‘এত কম বেতনে সংসার চলে না’

জীবন-জীবিকার গল্প : নাইট গার্ড

লাল মিয়ার বয়স ৫৫ বছর। পিয়ন কাম নাইট গার্ড।কেউ বলে সিকিউরিটি গার্ড। কেউ বলে নিরাপত্তা রক্ষী। কেউ বলে নিরাপত্তা কর্মী। কেউ বলে নৈশ প্রহরী। কেউ বলে নৈশরক্ষী। কেউ বলে নিরাপত্তা প্রহরী। যে যাই বলুক ২৫ বছর ধরে তিনি নাইট গার্ড। সারারাত জেগে জেগে পাহারা দেন, নির্ঘুম থাকেন, সজাগ থাকেন। অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা করতে পারেননি।

চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, তারপরও জীবন সংগ্রামের দৌড় চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগেও ৪টি প্রতিষ্ঠানে নাইট গার্ডের চাকরি করেছেন। এক স্কুলে তখন নাইডগার্ডের চাকরি করতেন। কিছু স্থানীয় বখাটে জোর করে রাতে ডুকে বসে আড্ডা দিতেন, মাদকের আসর বসাতেন। তিনি বাধা দিলে তাকে মারধর করতো। কর্তৃপক্ষকে অনেকবার বলেছেন, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে তিনি চাকরিটি ছেড়ে দেন।

পরে একটি মার্কেটে নাইডগার্ডের কাজ নেন। একদিন মুখোশ পড়া ৫/৬ জন দুর্বৃত্ত এসে তাকে একজন দোকানদারের নাম বলে নির্দিষ্ট দোকানটি দেখিয়ে দিতে বলে। কিন্তু সে দোকান দেখিয়ে না দেয়ায় তারা ক্রোধে ফেটে পড়ে। হঠাৎ তার হাত মুখ বেধে ফেলে। এরপর কয়েকটি দোকানে লুটপাট চালায়। পরে যাবার সময় তাকেও জাপটে গাড়িতে তুলে নিয়ে কিছুদূর যাবার পর হাত মুখের বাধ খুলে দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। শরীরে ব্যথা নিয়েই সে দৌঁড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত একজন দোকানদারকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। সে তার বর্ণনা শুনে শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকার পরও তাকেই উল্টো অবিশ্বাস করে। সে নিজেই একাজ করে বাঁচতে গল্প বানিয়েছে বলে সন্দেহের তীর ছুড়ে।  পরে বিচার-সালিশ হয়। তার কথা কয়েকজন বিশ্বাস করে বলে কয়েকজনের দাবিকৃত জরিমানা তাকে দিতে হয়নি। তবে এভাবে চুরির অপবাদ ওঠায় তার মন ওঠে যায় এবং চাকরিটি ছেড়ে দেন।

এরপরে শহরে চলে যান এবং একটি কারখানায় নাইটগার্ডের কাজ নেন। সেখানেও এক দুর্ঘটনা ঘটে। একদিন অসুস্থতার কারণে তিনি রাতে ডিউটি করতে পারেননি। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন ল্যাপটপ, কম্পিউটারসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র চুরির ঘটে। তিনি তার রিপোর্টিং বসকে অসুস্থতার খবর দিয়েছিলেন এবং ডিউটি করতে পারবেন না জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অফিসার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেননি। পরে যখন এই চুরির ঘটনা ঘটে তখন নিজের দায় এড়াতে তিনি তার অসুস্থতা ও ছুটিতে থাকার খবর সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন  এবং চুরিতে তার যোগসাজশ থাকতে পারে বলে আশংকা করেন। পরদিন অফিসের কয়েকজন লোক তার বাড়িতে গিয়েও তাকে অসুস্থ দেখতে পান। অথচ তাকে এই ঘটনায় চাকরিচ্যুত করা হয়।

