সাংবাদিকতায় মানুষের বদলে রোবট

আনিসুর রহমান এরশাদ

প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে সাংবাদিকতার চিরচেনা জগতকে। ডিজিটালাইজেশনের সম্ভাবনাকে স্মার্টলি কাজে লাগানো হচ্ছে। মাল্টিপ্লাটফরমের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে নয়া নয়া কৌশল বের করা হচ্ছে। কনটেন্ট পৌঁছাতে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত তৈরি হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বহু সংবাদ সংস্থার জন্য সংবাদ তৈরি করছে। নবীন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার মতো কনটেন্ট তৈরিতে মনোযোগ বাড়ছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে সাবস্ক্রিপশন ফি নেয়ার বিজনেস মডেল তৈরি হয়েছে। ‘নিউজ সাবস্ক্রাইব’ অপশন চালুর পদক্ষেপ দিন দিন বাড়ছে। মুদ্রিত সংবাদপত্র মারা গেছে, মারা যাচ্ছে। সাংবাদিকতা সেবায় পরিণত হচ্ছে।

স্বাধীন সাংবাদিকরা জনসাধারণের প্রয়োজন পূরণে সহায়তা করতে পারছে, পরিস্থিতির আলোকে সন্তোষজনক বিকল্প বেছে নিতেও পরামর্শ দিতে পারছে। সফটওয়্যার বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য খুঁজে এনে, সেই তথ্যের ধরন ও প্রবণতা বুঝে, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ব্যবহার করে সেই প্রবণতাকে প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে মিলিয়ে- বিশ্লেষণ, উপাধি ও রূপকসহ আধুনিক বাক্য গঠন করছে। অনেক সংবাদপত্রই গবেষকের বিশ্লেষণের পরিবর্তে সফ্টওয়্যার দ্বারা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করছে। এমন অবস্থায় ব্যয় কমাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে অনেক সাংবাদিকের চাকরিই বিপদের মুখে পড়ছে। ফলে আগামীতে এই খাতে দাপটের সাথে টিকে থাকতে চাইলে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

ভবিষ্যত সাংবাদিকতা বদলে যাচ্ছে যেভাবে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাংবাদিকতা বিদ্যমান সাংবাদিকতা শিল্পকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় সাংবাদিকতা পেশাটির মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। রোবট সাংবাদিকতার এমনভাবে উত্থান ঘটছে যে, এরা শুধু সংবাদ লেখবেই না উন্নততর বিশ্লেষণ যুক্ত করে গুণমানসম্মত স্মার্ট কনটেন্ট তৈরি করবে। সফ্টওয়্যারই সাংবাদিকতা ও মিডিয়া খাতে ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করবে। ইতোমধ্যেই সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) প্রায় ৩৭০০ কোম্পানির ত্রৈমাসিক আয়ের প্রতিবেদনগুলি সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করে নিবন্ধ তৈরি করতে অটোমেটেড ইনসাইটস সফ্টওয়্যার ব্যবহার করেছে ।

বুদ্ধিমান কম্পিউটার

বুদ্ধিমান কম্পিউটার যে শুধু প্রচুর ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে, তা নয়। এটি অনেক মানুষের ভিড় থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং তার সত্যতাও যাচাই করতে পরে। মিডিয়া আউটলেট ইতিমধ্যেই এআইয়ের মাধ্যমে ফ্যাক্ট চেক বা সত্যতা যাচাই করছে রয়টার্স। সামাজিক মাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ ট্র্যাক করতে এবং টুইটের সত্যতা যাচাই করতে তারা নিউজ ট্রেসার ব্যবহার করছে।

একজন সাংবাদিকের জায়গা কি একটি কম্পিউটার দখল করতে পারে? এটি সাংবাদিকতা পেশার ক্ষেত্রে একইসাথে একটি বড় উদ্বেগ আবার একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা হিসাবে দেখা দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত কম্পিউটার ও রোবটগুলি খুব শীঘ্রই মানুষের জায়গা দখল করবে না। তবে মিডিয়াতে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, অনেক কাজকেই সহজ করবে সফ্টওয়্যার, এদের সহায়তায় অল্প মানুষও বেশি কর্মীর কাজ করে ফেলবে। আরও ভালো কাজ করতে রোবট সহায়তা করবে।

