জীবন-জীবিকার গল্প : ঝাড়ুদার
ঝাড়ুদার রহিমা (ছদ্মনাম)।
ঝাড়ু দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন।
সংসারের খরচ চালাতে স্কুলে যাবার বয়সে কলম-খাতার বদলে ঝাড়ু হাতে তুলে নিয়েছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি৷
এই ঝাড়ুই যে তার আজীবনের আত্মপরিচয় নির্মাণ করবে তা তখন ভাবেননি তিনি।
যখন তার বাবা তাদের তিন ভাই-বোন ও মাকে ছেড়ে চলে যান। আরেকটি নতুন সংসার পাতেন। খোঁজ নেন না। মা শহরের বিভিন্ন মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেন। মায়ের যা আয় হয় তা দিয়ে সংসারও ঠিকমতো চলে না।
তখন কিশোরী রহিমা বাসা-বাড়ির সিঁড়ি ঝাড়ু দেয়ার কাজ নেন। নিদারুণ কষ্টে কাটতে থাকে সময়।
তারপর পরিচিত এক আপার মাধ্যমে বাণিজ্যিক এলাকার অফিসে ঝাড়ু দেয়ার কাজ পান। অনেক সময় বেতন পেতে দেরী হওয়ায় অনেক কষ্টে দিন কেটেছে, খাবারও ঠিকমতো পাননি।
শুরুর দিকে অনেকগুলো অফিসে ঝাড়ু দিতেন। মাঝে মাঝে হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। পরেরদিন কাজ করতে করতে ফোস্কা গলে যেত! খুবই কষ্টদায়ক অবস্থা তৈরি হতো! যন্ত্রণায় ছটফট করতেন! রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারতেন না।
একসময় সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি পান। তখন থেকে ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নেমে আসেন।
রহিমা পয়ত্রিশ বছর ধরে এই কাজ করে। অন্য কিছু করতে পারেন না? উত্তর দেয়- ‘স্যার, এটা আমার আর আমার বাচ্চাদের রিজিক। আমার রাস্তা পরিষ্কার করতে ভালো লাগে, স্যার।’
৫০ বছর বয়সের রহিমের দুই ছেলেমেয়ে। দু’জনই একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রহিমা বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে অনেক দিসেন। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আমার ২ ছেলেমেয়ের জন্য আমার কোনোদিনও কোনো টাকা-পয়সা লাগে নাই। ওদেরকে প্রাইভেট পড়ানোর সামর্থ্য আমার ছিল না। স্কুলের স্যাররা টেস্ট পরীক্ষার পর ফ্রি প্রাইভেট পড়াইসেন। আমি অশিক্ষিত মানুষ। সবাই বলে, ওরা অনেক ভালো করতেসে। সবার কাছে ওদের সম্পর্কে ভালোকিছু শুনলে ভালো লাগে। মেয়েটাকে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে দিব।’
‘বাসায় কে কে আছেন?’
‘স্যার, আমিই আছি। ছেলে ও মেয়ে ভার্সিটির হলে উঠসে। আল্লাহ অনেক ভালো রাখসেন, স্যার। রোগবালাই দেন নাই, কোনো অশান্তিও দেন নাই।’
‘সব মিলিয়ে ভালোই আছেন?’
‘স্যার আমার বাচ্চাগুলোকে মানুষ করার জন্য অনেক কষ্ট করসি। নিজে না খেয়ে ওদেরকে খাওয়াইসি। কখনো ভালো কাপড় দিতে পারি নাই, কিন্তু বইখাতা কিনে দিসি। ওরা নাইনটেনে পড়ার সময় থেকে টিউশনি করে খরচ চালাইসে। ঈদের সময় বউ মানুষের নতুন কাপড় সেলাই করে দিতো, কিন্তু নিজে নতুন কাপড় কিনতে পারে নাই। আমার ছেলে আর ওর বন্ধুরা সবাই মিলে ঢাকায় রাস্তার কিছু ছেলেপেলেকে সন্ধ্যার সময় ফ্রিতে পড়ায়। শুনে আমি অনেক খুশি হইসি। আমরা কখনো কাউকে ঠকাই নাই। আল্লাহও আমাদেরকে কখনো ঠকান নাই।’
সড়কে জমে থাকা আবর্জনা ও ধুলাবালু পরিষ্কারের জন্য প্রতিদিন ভোরে ঝাড়ু হাতে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নগর জীবনে ব্যস্ত অনেক মানুষ তাকে দেখে তবে খুব কম জনই কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে।
রহিমার মনে খুব শান্তি বস্তির একটি টিনশেড ঘরে ভাড়া থেকেও নিজের ছেলে-মেয়েকে শিক্ষিত করতে পারায়। ঝাড়ু দেওয়া ও ময়লাগুলোকে এক সথে করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে সময় দেয়া রহিমা জীবন নিয়ে খুবই তৃপ্ত। কোনো আক্ষেপ নেই, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। অল্পে তুষ্ট প্রশান্ত এক প্রাণ!
রহিমা মনে করেন- যদি ঝাড়ুদার না থাকতো ময়লায় পরিপূর্ণ থাকতো সর্বত্র! তাই হীনমন্যতায় ভুগেন না! যদিও মায়ের পরিচয়ের কারণে সন্তানরা অনেক সময় উপেক্ষা-অবহেলার শিকার হয়েছে, আবার অনেক সময় অনেকে সহযোগিতার হাতও বাড়িয়েছেন।
সাধারণত ঝাড়ুদারা কাজ করে যে টাকা বেতন পান তাতে অভাব-অনটনে যায় না। টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারেন না৷ ফলে তুলনামূলক কম বয়সেই রোগে-শোকে ভগ্ন শরীর এবং ভগ্ন মন নিয়ে কোনোরকমে দিন পার করেন৷ তবে রহিমা ব্যতিক্রম। তার উপার্জনেই চলছে পরিবার। অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপনও করেছেন৷ তবে নিজে পড়ালেখা করতে না পারার দুঃখ ভুলতে ছেলে-মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করছেন।