জীবন-জীবিকার গল্প : খাবার সরবরাহকারী
নিম্ন-আয়ের মানুষ মজিবর। ঢাকা শহরে টিফিন ক্যারিয়ারের ব্যবসা করেন। ক্ষুদ্র আয়ের লোকজনের অল্প খরচে মানসম্পন্ন খাবারের ব্যবস্থা করছেন বলে তিনি খুব আনন্দিত। বেঁচে থাকার তাগিদে ঢাকায় এসে অফিসে বাড়িতে তৈরি ফ্রেশ খাবার সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন।
প্রথমে শুধু অফিসে খাবার সরবরাহ করতেন। বর্তমানে বাসায়ও বাটিতে করে খাবার সরবরাহ করেন। দৈনিক খাবারের মেন্যুর মধ্যে থাকে ভাজি, মাছ আর ভাত। এসব খাবার রান্না করেন তার স্ত্রী। বাটি প্রতি যে লাভ হয় তার যোগফলে ভালোই কেটে যায় সংসার।
ক্লাউড কিচেন ব্যবসার আয় থেকে কর্মচারি ছয়জনকে টাকা দিতে হয়। গ্রামের বাড়িতেও বাবা-মাকে টাকা পাঠান। ঢাকায় ঘর ভাড়া ও নিজের সংসারের খরচ চালিয়ে মাসে তার কয়েক হাজার টাকা জমা থাকে। এভাবে ফুড সাপ্লাই করে টাকা জমিয়ে গ্রামে কিছু জমিও কিনেছেন।
দিনকাল কেমন চলছে?
ফুড হোম ডেলিভারি শুরু করার পর ভালোই কাটছে আলহামদুলিল্লাহ। আমার ছোটবেলা থেকেই রান্নার প্রতি একটু বেশি ঝোঁক ছিল। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। মাকে পরিবারে একসঙ্গে অনেকটা রান্না করতে হতো। মাকে পাশে থেকে অনেক সহযোগিতাও করেছি, রান্নার কাজে হাতও লাগিয়েছি। এখন সেই আগ্রহটা পূরণ হয়েছে। খুব আন্তরিকতা ও দরদ নিয়ে রান্না করি।
তাছাড়া আমার স্ত্রীও খুব ভালো রাঁধুনি। আমার শ্বশুর মশাই খুব ভালো রান্না করেন, এমনকি গ্রামে বাবুর্চি হিসেবে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। বিয়ে অনুষ্ঠানসহ সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে রান্নার জন্য অন্য দূর-দূরান্তের গ্রামেও ওনার ডাক পড়ে। ফলে রান্না-বান্নাটাকে আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ বলতে পারেন। বংশগতভাবেই বোধহয় রান্নার চর্চাটা পেয়েছি।
ভালো সাড়াও পাচ্ছি। যারা খাচ্ছেন তারা প্রশংসা করছেন। তাদের এই তৃপ্তি ও ভালো মূল্যায়নে আমরা এই ব্যবসায় আরো উৎসাহ পাচ্ছি। দিন দিন চাহিদা বাড়ছে, অর্ডার বাড়ছে। ফলে এখন দুজনে আর পারছি না। ছযজন কর্মচারিও নিয়োগ দিয়েছি। একটা বিয়ে বাড়িতে যেমন রান্না হয়, আমাদের প্রতিদিন সেরকম রান্নার আয়োজন করতে হয়। সবমিলিয়ে ভালোই লাগে।
এই ব্যবসায় কোনো সমস্যা হয়?
মাঝেমধ্যে কিছু খাবার অবশিষ্ট থেকে যায়, বিক্রি হয় না। তখন বাসার সবাই মিলে সেগুলো খেতে হয়। কিছু সমস্যাতো হয়। যেমন বেশি খাবার থাকলে অনেক নিজেরা খেয়েও ফুরানো যায় না। তখন অবশ্য খাবার নষ্ট না করে অসহায়-ক্ষুধার্তদের মাঝে বিলিয়ে দেই। ফরে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুব সমস্যা হয় না; তবে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষলে তখন একটু কষ্টই লাগে!
