কলম্বিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বারবোসা শহরে আট বছর বয়সী বালিকাদের সুন্দরী প্রতিযোগিতা লিটল মিস থং নিয়ে অনলাইনে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ‘শিশুদের প্রতি অবমাননা’ ‘যৌনবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়া’ এর অভিযোগ উঠেছে। কেউ কেউ এটি পুরোপুরি বলেছে নারী অধিকারের লঙ্ঘন, কেউ কেউ বাবা-মায়েরা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
‘বিকিনি প্রতিযোগিতা’ থেকে শুরু করে সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে: সুন্দরী প্রতিযোগিতা কি নারীকে পণ্য হিসেবে তুলে ধরছে? এই পোশাককে ‘অভদ্র’ বিবেচনা, পরিধানকারীদের ‘বেহায়া’ তকমা দেয়ার মানষের অভাব নেই। ‘মিস ইউনিভার্স’ ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ ‘মিস আর্থ’ মিস ইন্টারন্যাশনাল’ এসব কী নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যম হতে পারে? অবশ্য ঘরের বাইরে নিয়ে আসায় আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে বলেও বিশ্বাস করেন কেউ কেউ৷ তবে বাস্তবে বিনোদনের খোরাক হিসেবেই উপস্থাপিত হয়ে থাকে।
সেরা সুন্দরী বাছাই করতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর উচ্চতা, শারীরিক গঠন, এমনকি গায়ের রং কেমন হবে তারও একটি মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়া হয়৷ এ ধরনের প্রতিযোগিতা নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিচার করে, যা সমাজে নারীর সৌন্দর্যের একটি মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়৷ ফলে, এই মাপকাঠি যাঁরা উৎরাতে পারেন না, তাঁরা হীনমন্যতায় ভোগেন৷ আর যারা সেই মাপকাঠিতে পৌঁছাতে চান, তাঁরা সেটা করতে গিয়ে সময় এবং অর্থ দু’টোই খরচ করে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবসা বাড়ান৷ কসমেটিকস ইন্ডাস্ট্রি এবং পোশাক ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির প্রসার ঘটে।
সুন্দর ফিগারের অধিকারী হওয়া সুন্দরী প্রতিযোগিতার অন্যতম পূর্বশর্ত অর্থাৎে সৌন্দর্যই মুখ্য। সুন্দরী প্রতিযোগিতার ক্রাইটেরিয়াগুলো দেখলেই দেখা যায় স্তনের মাপ, উচ্চতা, ওজন,বক্ষ আর অধোদেশের মাপ, কোমরের মাপ, দিয়ে মাপা হচ্ছে সৌন্দর্য। এই মাপগুলোর ভিত্তিতে পরষ্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কতটা মর্যাদাসম্পন্ন!কৌমার্য না থাকলে তিনি বিশ্ব সুন্দরী হতে পারবেন না!‘নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলি করি অপমান’। মানুষের সৌন্দর্য তার স্তন ও কোমরের মাপে নয়– তার মেধায়, মননে, চিন্তায়, চেতনায় ও আচরণে। মেধার চর্চা, মননের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা এবং সেজন্য চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা ছাড়া নারী-পুরুষ কারও মুক্তি নেই। ‘বিজ্ঞাপনের পণ্য’ হওয়া নারী স্বাধীনতা নয়!
