জোনাকীর মত টিকে থাকার চেয়ে সূর্যের মত শক্তিশালী হওয়ার প্রচেষ্টা চালানোতেই সার্থকতা। সিংহের গর্জন দিতে গিয়ে বীরের বেশে যদি মরণকে হাসিমুখে বরণ করতে হয় তাতেও কল্যাণ। কিন্তু মহিষের মত টিকে থাকাতেও মানসিকভাবে তৃপ্ত থাকাটা অযৌক্তিক। কোনোরকম মূল্যহীনভাবে গ্লানি মেখে টিকে থাকার চেয়ে সম্মানের সাথে জীবনাবসান ঘটলে তাও মেনে নেয়া যায়। মিটিমিটি জ্বলার চাইতে সমূলে বিনষ্ট হওয়াকেই গ্রহণযোগ্য বলছি না তবে সৃষ্টিতেই আনন্দ।
আমি অবশ্য আঁধমরা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাকে ভীষণ সুখের মনে করি। যাদের বিশ্বাস অতি দুর্বল, খুব সহজেই অন্য কোনো ব্যক্তি বা ভিন্নরকম ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন তাদের মৌলিকত্ব নেই। নিজস্ব কিছু না থাকলে পরনির্ভরশীল হয়ে মুক্তবুদ্ধির অধিকারী চিন্তাশীল হয়ে গড়ে উঠা যায় না। স্বকীয়তার বিনির্মাণ না হলে মূল্যায়ন থাকে না। বড় যারা হয় তাদের সিদ্ধান্ত বেশ ভারী হয়। তাই কারা সাহসী , আত্মবিশ্বাসী ও বাঁধা বিপত্তিতেও টিকে থাকার মত সংগ্রামী তা যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হয়।
তার মানে অনাকাক্সিক্ষত কোনো প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ঘোলাটে করা নয় বরং পরিবর্তণশীল পরিবেশের সাথে খাঁপ খাইয়ে চলার শক্তি সামর্থ্য বিবেচনা করা দরকার। চিন্তার মূল্য যেই বুঝে যে চিন্তাশীল। চিন্তার মূল্য খাঁটি স্বর্ণের মূল্য বুঝার মত সবাই বুঝবে ব্যাপারটি এমন নয়। তবে হ্যাঁ মূল্য বুঝলেই যে সবাই মূল্যায়ন করবে এটা আশা করা যায় না । কেননা এটা নির্ভর করবে সম্পূর্ণ মানসিকতার উপর। যার মন-মানসিকতা, রুচিবোধ ও জ্ঞানের গভীরতা যেমন সে অনুযায়ীই সে সবকিছুকে বিচার করে। তাই সম্মানজনক জীবন গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পরিকল্পিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই এটা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়।
সাময়িক প্রাপ্তির আনন্দ নয়; ভবিষ্যতকে ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। অদৃশ্য কোনো শক্তি মানুষের, মানব সমাজের কিংবা প্রকৃতির যে ক্ষতি করেছে তার চেয়ে মানুষ নিজেই নিজের অকল্যাণ বয়ে এনেছে প্রচুর। যা কিছু স্বাভাবিক, সাধারণ ছিল তাকে প্রভাবিত করতে গিয়ে, নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অনেক সরলতাকে জটিলতায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। বিজয়ের স্বাদ যেন পরাজয়ের তিক্ততাকে ত্বরান্বিত করেছে। যা সাধারণ বাস্তবতা ছিল তা অস্বাভাবিক বাস্তবতাকে হাজির করেছে। স্বাভাবিক অনেক কিছুই অস্বাভাবিকরূপে বিদ্যমান থাকছে। সরল-সহজভাবে জগৎটাকে আর চেনা যাচ্ছে না।
জগতের প্রকৃতরূপের সন্ধান পাওয়া, সত্যিকারের চেহারাটা বুঝাটা দুঃসাধ্য যেন। সাধারণ স্তরের বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের পক্ষে জটিল জগৎটাকে বুঝাটা অসম্ভব হয়ে ওঠেছে। নব নব চিন্তা, নতুন নতুন জ্ঞান, উৎকৃষ্ট কাজের ব্যবহারে উৎকৃষ্ট সৃজন চিন্তন প্রক্রিয়ায় জটিলতা বাড়াচ্ছে, বিদ্যমান বাস্তবতাকে পরিবর্তিত রূপ দিচ্ছে সমাজকে পেঁচিয়ে দুর্বোধ্য করে ফেলছে। অনেক কিছুই মুখোশে ঢাকা। সাদাচোখে দৃশ্যমান অনেক কিছুই আসল রূপ প্রকাশ করে না। ফলে নানা অবিশ্বাস, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয়-সন্দেহ জন্ম নেয়।
সরলতার মানেই প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া হৃদয়গুলো আজ কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ। মানুষ তার সীমাবদ্ধতাকে ভাবনায় আনেনি দুর্বলতা প্রকাশ পাবে বলে। নব সৃষ্টির আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে এর প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল কী হবে তা ভাবে নি। অনেক সৃষ্টির আনন্দ আজ বেদনার মহাসাগর খনন করছে। মেধা, শ্রমের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া বাস্তবতা মানবতাকে ধ্বংসের ‘দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। মানুষ সহজ-সরল পথেই দুঃসহ এক অনাকাক্সিক্ষত বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।