স্মার্টফোন জার্নালিজম বা মোবাইল জার্নালিজম

স্মার্টফোন ব্যবহার করে সাংবাদিকতার ধারণাটি মিডিয়া ইন্ড্রাস্টিতে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও স্মার্টফোন ব্যবহার করে একজন গণমাধ্যমকর্মী কিভাবে দ্রুত সংবাদ প্রচারে এগিয়ে থাকতে পারেন সে বিষয়ে রীতিমতো পাঠদান হচ্ছে। একজন সাংবাদিকের স্মার্টফোন ব্যবহার করেই ফটোগ্রাফি, ছবি এডিটিং, ভিডিও জার্নালিজম, রেডিও সাংবাদিকতা, সংবাদ সম্পাদনা, তথ্যচিত্র তৈরি, ইনফোগ্রাফিস তৈরি, নিউজ লেখা, ই- মেইল করা, মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে কর্মস্থলে সংবাদ প্রতিবেদন-সাক্ষাৎকার পাঠানো, যার যার প্রতিষ্ঠানের ওয়েব সার্ভারে আপলোড করা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট-নিউজ শেয়ার করার সাংবাদিকতাই মোবাইল জার্নালিজম।

প্রতিনিয়ত মোবাইল জার্নালিজমকে সহজ করতে নতুন নতুন অ্যাপলিকেশন্স তৈরি হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতির সাথে সাংঘর্ষিক- এমন সংবাদ স্মার্টফোনের মাধ্যমেই ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ইন্টারনেট পোর্টেবলযুক্ত একটি মোবাইলসেট বা স্মার্টফোন সাধারণ নাগরিক থেকে হয়ে উঠতে পারেন এ সময়ের একজন ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট অর্থাৎ মুক্ত সাংবাদিক। ফ্রিল্যান্স জার্নালিজম থেকে প্রফেশনাল জার্নালিজম হয়ে উঠার সহজ ক্যারিয়ার। এই ক্যারিয়ারই পৌছে দিতে পারে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের একজন সফল গণমাধ্যমকর্মীতে।

রোবট সাংবাদিকতা

সাংবাদিকতাকে আমূল বদলে দেওয়ার মতো ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আছে। রোবট সাংবাদিকতা বিষয়টা সামনের দিনে জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠবে। নিজেদের এমএসএন ওয়েবসাইটের সংবাদ বাছাইয়ের জন্য সাংবাদিকের বদলে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া ব্যবহার করছে মাইক্রোসফট। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে চাকরি হারায়েছেন এমএসএন সাইটের খবর, ছবি ও শিরোনাম সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত সাংবাদিকরা। ব্যবসা মূল্যায়নের একটি অংশ হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এসেছে এমএসএন ওয়েবসাইটে।

প্রযুক্তিগতভাবে সামনের ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে জাপানের কর্মক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ কাজ করে দেবে রোবট। সাধারণ সাংবাদিক আর রোবট সাংবাদিকের কাজে তুলনা করে দেখা গেছে, রোবট সাংবাদিক জিয়াও ন্যানজিয়াও ন্যান অনেক বেশি বেশি তথ্য মনে রাখতে পারে। কপিও দ্রুত লিখতে পারে। তবে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নিতে শেখেনি। প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নিজে প্রশ্ন তৈরি করতে পারে না। নিউজ অ্যাঙ্গেল, অর্থাৎ কোনটা খবর সেটাও ধরতে পারে না। তবে রোবটও এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি ফুটবল ম্যাচে গ্যালারি ভরা দর্শকের আবেগ নিয়ে প্রাণবন্ত রিপোর্ট করতে সক্ষম।

