জীবন-জীবিকার গল্প : প্রবাসী শ্রমিক
আসাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে প্রবাসে। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে তিনি কাজ করেছেন। তিনি বিদেশ গিয়েছিলেন স্বজনদেরকে ভালো ও আনন্দে রাখার জন্যই।
পরিবার-পরিজনকে ভালো রাখার জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন। নিজে একটু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া, ভালো পরার চিন্তা কখনো করেন নি। অথচ তার কষ্টার্জিত অনেক অর্থ গেছে দালালের পকেটেও। তিনি প্রথম যখন বিদেশ যান তখন নিজের থাকার ঘরটিও বিক্রি করেন। ছোট ছেলে-মেয়েসহ স্ত্রীর ঠাঁই হয় মাটির বেড়ার ছনের ঘরে। ঋণ করেছেন। স্ত্রীর গহনা থেকে শুরু করে সব সম্পত্তি বিক্রি করেন।
টাকা কামাই যে কত কষ্ট তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তিনি। তিনি কর্মজীবনের কিছু সময়ের জন্য প্রবাসী হয়েছেন, সারা জীবনের জন্য হননি। নিজের প্রয়োজনেও বাড়তি টাকা খরচ করেন নি। প্রতিমাসে পরিবারের জন্য সঞ্চিত অর্থ পাঠানোই ছিল তার জন্য আনন্দের। তার শ্রম-ঘাম-কষ্ট খুব কম জনই জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে!
স্বজনদের বিলাসিতায় প্রবাসীর কষ্ট
স্বজনরা বিলাসিতা করলে সবচেয়ে কষ্ট পায় উপার্জনকারী প্রবাসী। কারণ ঘাম, রক্ত, এমনকি জীবন দিয়েও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন তারা৷ আর্থিক অনটনে থাকা বহু শ্রমিক নিজের প্রয়োজনেও বাড়তি টাকা খরচ করেন না।
কাজ হারালে অসহায় হয়ে পড়েন। মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়। মালিক ভালো হলে ধার দেয়, তবে মাসে বেতন থেকে কেটে নেয়।
বিদেশে যেতে-ফিরতে সমস্যা
দালাল ধরে অধিক খরচে যাওয়া অনেকের জন্য বড় বোঝা হয়ে যায়। টাকা শোধ করার চাপ থাকে। অনেক খারাপ মালিক কাজ করিয়ে টাকা ঠিকমতো দেয় না। ফলে শ্রমিক সর্বস্বান্ত হন। ছুটিতে দেশে এসেও অনেকে পরে কাজে ফিরতে না পেরে বিপদে পরেন।
অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিকই দেশে ফিরে ভালো কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন না। কর্মহীন জীবন চালাতে জমানো টাকা খরচ হয়। নতুন করে ফের প্রবাসে ছুটার পরিস্থিতি তৈরি হয়। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর প্রতারণায়ও অনেকে অসহায় হয়ে পড়েন।
সুখ-দুঃখের প্রবাস জীবন
প্রবাসীদের জীবন কারো ভালো কাটে, কারো খারাপ কাটে। প্রবাস জীবন কারো সুখের, কারো দুঃখের। যাদের দুঃখের, তাদের দুঃখ-দুর্দশার কোনো শেষ নেই। আছে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, হাড়ভাঙা পরিশ্রম। প্রবাসীর কষ্ট, অনভূতি, বেদনা, নিরব কান্না কেউ বোঝার চেষ্টা করলেই প্রবাসীর মন আনন্দে ভরে ওঠে।
একটি চিঠি, একটি এসএমএস, একটি কল তাদেরকে আনন্দে উদ্বেলিত করে। একটু সহানুভূতি-সমানুভূতি একজন প্রবাসীর জীবনে অনেক প্রভাব ফেলে। প্রবাস জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে দেশে থাকা মানুষদের যোগাযোগ দারুণ ভূমিকা রাখে।
