আনিসুর রহমান এরশাদ
ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাসের আতঙ্কে কাঁপছে পৃথিবী। ৩৪ লাখ ১৫ হাজার ২৩৭ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৮২৩ জনের। আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকার আশায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২০ লাখ ৮৮ হাজার ২২৪ জন। মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে ৫১ হাজার ৩১২ জন, যাদের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। ২১২টি দেশে থমকে গেছে মানুষের কর্মচাঞ্চল্য। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বদলে যাচ্ছে চিরচেনা পৃথিবীর চেহারা। বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর পুরনো নিয়ম-কানুন। দেশে-দেশে মানুষের জীবন-যাপনের প্রণালীও বদলে যাচ্ছে। চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে পরিবার। বদলে যাচ্ছে পারিবারিক জীবন। স্বাস্থ্যসেবার ধরন বদলে গেছে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন গৃহবন্দী জীবন যাপনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এটি মানুষের জীবনযাত্রা পুরোপুরি উলটপালট করে দিয়েছে। লকডাউনে সামাজিকতা বিমুখ হয়ে অনলাইন নির্ভরতাও বাড়ছে। পেশাজীবী অনেক নারী-পুরুষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেরে ফেলছেন তাদের অফিসের যাবতীয় কাজ। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘর থেকে রুটিন মেনে নিজ নিজ পেশার দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে নিচ্ছেন তারা। আচমকা বদলে গেছে সবার জীবন। উপার্জন বন্ধ হওয়ায় অথই সাগরে পড়ছে বহু পরিবার, বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনধারা। বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনের গল্প। জমা হচ্ছে একের পর এক বেদনাগাথা। করোনার ভয়ে পাশে থেকে সমবেদনাও জানাতে পারছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শরীর ও মন। কাজ বদলেছে, জীবনধারণ করছি ভিন্নভাবে, যোগাযোগ করছি অন্যরকম ধরনের, প্রত্যাশা করছি আরেকরকম! পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। আমাদের জীবনে এত অল্প সময়ে এত বদল খুব আশ্চর্যজনক। জীবন, জন্ম থেকে শুরু করে বিয়ে, মৃত্যু- সব কিছু পাল্টে গেছে। এতদিনের দৈনন্দিন জীবন আচরণ ভুলে থাকতে হচ্ছে সাবধান, করতে হচ্ছে বাঁচার চেষ্টা।
অবরুদ্ধ বাসিন্দাদের প্রাত্যহিক কাজেও পরিবর্তন এসেছে। নিত্যপণ্যের বাজারের জন্য অনেকে ঝুঁকেছেন অনলাইন শপের দিকে। বাড়ছে বহুমুখী বিপদ । জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে ও সংসার বাঁচাতে উপার্জনের নতুন উপায় খুঁজছেন। বদলে যাচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে জনতার সম্পর্ক, জনে-জনে সম্পর্ক, নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক, সামাজিক রীতি-নীতি, অভ্যাস-বদঅভ্যাস। করোনার বাধা উপেক্ষা করে মানুষের ঘরে সাহায্য নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে রীতিমতো সংগ্রাম করছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় কৃষক ও খামারিরা আছেন বেকায়দায়। অন্যদিকে জীবনের ছোটখাটো সাধারণ আনন্দ-খুশিগুলো নতুনভাবে অনুভূত হচ্ছে অনেকের জীবনে। স্বাভাবিক জীবনধারায় ছন্দপতন অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাজি রেখে যারা কাজ করছেন; তাদেরকেও চারপাশের অনেক মানুষ খারাপ ব্যবহার করছে। জীবনের শখ-আহ্লাদ পূরণের চেয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
অনেকের কাছে জীবন বড়, না জীবিকা বড়- এই প্রশ্ন উঠছে। প্রাণের ভয় ও আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে অসহায় হয়ে পড়া মানুষ যেন এক অন্ধগলিতে ঢুকে পড়েছেন, যা থেকে বেরনোর রাস্তা অজানা। স্বাভাবিকের সংজ্ঞাই যেনপাল্টে যাচ্ছে। দমবন্ধ অবস্থায় দুর্বল মনের মানুষ একেবারেই ভেঙে পড়ছেন। রাস্তায় কোনো মানুষ নেই, কোলাহল নেই। এই মৃত নগরী অনেকের কাছেই অচেনা মনে হচ্ছে। প্রাণ চঞ্চল যেই শহর দিনরাত সরগরম থাকতো; তা এখন যেন ভুতুর শহর! মানুষের ভবিষ্যৎ কী হবে? কত লোকের চাকরি যাবে? দিন আনে দিন খায় এমন মানুষ কিভাবে কী করবে? শ্রমিক পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে, অভাব তাদের গ্রাস করছে। কেউ স্বাস্থ্যবীমা পেয়ে খুশি, কেউ প্রণোদনা পেয়ে আনন্দিত, কেউ চুরি করে মজুদ করে উৎফুল্ল, নিম্ন আয়ের মানুষ ত্রাণ পেয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু মধ্যবিত্ত যাদের নেই সঞ্চয়, আছে ঋণের বোঝা, না পারে চাইতে, না পারে সইতে; তাদের অবস্থা বড্ড শোচনীয়! মানুষের জালে মানুষের ফাঁদে আটকে করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ।
অজানা যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য কতকিছুই করে যাচ্ছে সবাই। কেউ আতঙ্কিত, কেউ লড়াকু সংগ্রামী, কেউ জীবন বাঁচাতে সচেষ্ট- উদ্বিগ্ন সমগ্র মানবজাতি। দেশে দেশে লকডাউন ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার ফলে ত্রাণকার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে বেশ কিছু স্বল্পোন্নত দেশ। চরম ঝুঁকিতে খাদ্য নিরাপত্তা। খুব দ্রুতই সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নিতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তাজনিত দিক থেকে অনেক জনপদ দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। বন্ধ হচ্ছে কর্মক্ষেত্র, বাড়ছে বেকারত্ব। সব মিলিয়ে এক মহামন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সহিংসতা, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এর থেকে রক্ষা নেই।
প্রাণঘাতী ভাইরাসটির আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুখবর এখনো মিলছে না। সুনির্দিষ্ট অগ্রগতির খবর পাওয়া যাচ্ছে না। গবেষকদের বিরামহীন সাধনার পরও করোনার এখনো টিকা বা ভ্যাকসিন মিলেনি, হয়নি কোনো সমাধান। অজানা যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চলছে। বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোতে করোনায় ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। দেশে দেশে লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। দিশেহারা হয়ে পরছে বিশ্ব। পরিস্থিতি মোকাবেলা নিয়ে বাড়ছে প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যকার কূটনৈতিক উত্তেজনা। সব মিলিয়ে অদ্ভুত আঁধারেই রয়ে গেছে বিশ্ববাসী।
ভাইরাসটিতে আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের। শুরুতে করোনা শনাক্তে চীন এগিয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রে চলে আসে ইউরোপ। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যের মতো দেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে করোনা মোকাবেলায়। তবে এপ্রিলে সব ছাপিয়ে শীর্ষে চলে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখনো দেশটিতেই করোনা শনাক্ত ও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। যা দেশটিতে অর্থনীতিতে এক বড় ধাক্কা দিয়েছে ও জনজীবনের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। করোনা নিঃশব্দে প্রভাব ফেলছে মনে, বদলে দিচ্ছে মানসিক গঠন, সব অঙ্গনেই সৃষ্টি করেছে স্থবিরতা।