সিটিজেন জার্নালিজম

স্বতস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত হয়ে গণমানুষের খবর ও তথ্য সংগ্রহ, পরিবেশন, বিশ্লেষণ এবং প্রচারে অংশগ্রহণের ফলে বাড়ছে সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা। যেকেউ আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর-তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, পরিবেশন, বিশ্লেষণ এবং প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। মালিক পক্ষের স্বার্থ, বহুজাতিক কোস্পানিসহ বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানে প্রভাবমুক্ত হওয়ায় এবং এজেন্ডা সেটিং এর ভূমিকা নেই। নির্দিষ্ট ভৌগলিক কোনো সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত নয়, নির্দিষ্ট ভাষাভাষির সকলেই বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসে তুলে ধরতে পারেন ঘটনা, জানাতে পারেন প্রতিবাদ কিংবা ঘোষণা করতে পারেন একাত্মতা।

সিটিজেন জার্নালিজমকে স্ট্রিট জার্নালিজম, পাবলিক জার্নালিজম, ডেমোক্রেটিক জার্নালিজম, পারটিসিপেটরি জার্নালিজম বলা হয়। এছাড়া গ্রাসরুট সাংবাদিকতা, নেটওয়ার্ক সাংবাদিকতা, ওপেন সোর্স সাংবাদিকতা, হাইপার লোকাল সাংবাদিকতা, বটম-আপ সাংবাদিকতা, স্ট্যান্ড অ্যালন সাংবাদিকতা, ডিস্ট্রিবিউটেড সাংবাদিকতা বলা হচ্ছে। এখানে প্রকাশিত অডিও, ভিডিও এবং প্রতিবেদন সম্পর্কে আগ্রহী যে কারো মতামত প্রদানের সুযোগ থাকে; যে কেউ মন্তব্য-বিতর্ক-আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। পেশাদার গণমাধ্যম কর্মী ছাড়া দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে অন্য কারো পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয় এ ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করেছে সিটিজেন জার্নালিস্টরা।

উদ্যোক্তা সাংবাদিকতা

কর্পোরেট জার্নালিজমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাজারে এসেছে উদ্যোক্তা সাংবাদিকতার ধারনা। সাংবাদিকতা শিল্পে আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অল্প পুঁজিতে তৈরি করছে অনলাইন পত্রিকা। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বৈশ্বিক তথ্যগ্রামে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন গণমাধ্যম। ঢুকে পড়েছি নাগরিক সাংবাদিকতার যুগে। কোনো এক নাগরিক সাংবাদিকের মুঠোফোনে তোলা ভিডিও চিত্র নিয়ে হৈচৈ পড়ে যাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। ফেসবুকের একটি স্টাটাস হয়ে উঠছে সংবাদপত্রের লিডস্টোরী। স্মার্টফোন ইউজাররাই হয়ে উঠছেন নতুন যুগের সাংবাদিক। কনটেন্ট নির্মাতা।

সোশ্যাল মিডিয়ার পাঠক-দর্শকের কাছে পৌঁছাতে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম ধরে ধরে কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। এমন এক বাজার ব্যবস্থায় এসে পড়েছি, যেখানে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করার কিছু নেই বরং সবার কাজ করা দরকার। এখনতো সাংবাদিকরাও অর্থ যোগাড় করছেন বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, শিক্ষামূলক কর্মকা-ের ফি হিসেবে, বক্তৃতা দিয়ে, লেখালেখি করে, জনসংযোগে পরামর্শ দিয়ে, ইভেন্ট মডারেশন, গবেষণামূলক কাজ ও ডকুমেন্টারি তৈরির মাধ্যমে। অনেক সাংবাদিকরা বিজ্ঞাপনী মুনাফা বা সাবস্ক্রিপশনের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নির্ভর করছে আয়ের বেশ কিছু বিকল্প উৎসের ওপর; আয় আসছে অনুদান ও সাহায্য থেকেও। এদের ক্ষেত্রে কনটেন্ট তৈরির পেছনে অনেক সময় দেয়ায় যথেষ্ট হয় না, প্রচারেও সময় দিতে হয়।