প্রবাসীর কাছে প্রবাস জীবনের বাস্তবতা
প্রবাস জীবন বাইরে থেকে যতটা আকর্ষণীয় ভেতর থেকে ততটা আকর্ষণীয় নয়। প্রবাসীর কাছে প্রবাসের জীবন একটু ভিন্ন। দেশ থেকে সবকিছু ছেড়ে যেতে হয়। মা-বাবার আদর, ভাই-বোনের ভালোবাসা, স্ত্রীর সান্নিধ্য, সন্তানের টান ছাড়তে হয়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের রেখে যেতে হয়। প্রবাসীর মনটা পড়ে থাকে দেশের মাটিতেই।
মনে পড়ে পরিচিতজনদের কথা। তখন কাজ করতে ইচ্ছে হয় না। ইচ্ছে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে আসতে। কিন্তু দেশে আসলে আপন মানুষগুলো অর্থকষ্টে ভুগবে! প্রিয় মানুষগুলোর মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া সে সহ্য করতে পারবে না। তাই শত যন্ত্রণার পরও অন্যদের ভালো রাখতে, স্বস্তিতে রাখতে কষ্ট স্বীকার করে। দেশে ফিরলে তাদের সুখ থাকবে না বলে বিদেশে থাকে, দেশে ফেরে না। জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করে।
আসলে কী চাইতেন আসাদ?
আসাদও চাইতেন- প্রিয় মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখতে। তাদের সুখে-শান্তিতে থাকা নিশ্চিত করতে। এমনও হয়েছে মাসে যা বেতন পেতেন তা দিয়ে চলতো না। পার্ট টাইম বাড়তি কাজ করতেন। আরাম-আয়েশের চিন্তা না করে অতিরিক্ত ডিউটি করতেন। নিজের খরচের যৎসামান্য টাকা রেখে বাকি টাকা দেশে পাঠাতেন। যে ঋণ নিয়ে বিদেশ এসেছে তা পরিশোধ করার আগ পর্যন্ত যেন কোনো নিদ্রা ছিল না। শুধু কাজ আর কাজে ডুবে থাকতেন। নিজের শরীরের দিকেও তাকাতেন না।
পরদেশে অনেক কষ্ট করে আয়-উপার্জন
এক দেশের ছেলে আরেক দেশে অনেক কষ্ট করে আয়-উপার্জন করে। দেশে থেকে বুকে কষ্ট নিয়ে বাইরে যায়, আবার আশা-স্বপ্ন পূরণ না হলে কষ্ট নিয়ে ফিরে। অনেকে সুস্থ অবস্থায় বিদেশে গিয়েও অসুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরে। যে কষ্ট করেছে পরিবারের জন্য, প্রিয়জনদের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য; তার সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য কে কী করেছে? অথচ কত বন্ধনইতো মিশে আছে জীবনের ধাপে ধাপে।
প্রবাসী শ্রমিকদের মূল্যায়ন দরকার
প্রবাসী শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা দরকার। সম্মান দেখানো দরকার। শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা থাকা দরকার। প্রবাসীদের ছোট করে দেখার মানসিকতা বদলানো দরকার। প্রবাসীরা দেশকে মনে রাখে, দেশের মানুষকে ভালোবাসে। তাইতো রাত-দিন পরিশ্রম করে। দেশের প্রতি, মাতৃভূমির প্রতি, দেশের মানুষজনদের প্রতি তাদের টান থাকে তীব্র।
দেশের মাটির গন্ধও তারা শুকতে পায়। খেটে খাওয়া মানুষদের দেখে। আহারে কী নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম! আপন মানুষগুলোর হাসিমুখের জন্য অপেক্ষা করে এবং অন্যকেও করতে দেখে। সন্তানের পড়াশোনার খরচ, বৃদ্ধ মা-বাবার ওষুধের খরচ সবকিছুর কথাই মাথায় গেঁথে থাকে। কাজ করতে করতেই মনে মনে করেন দেশের আলো-বাতাস ও পথ-ঘাটের কথা। নাড়ির টান গাঢ়ভাবে অনুভব করেন। ভালো কিছু নিয়ে নাড়ির কাছে ফেরার কথা ভাবেন।