খাবার অতিরিক্ত হবার এই সমস্যাটা হয় নানা কারণে। যেমন কেউ অর্ডার করলেন, অর্ডার বাতিলও করলেন না; অথচ নিলেন না বা খেলেন না। কেউ অর্ডার করলেন, অর্ডার এমন সময় বাতিল করলেন; যখন শুধু বাজারই হয়নি, রান্নাও হয়ে গেছে। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশই টাকা ঠিকই দিয়ে দেন; কিছু আছে যারা মাস শেষে ঐ টাকাটা দেন না।
টাকা না দিলেও সুসম্পর্ক রাখার স্বার্থে, ক্ষতিটা মেনে নিতে হয়! কারণ এমন হতে পারে একজনের সাথে মনোমালিন্য বা কথাকাটাকাটি হলে সেই অফিসেই প্রবেশের অধিকার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মাস শেষে টাকা নেয়ার ফলে অনেক কাস্টমার টাকা না দিয়েই চলেও যায়। তাছাড়া প্রায় সময় মাদকাসক্তরা ও সন্ত্রাসীরা এসে খায়, কিন্তু খাওয়ার পরে টাকা না দিয়ে চলে যায়।
ঢাকায় যানজট ফুড সাপ্লাইয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। আমরা অর্ডার নিয়েছি অথচ খাবার দিতে পারিনি এমনটি যাতে না হয় সে ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকি। ট্রাফিক জ্যাম বিবেচনায় রেখেই সরবরাহ করি। যদি কখনো মনে হয় অর্ডার আমাদের সামর্থ্যের চেয়ে বেশি পড়ে যাচ্ছে বা খাবার ডেলিভারি চাহিদানুযায়ী সঠিক সময়ে দিতে পারব না; তাহলে অর্ডারই নেই না। সাধ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার যথাসময়ে দিতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেজন্যমোটরসাইকেলও কিনেছি।
এই ব্যবসা করতে গিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি জানতে চাই।
আমার অনুভূতি খুব ভালো। কারণ এখন আর কাউকে অফিসে দুপুরের খাবার নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয় না। আগে হোটেলের অপরিচ্ছন্ন খাবার খেয়ে প্রায়ই অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। অফিস লাঞ্চের জন্য স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু খাবার পেয়ে অনেকেই তাদের চাহিদা ও তৃপ্তি মেটানোয় খুশির কথা আমাদের জানিয়েছেন।
অফিসে বসে বাড়ির তৈরি ফ্রেশ খাবার খেতে পেয়ে অনেকেই বলেছেন- মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ পাচ্ছেন। এটি আমাদের আনন্দ বাড়ায়! একদিকে ভেজালের শহরে শতভাগ মানসম্পন্ন ও রুচিসম্মত সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করছি। অন্যদিকে নিজেদেরও দুচার পয়সা আয় হচ্ছে আবার কয়েকজনের কর্মসংস্থানও হয়েছে।
ব্যস্ততম নগরজীবনে রান্না করে খাওয়া অনেক সময়ই বিরাট ঝক্কির কাজ। যারা বাড়িতে থেকে অর্ডার করছে, তাদেরকেও পৌঁছে দেয়ায় বাড়িতে বসেই খেতে পারছেন আমাদের খাবার। কর্মজীবী মায়েদের দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব হয়েছে। সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্তি চেপে ধরে রান্না করতে হচ্ছে না, বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অনেক মেসেও বুয়া নিয়মিত আসে না, ফলে ছেলে-মেয়েরা কষ্ট করে। এমন কয়েকজনকেও আমরা খাবার সরবরাহ করেছি।
যেহেতু আমরা সততা ও নিষ্ঠার সাথে খাবার তৈরি করি এবং টাটকা ও তাজা মাছ, শাক-সবজি ও উন্নতমানের চাল দ্বারা ভাত রান্না করে লাঞ্চবক্স এর মাধ্যমে হাতে পৌঁছে দেই; কখনোই বাসি খাবার তথা একদিনের খাবার অন্যদিন পরিবেশনা করি না। সেহেতু আমরা এই ব্যবসা নিয়ে আশাবাদী।
আপনি ব্যবসার অর্ডারগুলো কিভাবে নিচ্ছেন এবং কিভাবে সরবরাহ করছেন?
প্রথম দিকে নিজের বাড়িতে রান্না করে তা নিজেই সরবরাহ করতাম। বর্তমানে খাবার প্রস্তুতে আরো দুটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছি। সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করেছি। ভবিষ্যতে ব্যবসা বড় হলে এটা আরো উন্নত করার ইচ্ছা আছে। কারণ মানুষ এখন ঘরে বসে ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতেই বেশি পছন্দ করছে।
বর্তমানে আমরা কমপক্ষে ৫ প্যাকেট খাবারের অর্ডার নিয়ে থাকি। অর্ডার অবশ্যই ২৪ ঘন্টা আগে করতে হয়। দুপুর ১.৩০ এর মধ্যে খাবার সরবরাহ করা হবে। লেনদেন এর পদ্ধতি ক্যাশ অন ডেলিভারী; তবে যেসব অফিসে চুক্তির ভিত্তিতে প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ করি তাদের ক্ষেত্রে এবং কিছু নিয়মিত গ্রাহককে মাস শেষে একসাথে পরিশোধেরও সুযোগ দিয়ে থাকি । অর্ডার অনুযায়ী আমাদের ডেলিভারির লোকজন হাজির হয়ে যায় নির্দেষ্ট ঠিকানায়।
চার বছর ধরে আপনি এই ব্যবসায়। ইতোমধ্যেই সুনাম ও আস্থা বেশ বেড়েছে। এর পেছনের কারণ কী?