কনভারজেন্স জার্নালিজম

মোবাইলের মাধ্যমে যখন তখন রিয়েল টাইমে লাইভ স্ট্রিমিং করা সহজ। বিশ্বজুড়ে কনভারজেন্স জার্নালিজমের কথা হচ্ছে। সাংবাদিকতার এই নতুন ধারনার হাওয়া এসে লেগেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও। আমরা এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, যেখানে সাধারন জনগণ ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করেছেন, আর তার পরপরই সেটি হয়ে উঠেছে টক অব দ্যা টাউন ! স্মার্টফোন ভিত্তিক কনভারজেন্স টেকনোলজির ফলে এখন উন্নত, অনুন্নত সব দেশেই কনভারজেন্স জার্নালিজম দেখা যাচ্ছে।

ওয়ার্ডস্মিথ সফটওয়্যার

বার্তা সংস্থা এসোসিয়েট প্রেসের (এপি) ওয়ার্ডস্মিথ সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলেজভিত্তিক খেলাধুলার প্রতিবেদনগুলো নিজেই তৈরি করে। বিশেষ অ্যালগরিদম বা কম্পিউটারের ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি করে ওয়ার্ডস্মিথ সফটওয়্যার। করপোরেট আয়ের রিপোর্ট নিয়ে প্রতিবেদন রচনায় এর সক্ষমতা একজন মানুষের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। নিয়মিত সরকারি ঘোষণা, সব পরিসংখ্যান, প্রেস বিজ্ঞপ্তি-সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটের হাতে চলে যাবে।

স্বয়ংক্রিয়তা প্রতিবেদককে বরং বিভিন্ন জটিল হিসাব, পরিসংখ্যান ইত্যাদি ঝামেলা থেকে মুক্তি দেবে। পাশাপাশি প্রযুক্তি সংবাদ কক্ষের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। সাংবাদিকদের জন্য এআই রোবট নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যখন এআই প্রযুক্তিটি আরো উন্নত হয়ে নাক গলাতে শুরু করবে সম্পাদকীয়, তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও মানুষের আগ্রহমূলক সংবাদগুলোতে। চায়নাতে রোবট প্রতিবেদকরা প্রবন্ধও লিখছে।

কুইল প্রযুক্তি

লেখার ক্ষমতাসম্পন্ন সফটওয়্যারটির নাম কুইল। এটি সংখ্যাভিত্তিক তথ্য-উপাত্তকে লিখিত প্রতিবেদনে রূপ দিতে পারে। টেলিভিশন এবং অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের জন্য বেসবল খেলার প্রতিবেদন লেখার কাজে কুইল আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে। আর বিখ্যাত ফোর্বস সাময়িকীর মতো একাধিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে কুইল প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েছে। সফটওয়্যার যদি ভালো বাক্য লিখতে পারে, মানুষের পরিশ্রম অনেকটাই কমে যায়। তাই সাংবাদিকতা ও প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে দক্ষ মানবকর্মীর বিকল্প হিসেবে সফটওয়্যারের ব্যবহার অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।

অনেক প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিময়ে কুইল সফটওয়্যার কিনেছে এবং যান্ত্রিক এই লেখার পদ্ধতি কাজে লাগাচ্ছে। কুইল সফটওয়্যার একদল সেনা বা মানুষের এক সপ্তাহের পরিশ্রমের সমান কাজ মাত্র কয়েক সেকেন্ডে করে ফেলতে পারে। লেখার বিভিন্ন নিয়ম বা কৌশলের সমন্বয়েই কুইল সফটওয়্যারটির প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছে। যেমন: বাক্য ও অনুচ্ছেদ গঠন, পৃষ্ঠাসজ্জা, কীভাবে একটা ধারণা বর্ণনা করার জন্য কোনো বাক্য শুরু করতে হয়, পুনরাবৃত্তি এড়াতে হয়, সংক্ষেপ করতে হয় ইত্যাদি।