তাছাড়া মুটিয়ে গেলে, বিয়ের কথা লুকালে , অন্তসত্ত্বা হলে, নগ্ন ছবি প্রকাশ রূঢ় ও উদ্ধত আচরণ, নিয়ম ভঙ্গ করায় বা অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়ালে খেতাব কেড়ে নেয়ার রেকর্ডও রয়েছে৷ এসবে স্পষ্ট হয় এসব স্বীকৃতি পরবর্তী জীবনে কতটা খারাপ প্রভাব ফেলে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় ভার্জিনিটির প্রশ্ন নেই, আছে ‘অবিবাহিত’ হতে হবে। কারণ বিবাহিত নারী ইতোমধ্যেই ‘একজন পুরুষের দখলে আছে’; আর অবিবাহিত হলে প্রত্যেকেই তাকে দখলের স্বপ্ন দেখতে পারে,অন্য সকল অবিবাহিত নারীর আইকন হতে পারে । পুরুষদের সামনে নিজেদের সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে ধরতে বাধ্য হন মেয়েরা।
আসলে এরা প্রত্যেকেই পুঁজিতন্ত্রের ক্রীড়নক। কর্পোরেট পুঁজিবাদে তুমি বিক্রি করবে নয় তুমি বিক্রি হবে। এখানে যে যত বেশি দামে বিক্রি হয় সেই তত বেশি মূল্যবান। পুঁজিবাদে শুধুই লাভ, কেবল সাপ্লাই আর ডিমান্ড। ভোগ আর ভোগ। এটি মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় না, ভোগ করতে শেখায়। যখনি আপনি বলবেন দামি ফোন কেন লাগবে? দামি গাড়িতে কী লাভ? ঐশ্বরিয়ার মতো সুন্দরী কেন হতে হবে? বারো শ টাকা দিয়ে পিৎজা কেন খাব? আটশ টাকা দিয়ে এক কাপ কফি খাওয়ার যুক্তি কী? ব্রান্ডের জুতো, শার্ট, প্যান্ট কেন লাগবে? যখন থেকে আপনি এসব প্রশ্ন করবেন তখন থেকে আপনি পুঁজিবাদের জন্য বিপদজনক! পুঁজিবাদ চিন্তাবিদ চায় না, চায় ক্রেতা, খালি কিনবে আর দরকার না থাকলেও কিনবে। কর্পোরেট বাণিজ্যের খপ্পরে ফেলতে দরকার হয় বিজ্ঞাপনের, সুন্দরী প্রতিযোগিতার ও মডেলের। নারীর শরীরকে পণ্য বানিয়ে পুঁজিতে রূপান্তরিত করে ব্যবসায়ীরা। ক্ষমতাবানকে বশীভূত করে ক্ষমতাবান হওয়া বা বেশি দামে বিক্রয় হতে পারলেই বেশি লাভ মনে করার মাধ্যমে নারীর প্রকৃত উন্নতি হবে না।
আসলে এসবের মাধ্যমে আমরা এগুচ্ছি না বরং পিছিয়ে পড়ছি। ছোট পা সৌন্দর্যের প্রতীক হওয়ায় চীনে শিশুবেলা থেকে মেয়েদের পরিয়ে রাখা হত লোহার জুতা। নাগাল্যান্ডে নারীর গলায় পরিয়ে রাখা হত লোহার বলয় যাতে তারা মরাল গ্রীবার অধিকারী হন। উনবিংশ শতকেও ইউরোপে সরু কোমর লাভের আশায় শিশুবেলা থেকে নারীকে লোহার জালির তৈরি করসেট পরিয়ে রাখায় অস্বাস্থ্যকর রকম সরু কোমর হত নারীর। বলা হত, পুরুষ যেন দুহাতের মুঠোয় একজন নারীর কোমর ধরতে পারে। ভাঙা গাল ও টোল সৌন্দর্যের প্রতীক হওয়ায় ঊনবিংশ শতকে মাড়ির দুটি দাঁত ফেলে দিতেন ইউরোপের নারীরা। এখন সার্জারির মাধ্যমে নারীকে সুস্তনী, নিতম্বিনী ও সুন্দরী করার প্রচেষ্টা নারীকে ‘মানুষ’ নয় ‘সুন্দর পুতুল’এ রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা মাত্র। যৌনাবেদনের উপর নির্ভর করে নারীর মূল্য নির্ধারণ মানেই নারী শিশুকে শেখানো – ‘তোমাকে হতে হবে ‘আরো ফর্সা, আরো সুন্দর,পুরুষের চোখে আরো আকর্ষণীয়।’