নিজের দেশে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায়, যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাওয়া যায়। আর অন্যদেশে ক্লান্তিতে আশ্রয় নিতে কেউ আঁচল বিছিয়ে দেয় না। হতাশ লাগলে হতাশা দূর করার চেষ্টা করে না। ভয় আছে, গ্লানি আছে, অতৃপ্তি আছে আর অশান্তি আছে। নিজের শান্তি বিসর্জনের মধ্যেও থাকে গাঢ়-গভীর মমতাবোধ।
দেশ-দশের কথা মাথায় রেখে রাত কী দিন না ঘুমিয়ে যারা কাটান, তাদের যথাযথ সম্মান নেই। মাথা গুঁজে দাঁড়ানোর মতো সাপোর্ট নেই। তারা না ঘুমিয়ে, সময়মতো না খেয়ে, ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে কাজ করে যায়। তারা তখনই সুখ পায় যখন প্রিয় মানুষদের কিছু দিতে পারে। প্রিয় মানুষরা আনন্দ পেলে, সুখে আত্মহারা হলে প্রবাস জীবনকে সার্থক মনে করে। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা, স্ত্রী-সন্তানের ভালোভাবে জীবন কাটানেকেই বড় পাওয়া মনে করে।
প্রবাসে কেন যায় শ্রমিকরা?
প্রবাসে কেউ নিজের সুখের জন্য যায় না। অন্যের সুখটা দেখার জন্য যায়। তাইতো প্রবাসীরা প্রবাসে কাজ করতে গিয়ে অবহেলাও সহ্য করে। আত্মসম্মান বোধ ত্যাগ করে কাজ করে। প্রবাসীদের শুধু একটা ভাবনাই থাকে, মা ভালো আছে তো! বাবা ভালো আছে তো! সন্তানরা ভালো আছে তো! এই ভাবনার কারণে যত কষ্টই হোক না কেন অক্লান্ত পরিশ্রম করে উপার্জনে সচেষ্ট থাকে।
তারা বুকে পাথর চাপা দিয়ে কাজে নেমে যায়। কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। পরিবারের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন থাকায় কোনো ক্লান্তি-ক্লেদ-তৃষ্ণা থাকে না। ভাবনাটা থাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে, বিদেশে আসার খরচ তোলতে হবে। পরিবারের জন্য কিছু নিয়ে দেশে ফিরতে হবে।
হাড়ভাঙা পরিশ্রমী খেটে খাওয়া মানুষ
প্রবাসীরা কখনো দেশের কথা ভোলে না, দেশের মানুষের কথা ভুলতে পারে না। আপনজনদের দেখা পাওয়ার জন্য দেশে ফিরে আসতেই হয়। মা, মাটি, দেশ, মমতা তাকে টানে। গ্রামের মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি তাকে টানে। পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে। নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়। বুকের মধ্যে বাজতে থাকে- এটা তোমার দেশ না, তোমার দেশ বাংলাদেশ।
বিদেশে লোকচক্ষুর লজ্জা আড়াল করে যে কোনো কাজ করতে হয়। একজন প্রবাসী অন্যের বাসাবাড়ি দেখাশোনা থেকে শুরু করে সুইপারি পর্যন্ত করে। দেশে যে কাজ সমাজ অবহেলা-অনীহার চোখে দেখে, একই কাজ বিদেশে লজ্জা থাকে না। অথচ কষ্ট করে অর্থ উপার্জনে লজ্জা থাকা নিচু মনমানসিকতা।