নতুন নতুন সফটওয়্যার

কয়েকটি বড় বার্তাকক্ষ এবং সংবাদ সংস্থা কিছু দিনের জন্য খেলাধুলা, আবহাওয়া, শেয়ারবাজারের গতিবিধি এবং করপোরেট পারফরম্যান্সের মতো খবরাখবর তৈরির ভার কম্পিউটারের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। যথার্থতা ও ব্যাপকতার বিচারে মেশিন, কিছু সাংবাদিকের চেয়ে ভালো কাজ করেছে। অনেক সাংবাদিক যেসব ক্ষেত্রে প্রায়ই একটি মাত্র উৎসের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করেন, সেখানে সফটওয়্যার বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য খুঁজে এনে, সেই তথ্যের ধরন ও প্রবণতা বুঝে, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ব্যবহার করে সেই প্রবণতাকে প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে মিলিয়ে- বিশ্লেষণ, উপাধি ও রূপকসহ আধুনিক বাক্য গঠন করতে পারে।

অটোমেটেড সাংবাদিকতা

ডেটা থেকে স্টোরি তৈরি মূলত খেলাধুলা এবং আর্থিক খাতের রিপোর্ট করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটা সাংবাদিকদের রুটিন বা গৎবাঁধা কাজ থেকে মুক্ত রাখে, দক্ষতা বাড়ায় এবং খরচ কমায়। ওয়াশিংটন পোস্ট খেলাধুলা এবং নির্বাচনী রিপোর্টিং-এর জন্য নিজেদের তৈরি প্রযুক্তি হেলিওগ্রাফ ব্যবহার করছে।

পারসপেকটিভ এপিআই টুল

ওয়ার্কফ্লো সাজানো হচ্ছে- ব্রেকিং নিউজ ট্র্যাকিং, ট্যাগ এবং লিংক ব্যবহার করে খবর সংগ্রহ ও সাজানো, মন্তব্যগুলো মডারেট করা এবং কণ্ঠ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুলিপি তৈরি। নিউ ইয়র্ক টাইমস পাঠকের মতামত মডারেশনের জন্য জিগ্স-এর (অ্যালফাবেট, গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি) তৈরি পারসপেকটিভ এপিআই টুল ব্যবহার করে। সাংবাদিকদের জন্য রয়টার্স কানেক্ট নামের প্ল্যাটফরমটি রয়টার্সের সকল কনটেন্ট, আর্কাইভ, এমনকি তাদের বিশ্বজোড়া পার্টনারদের পাঠানো কনটেন্টও রিয়েল টাইমে প্রদর্শন করে।

নিউজহুইপ

হালনাগাদ এবং ঐতিহাসিক ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সারদের (প্রভাবিত করতে পারে এমন) শনাক্ত করা এবং দর্শকদের যুক্ত করা। এপি সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড পর্যবেক্ষণ এবং এনগেজমেন্ট বাড়াতে নিউজহুইপ ব্যবহার করে।

ওপেন সোর্স নিউজবট

দর্শকদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কোয়ার্টজ বট স্টুডিওর চ্যাটবট অ্যাপ্লিকেশনটি কাজ করে।এটি তার ব্যবহারকারীদেরকে ঘটনা, ব্যক্তি, বা স্থান সম্পর্কে প্রশ্ন পাঠানোর সুযোগ দেয় এবং সেটি প্রাসঙ্গিক কনটেন্টসহ জবাবও পাঠায় প্রশ্নকর্তাকে। গার্ডিয়ান-এর মতো অনেকেই ফেসবুক মেসেঞ্জারের জন্য বট ব্যবহার করে। বিবিসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের গণভোট কভারের জন্য বট ব্যবহার করেছিল।

ইউরোপিয়ান জার্নালিজম সেন্টার এবং দ্য সোর্স (নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়ে) এর ’ইনোভেট আফ্রিকা’ অনুদান বিজয়ী আফ্রিবট প্রকল্পটি ‘আফ্রিকান সংবাদ সংস্থাগুলোকে নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী (পার্সোনালাইজড) সংবাদ প্রদান এবং মেসেজিং প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে পাঠকদের সঙ্গে আরো কার্যকরভাবে যুক্ত হওয়ার’ সুযোগ করে দিতে একটি ওপেন সোর্স নিউজবট তৈরি করছে।

