনি কী আশা করবেন, আপনার সন্তানরা কীভাবে বড় হয়ে উঠবে এবং তারা আপনার কাছ থেকে কী শিখবে? সত্যিকারের মূল্যবোধ চিহ্নিত করুন এবং যেগুলো পরিবারে ফোকাস করতে চান সেগুলিকে অগ্রাধিকার দিন।
বিবাহিত হলে নিশ্চিত করুন যে দুজনেই একই লক্ষ্যে কাজ করবেন। আপনি যদি মূল্যবোধগুলো স্পষ্ট করতে না পারেন তবে আপনার সন্তানের জন্য আপনার কাছে স্পষ্ট প্রত্যাশা থাকবে না। আপনার পরিবারের মূল্যবোধগুলো লিখুন এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করুন।
গুরুজনদের অনৈতিকতা, দুর্নীতি ও মিথ্যাচার দেখে ফ্ল্যাট নামক জেলখানায় গৃহকর্মীদের হাতে বেড়ে উঠা প্রজন্ম । ভেজাল খাবার খেয়ে, দূষিত আবহাওয়া আর অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির মধ্যে। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ায় অল্প বয়সেই নিরিবিলি ইন্টারনেটের মাধ্যমে খারাপ সাইটগুলো দেখার সুযোগ পাচ্ছে ।
এক দেশের টিভিতে প্রচারিত ক্রাইম পেট্রোলে দেখানো সত্য কাহিনিগুলোর সঙ্গে আরেক দেশের কিশোর বা শিশুদের অপরাধ মিলে যাচ্ছে । এ সময়ে পরিবারকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।