যে কোনো বিবেচনায় দেশ ও স্বজনদের দূরে রেখে প্রবাসজীবন খুব স্বস্তির নয়। কারো কারো কাছে বেঁচে থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। অধিকাংশের কাছে প্রবাস মানে নিঃসঙ্গতা! একাকিত্ব! ফেলে দীর্ঘনিঃশ্বাস! প্রবাসী মানে হাড়ভাঙা পরিশ্রমী একদল খেটে খাওয়া মানুষ। যদিও অল্প কিছু প্রবাসীর কাছে প্রবাস মানে- রোমাঞ্চকর, অতিমাত্রায় স্বাধীনতা।
প্রবাসী সম্পর্কে অপ্রবাসীদের ধারণা
প্রবাসী সম্পর্কে অপ্রবাসীদের ধারণা পুরোটাই অর্থকেন্দ্রিক। স্বজনেরাও ভাবে- প্রবাসী মানেই অঢেল অর্থ উপার্জনের কারিগর। আসলে প্রবাসীদের রকমফের আছে। প্রবাসীদের যাত্রা ভিন্ন ভিন্ন কারণে। কেউ যায় অর্থ উপার্জনের জন্য। কেউ যায় উচ্চশিক্ষার্থে। এদের কেউ দীর্ঘমেয়াদি। আবার কেউ স্বল্প সময়ের জন্য।
কেউ স্থায়ী। কেউ অস্থায়ী। এদের অনেকেই দক্ষ। অনেকে অদক্ষ। ফলে সবার জীবন একই রকমের হয় না, আয়-রোজগারও একই রকমের হয় না। প্রবাসীদের কাছে দেশের মানুষের এত বেশি প্রত্যাশা থাকে যে তারা বাড়তি চাপ অনুভব করে এবং অধিকাংশক্ষেত্রেই নিজেদের দুঃখ শেয়ার করতেই পারে না।
প্রবাস জীবনে আকৃষ্ট হবার কারণ
দেখুন- শ্রমিকরা জানে প্রবাস জীবন কষ্টের। তারপরও দেশে আত্মকর্মসংস্থান করতে না পেরে, চাকরি জোটাতে না পেরে- ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমায়৷ প্রবাসে অনেকে নির্যাতিত হয়। বঞ্চিত হয়। পরিবারে সুদিন ফেরানোর আশায় বিদেশে গিয়ে লাশ হয়েও ফিরেন অনেকে৷ অনেকের মৃত্যু স্বাভাবিকও নয়৷
অধিকাংশেরই মৃত্যুর কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ, কর্মক্ষেত্র বা সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা ক্যানসারের মতো জটিল কোনো রোগ৷ প্রবাসে একা থাকা, নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা, খারাপ পরিবেশে কাজ করা ইত্যাদি কারণে হৃদরোগ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অনেকের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে৷ এসব দেখেও প্রবাস জীবন বেছে নেয়- অপেক্ষাকৃত ভালো কিছু করার চেষ্টা হিসেবে!
প্রবাসী নারী শ্রমিকদের জীবন
-ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়া প্রবাসী নারী শ্রমিকদের জীবন আরো কঠিন৷ বৃদ্ধ বাবা-মা, বেকার, ঋণগ্রস্ত স্বামী বা প্রিয় সন্তানের জন্য বহু দূরের অচেনা দেশে যান৷ দৈনিক ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও অনেকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক পান না৷ শারীরিক, মানসিক নির্যাতন তো আছেই, যৌন নিপীড়ন, এমনকি ধর্ষণের শিকারও হন অনেকে৷
নিয়োগকর্তা স্বজনহীন পরিবেশে অসহায়ত্বের সুযোগে নারীদের দেহ ব্যবসায় বাধ্যও করেন৷ অনেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রায় শুন্য হাতে দেশে ফিরেন৷ অতিরিক্ত কাজের জন্য বাড়তি পারিশ্রমিক চেয়ে নির্যাতনের শিকার হন। পরিবারে সুন্দর আগামী নির্মাণে ভূমিকা রেখে যাওয়া প্রবাসী নারী শ্রমিকের অধিকার পদে পদে ক্ষুণ্ন হয়৷