স্বয়ংক্রিয় তথ্য যাচাই

এর মাধ্যমে কোনো বিবৃতি বা দাবিকে দ্রুততার সঙ্গে যাচাই করা যায়। আর্জেন্টিনার তথ্য যাচাই প্রতিষ্ঠান চেকেডো এজন্য ব্যবহার করে চেকেবোট। ফুল ফ্যাক্ট ইউকে এবং তার পার্টনাররা একটি স্বয়ংক্রিয় ফ্যাক্ট-চেক ইঞ্জিন তৈরি করছে, যা এরই মধ্যে যাচাই হয়ে যাওয়া দাবি চিহ্নিত করবে এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ও সুবিন্যস্ত ডেটা ব্যবহার করে যেসব দাবি এখনো যাচাই হয়নি সেগুলো শনাক্ত ও যাচাই করবে।

আমেরিকার ডিউক রিপোর্টার্স ল্যাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ দাবিগুলোকে যাচাইয়ের জন্য গণমাধ্যমে পাঠাতে ক্লেইমবাস্টার নামের একটি টুল তৈরি করেছে। ২০১৭ সালে স্বয়ংক্রিয় ফ্যাক্টচেক প্রকল্পগুলোর জন্য একটি হাবও চালু করে তারা। যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাক্টম্যাটা তৈরি করেছে একটি অটোমেটেড ফ্যাক্টচেক টুল। এখানে আরো জানতে পারেন স্বয়ংক্রিয় তথ্য যাচাই সম্পর্কে।

বড় ডেটাবেস বিশ্লেষণ

তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে কোনো পরিবর্তন, প্যাটার্ন বা অস্বাভাবিকতা অনুসন্ধান করে সফটওয়্যার। রয়টার্সের লিংকস ইনসাইট বড় আকারের ডেটাসেটে গিয়ে সেখান থেকে ফলাফল এবং ব্যাকগ্রাউন্ড ডেটা সরবরাহ করে সাংবাদিকদের। ওসিসিআরপির ক্রাইম প্যাটার্ন রিকগনিশন দলিলপত্রের বড় ডেটাবেস থেকে কোনো নির্দিষ্ট ধরনের দুর্নীতির তথ্য এবং এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মধ্যকার সংযোগও বিশ্লেষণ করতে পারে।

ইমেজ রিকগনিশন

যে প্রযুক্তি ছবি থেকে বস্তু, এলাকা, মানুষের মুখ, এমনকি অনুভূতিকেও শনাক্ত করতে পারে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ছবি থেকে কংগ্রেস সদস্যদের শনাক্ত করতে আমাজন-এর রিকগনিশন অচও ব্যবহার করে। যে-কোনো ব্যবহারকারী বিনামূল্যে এড়ড়মষব-এর ভিশন অচও ইমেজ রিকগনিশন প্রযুক্তি পরীক্ষা করতে পারেন।

স্বয়ংক্রিয় ভিডিও কনটেন্ট

স্বয়ংক্রিয়ভাবে খবর থেকে স্ক্রিপ্ট এবং ফুটেজ থেকে ছোট ছোট টুকরো কেটে ধারা বর্ণনাসহ ভিডিওর রাফ-কাট তৈরি করা। এই কাজে ইউএসএ টুডে, ব্লুমবার্গ এবং এনবিসি ব্যবহার করে উইববিটজ নামের একটি সফটওয়্যার। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও স্বয়ংক্রিয় ভিডিও সম্পাদনা টুল তৈরি করছেন।

মানুষের আবেগও বুঝে সফটওয়্যার

দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ধারণ করা যাবে মাইক্রোফোন ও ক্যামেরার মাধ্যমেই। প্রতিক্রিয়া জানতে পারলে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ-সিদ্ধান্ত-পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। আইবিএম এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট ওয়াটসন অ্যালগরিদম ব্যবহার করে মুখের অঙ্গভঙ্গি থেকেই মৌলিক মানবিক অনুভূতিগুলি সনাক্ত করতে পারে। কম্পিউটার দর্শকদের প্রতিক্রিয়াও ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করতে এবং রিপোর্ট করতে পারবে।

 

 

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *