অনেকেই আছেন যারা কেবল সস্তা খোঁজেন! তারা ভুলে যান জিনিস যেটা ভালো দাম তার একটু বেশি। দামটা একটু বাড়লেই বিস্তর অভিযোগ দায়ের করতে শুরু করেন। অনেকেতো বইকে কাগজ-কালি-মলাটের সমন্বয়ে তৈরি করা নিছক একটি পণ্য মনে না করে বইয়ে থাকা আদর্শের কথা, মূল্যবোধের কথা, জ্ঞানের কথার দাম টাকার পরিমাণ দিয়ে মূল্যায়ন করতে চাওয়াকে বড় ভুল-অন্যায়, নির্মম রসিকতা মনে করেন!
বই কেনার সময় মূল্য নয় মূল্যবোধের কথা ভাবুন। সস্তা-সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসুন। ভালো বই-পুস্তক রচনার কাজে নিয়োজিতদের অবদানকে সম্মান করা, তাদের সম্মানজনক আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করা, যথাযথ মূল্যায়ন করার মধ্য দিয়েই লেখকদের সামাজিক ক্ষমতায়ন হয়; যার সুফল শেষ পর্যন্ত সাধারণ জনগণই ভোগ করে। দেখে লম্বা করে সালাম দেওয়া, উঠে দাঁড়ানোই সম্মানের শেষ কথা নয়!
আসলে সমাজে ভালো কাজকে, ভালো মানুষকে যত বেশি সম্মান করা হবে, মর্যাদা দেওয়া হবে সমাজ তত ভালো হবে। ভালো কাজ বাড়বে, ভালো মানুষ বাড়বে। আর্থিক দিক থেকে জ্ঞান সাধকদেরকে স্বচ্ছল অবস্থানে রাখার চেষ্টা করাটা ভালো। কারণ মানুষ ভালো মানুষদেরকে দরিদ্র-পীড়িত-নিগৃহিত অবস্থায় দেখলে তাদের মতো হতে চায় না।
সম্মানজনক জীবনযাপনের জন্য বৈধভাবে জ্ঞান চর্চাকারীরা যদি বিত্তশালীও হয় তাতে সমাজ লাভবান হয়। একারণেই মুসলমানদের ইতিহাসে লেখক-অনুবাদকদেরকে তাদের পাণ্ডুলিপির সমপরিমাণ ওজনে স্বর্নমুদ্রা উপহার দেওয়ার উদাহরণও আছে।
বইয়ের সস্তা-সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে উঠেছে লেখক-অনুবাদকদের উপর অবিচারের উপর ভিত্তি করে। লেখকদের অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয় লেখালেখিতে অথচ চলতে হয় অন্য উপার্জন দিয়ে। স্রষ্টা প্রশস্ততা দান করেন বলে তারা লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারেন, তবে অন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকলে বা অন্যায় পথ অবলম্বন না করলে খুব কম জনই সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারেন।
আইরিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ডের মতে, ‘সাহিত্যের সেরা কাজগুলো তাদের মাধ্যমেই হয়েছে যারা তাঁদের রুটিরুজির জন্য এর উপর নির্ভর ছিলেন না।’ একমাত্র আয়ের উৎস লেখালেখি হলে অধিক উপার্জনের আশায় সাহিত্যের মানোত্তীর্ণ নয় এমন লেখাও প্রকাশ করে ফেলে।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো কয়জন হতে পারেন- যারা অন্য কোনো জব করবেন না, একমাত্র আয়ের উৎস থাকবে লেখালেখি এবং অর্থকষ্টে ভুগেও লেখার মানের ব্যাপারে আপস করবেন না। আর্থিক কষ্টের কথা ভেবেই অনুজদের জন্য তিনি বলে গেছেন, ‘কেউ যেন রুটিরুজির ব্যবস্থা না করে লেখালেখিতে না আসে।’
একটি বই একজন মানুষের ব্যক্তিগত বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম সাধনার ফসল। এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন লেখক-গবেষকের জন্য সম্পূর্ণ হালাল। রয়ালিটি পাওয়ার ন্যায্য অধিকার থেকে লেখককে বঞ্চিত করে বে-ইনসাফির উপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাশনার জগৎ অন্তঃসারশূণ্য। বইয়ের সস্তা সংস্কৃতি মানেই প্রকাশনার জগতে অবিচার।
লেখক সম্মানী লেখকের বাড়তি প্রাপ্তি নয়, লেখকের ন্যায্য পাওনা। বইয়ের মাধ্যমে লেখকের সাথে পাঠকের অনুভূতির মিথষ্ক্রিয়া হতে পারে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের চিন্তায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে অনেকের সমধর্মী দৃষ্টিভঙ্গী তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে অনেক সময় বিদ্যা চর্চাকে তুচ্ছ মনে করা হয়।
তবে অনেকে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রয়াসকেই নিচু মান ও নিচু শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখেন। উঁচু শ্রেণীর দৈনন্দিন অভ্যাসে, গ্রহণযোগ্য আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে এবং উঁচুমানের শিক্ষায় শিক্ষিতদের মাঝেও জ্ঞান চর্চার ঘাটতি লেখনে-পঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সামাজিক পরিবর্তনের ধারা কোন দিকে যাচ্ছে তা বুঝতে হলে ঐ সমাজের প্রকাশনাগুলো দেখতে হবে। লাইব্রেরীগুলো কেন বিজিতদের দ্বারা আক্রান্ত হতো? কারণ লাইব্রেরীমুখী, জ্ঞান চর্চায় নিবেদিত মানুষকে ভোগবাদী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা খুব কঠিন। আলোকিত ও সচেতন মানুষ পুঁজিবাদের দাস হয় না, প্রবৃত্তির দাস হয় না, সহজে তাদেরকে উত্তেজিত কিংবা প্রলোভিত যায় না। বাণিজ্যিক সংস্কৃতিতে তাদেরকে বোকা বানিয়ে কখনো কখনো ঠকানো সম্ভব হলেও তাদেরকে নেতিবাচক পরিবর্তনে অগ্রগামী দেখা যায় না।
যখন মানুষের নিজস্ব রুচি গড়ে ওঠে এবং সেই রুচি যখন হয় সুন্দর-পরিশিলিত তখন তারা মাথাকে বিক্রি করে না। যদিও পুঁজিবাদ বেশি দামে বিক্রিকেই বেশি মূল্যবান এবং সাময়িক আনন্দ ও লাভকেই গুরুত্বপূর্ণ করে তোলায় অনেককে টাকায় কিনে নেয়া যায়। তবে এরা সামাজিকভাবে অভিজাত বিবেচিত হলেও মানসিকভাবে দরিদ্র বলেই বিবেচিত হন।
সস্তা লেখকরা ক্ষণকালের চাহিদা মেটায়, জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে এগিয়ে থাকে, সংখ্যায় বেশি থাকে। এরা প্রাপ্তির জন্য করুণাভিখারি হতে পারেন, জনপ্রিয়তার জন্য মিডিয়ার আনুকূল্য পেতে পারেন, ব্যক্তিত্বহীন হওয়ায় স্থূল ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন এবং প্রশংসা ও তোষামুদের কারণে সমালোচনাও এড়াতে পারেন।
যুগে যুগে অনেক লেখকরা দেশ ছেড়েছেন, পেশা পাল্টেছেন; তবে লেখালেখিতেই থিতু হয়েছেন। সৃষ্টিশীলদের যে মানসিক দ্বন্দ্ব সেই দ্বন্দ্বের খাতিরেই পোস্টমাস্টারের চাকরি ছেড়ে লেখালেখিতে পুরোপুরি মন দেন নোবেলবিজয়ী আমেরিকান সাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার।
সৃষ্টিশীল কর্মে পুরোপুরি মনোনিবেশ করার জন্য অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখির নিজস্ব ভূবন সৃষ্টি করেছিলেন নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ। ইমদাদুল হক মিলন জীবিকার সন্ধানে জার্মানিতে গিয়ে দু’বছরে মাত্র এক ডলার হাতে নিয়ে স্বদেশে ফিরে এসে অনেক কিছুই করার চেষ্টা করলেও পেশাদার লেখক হিসেবেই সফল হয়েছেন! সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলতেন ‘লেখালেখি কখনও খণ্ডকালীন হয় না’।
অনেক দেশেই লেখার জন্যে সম্মানী বা রয়্যালটি প্রাপ্তির নিশ্চয়তার কারণে লেখালেখি সফলভাবে পেশাদারিত্ব অর্জন করেছে। অনেক লেখক লেখালেখি করে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় নিজের নামও যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এ উপমহাদেশে এখনো লেখালেখি পেশা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি।
বাংলাদেশে লেখার উপার্জনে সচ্ছলভাবে চলার বিষয়টিও নির্মম বাস্তবতা মাত্র। খুব অল্প সংখ্যক প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা লেখক সম্মানী দিয়ে থাকে। অনেক বিখ্যাত দৈনিকও লেখকের প্রাপ্যটুকু দেয় না। ফলে পত্রিকায় লেখা ও বই প্রকাশ থেকে সম্মানী বঞ্চিত হচ্ছে লেখকরা। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠার পরিবর্তে কষ্টের পাথর সরাতে হিমশিম খেয়ে অনেক উদীয়মান লেখকরাই মাঝপথে হারিয়ে যাচ্ছেন।