খাবারের মান ভালো। সঠিক দাম রাখি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার সরবরাহ করি। কখনো খারাপ ও বাসি খাদ্য দেই না। ভালো মানের মসলা ব্যবহার করি। ভালোভাবে রান্না করি। রান্না ও পরিবেশনের সব উপকরণ পরিস্কার রাখি। সরবরাহে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিই। আমরা খাবার প্রস্তুত ও প্যাকেজিংয়ে স্বাস্থ্যবিধি (হাইজিন) মেনে চলি।
তাছাড়া অর্ডারকারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করি। যোগাযোগ রাখি। ফলে এখন অনেকেই বাসায় রান্না বাদ দিয়ে আমাদের কাছ থেকে খাবার কিনেও খাচ্ছেন। পরিবার ছাড়া কাজের সূত্রে একা থাকেন এমন অনেকেও জন্যও আমাদের কাছ থেকে খাবার নেয়াকে সুবিধাজনক মনে করছেন। আমরাও সময়মতো খাবার গ্রাহকের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে সচেষ্ট থাকি। প্রত্যেকদিন আলাদা মেন্যু দিয়ে আমরা অফিসে খাবার সরবরাহ করার চেষ্টা করি।
একজনের অর্ডার যেন কোনোভাবেই আরেকজনের কাছে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখি। ফোনকল রিসিভ করার জন্য সার্বক্ষণিক কেউ না কেউ সক্রিয় থাকি।যারা কাজ করে সেসব কর্মীদের সুস্থতাকেও গুরুত্ব দেই। ফলে তারা নিজ নিজ কাজে মনোনিবেশ করে এবং আরো ভালো কাজ করতে সচেষ্ট থাকে।
শুরুতে আমরা পাড়ায়-মহল্লায় পোস্টারিং, দেয়াললিখন করেছি। অফিসে লিফলেট বিলিও করেছি। আলহামদুলিল্লাহ এখন অনেকেই জেনে গেছে, কিছুই না করেও গ্রাহকের অভাব হচ্ছে না। একজন গ্রাহক সন্তুষ্ট হলেই তার মাধ্যমে অনেক গ্রাহক আসে। আর আমরা খাবারের মানের ব্যাপারে কখনোই আপস করি না। ফলে একবার কেলে গ্রাহক দ্বিতীয়বার আগ্রহী হয়। খাবারের মূল্যও ক্রেতার সাধ্যের মধ্যে রাখোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।
ক্যাপাসিটি না বাড়িয়ে অর্ডার বাড়ালেতো হবে না, অর্ডার পেয়ে রাখতে না পারলে বা সার্ভিসের কোয়ালিটি খারাপ হলে তা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হয়; সেজন্য ব্যাপক প্রচারণায় যাচ্ছি না। তবে ভবিষ্যতে ব্যবসাকে আরো বড় করার জন্য ইচ্ছে আছে ফেসবুকে প্রতিষ্ঠানের নামে একটি পেজ খুলে প্রচারণা চালাবো।
এই ব্যবসায় কেন এলেন?
ঢাকায় এসে আমি একটি মেসে উঠলাম। সেখানে বেশ কয়জন চাকরিজীবী ছিলেন। আমি খেয়াল করলাম- মেস থেকে খাবার বহন করে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কি পোহাতে চান না আবার প্রতিদিন দুপুরের খাবারটা অফিসে সারতে গিয়ে নানা অসুখ-বিসুখে আক্রান্তও হন। দুপুরে খাবারের সময় অস্বাস্থ্যকর ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া কিংবা রেস্টুরেন্টে খেয়ে বড় অংকের টাকা গচ্চা দেয়ায় তাদের অস্বস্তি ও অশান্তি বুঝতে পারি আলাপ-আলোচনা শোনে। বেশি গরমে খাবার নষ্টও হয়ে যায়। এসব সমস্যা সমাধানের চিন্তা থেকেই মনে মনে এই ধরনের ব্যবসার প্রতি আগ্রহ জাগে।
আমি সেসব মেস মেম্বারদের সাথে আলাপ করলে তারা পরামর্শ দেন এবং আগ্রহ দেখান। আমি বউকে ঢাকায় নিয়ে আসি। যা পুঁজি সঞ্চয় ছিল সব ব্যয় করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে শুরু করি। কেউ দিন চুক্তিতে, আবার কেউ মাস চুক্তিতে খাবার নিতে শুরু করেন। বেশ কিছু মেসে এবং অফিসে খাবার সরবরাহ শুরু করি। ভালোভাবেই সবাই গ্রহন করে। বাসায় রান্না করি বলে হোটেলের তুলনায় আমাদের খাবারের মান ভালো এবং দামও কম। যে কারণে অনেক বড় বড় স্যারও আমাদের কাছ থেকে খাবার নিতে থাকে। প্রথমদিকে গ্রাহক ছিল কম। আল্লাহর রহমতে দিন দিন গ্রাহক বাড়তে থাকে। অফিসে অফিসে খাবার পৌঁছে দেয়ার জন্য সহকারীও রাখতে হয়। পরে এই ব্যবসাতেই লেগে আছি।