এরপর তিনি নাইটগার্ডের চাকরি না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার এলাকার পরিচিত একজনের মাধ্যমে আবার নাইটগার্ডের চাকরি হয়। সেখানেই প্রথমে একটি মালের গোডাউনে কাজ করেন। এরপর একই মালিকের আরেকটি কারখানায় তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এবং ১৫ বছর ধরে তিনি এখানেই আছেন। তবে এখানে রাতে ডিউটিরত অবস্থায় আগের মতো কোনো সমস্যা মোকাবেলা কর হয়নি। এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। নাইটগার্ড হিসেবেও দায়িত্বপালন করে তিনজন। সপ্তাহে একদিন ছুটিও পান। দুই ঈদে বোনাসও পান। ভালোভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে।

২৫ বছর ধরে নাইটগার্ডের কাজ করছেন? কেমন লাগছে?

গরিবের আবার ভালো। মোটামুটি চলে যাচ্ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়েপরে বেঁচে আছি। প্রথম দিকে একটু বেশিই খারাপ লাগতো। আর এখনতো কোনোই সমস্যা হচ্ছে না। এখানকার পরিবেশও ভালো। যাদের সাথে কাজ করি তাদের মনমানসিকতাও ভালো। আগে যেসব জায়গায় ছিলাম, যেমন ছিলাম তারচেয়ে ভালোই আছি। বেতন কম হলেও বছর বছর কিছু বেতন বাড়ে।

আগে যেসব দুর্ঘটনার কথা বললেন। সেগুলো মনে পড়লে ভয় লাগে না?

মনে পড়লে ভয় তো একটু লাগেই। যারা সন্ত্রাসী বা ডাকাতি করে তাদের কাছে ধারালো অস্ত্র থাকে। মুখে বাশি আর হাতে লাঠি নিয়েতো আর তাদের মোকাবেলা করা যায় না। দুর্বৃত্তদের অপকর্ম করতে বাধা দিলে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে, মেরে গুরুতর আহতও করে। চাঁদা না দিলে মারপিট করে। এসবের চেয়েও বড় সমস্যা এত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার পরও- কোনোভাবে কোনো চুরি হলে, কোনো উপায়ে কিছু হারানো গেলে নাইটগার্ডকে সন্দেহ করা হয়।

যা বেতন পান তাতে সংসার ঠিকঠাকমতো চলে?

না ভাই। ডিউটি শুরু হয় রাত ১২টায়, শেষ হয় সকাল ৮টায়। রাত জাগার কষ্টের বিনিময়ে পারিশ্রমিক খুব সামান্যই। এত কম বেতনে সংসার চলে না। জীবন নির্বাহ করাই কঠিন। এরপরও বেঁচে থাকতে পাহারা দেয়ার কাজ করতে হয়। যখন তরুণ-যুবক ছিলাম তখনই অন্য ভালো কাজ পাইনি। আর এখনতো বয়স হইছে। বাধ্য হয়েই এই কাজ করতেই হয়, উপায় নেই। তবে সৎ পথে রোজগার করছি, এটাই সান্ত্বনা।

রাতভর জেগে ডিউটি করার পর সংসারের খরচ মেটাতে দিনে একটি চায়ের দোকানও চালাই। রাইতে ডিউটি করে যে টাকা পাই তাতে চললেতো দিনে অতিরিক্ত রোজগারের আশায় চা বিক্রি করতে হইতো না। আবার দিনে চা বিক্রি করে যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চললেতো আর নাইট গার্ডের কাজ করতে হতো না। নাইট গার্ডরা গরিব মানুষ, বেতন বাড়াতে বেশি বললে চাকরিই থাকবো না। মালিকরা ইচ্ছে করে যতটুকু বাড়ায়, তাতে ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না।

অথচ নাইট গার্ডদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। রাইত বিরাইতে কোনও ঝামেলা হইলে তাদের সামলাইতে হয়। সারারাত সতর্ক থাইকতে হয়। কোথায় কিছু হলে সবার আগে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়। আবার চোর-ছিনতাইকারীরা মোকাবিলায় সবার আগে যেতে হয়। হামলার শিকার হতে হয়। অথচ সুযোগ-সুবিধা বলতে তেমন কিছু পাওয়া যায় না।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *