অনেকেই সৃজনশীলতা বাদ দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ইউটিউবে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে শত শ্রম-চিন্তা-ভালোলাগা-সময়ের বিনিময়ে জন্ম নেয়া গানগুলোর বিকৃতি ঘটায়ে অনেকেই নিন্দাও কুড়াচ্ছেন। লাইক, কমেন্ট আর ভিউয়ের পেছনে ছুটে অনেকেই বিতর্কিতও হচ্ছেন।
সস্তা-জনপ্রিয়তার পেছনে না ছুটে নিজেকে চিনতে পারলে এবং মূল্যায়ন করতে শেখার সক্ষমতা অর্জন করলেই প্রতিভা সত্যিকারে বিকশিত হতে পারে। জনপ্রিয়তার ভিত্তি মজবুত না হলে যেকোনো সময় তা ধসে পড়ে।
প্রকৃত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ছাড়াই যেনতেন উপায়ে বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্নে বিভোররা তারকা হওয়াকেই জীবনের লক্ষ্যে বানায়। কোন উদ্দেশ্য পূরণে তারা তারকা হতে চায়, সেই প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে অস্পষ্ট। সহজ পথে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে সস্তা খ্যাতির পেছনে ছুটছে, ব্যক্তিত্ব পূর্ণতা পাচ্ছে না, হারিয়ে ফেলছে বিবেচনা বোধটুকু , স্বকীয় কোনো পরিচয় তৈরি হচ্ছে না এবং সুখ্যাতি আর কুখ্যাতির মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করছে না!
আমেরিকান সাইকোলজিস্ট ডারা গ্রিনউড ও তার সহযোগীরা ২০১৩ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় উল্লেখ করেন, ‘মানুষ মূলত তিনটি কারণে বিখ্যাত হতে চায়: ১. অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২. বাস্তব জীবনে অতিরিক্ত কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য এবং ৩. বৃহত্তর কল্যাণে নিজের খ্যাতিকে কাজে লাগানোর জন্য।’ অল্প পরিশ্রমে তারকাখ্যাতি পেলে অনেকে তা ধরে রাখতে পারেন না। দৃষ্টি আকর্ষণে কসরত ও খ্যাতির মিথ্যা মোহ ব্যক্তিগত জীবনে উপেক্ষা ও বিড়ম্বনা বাড়ায়।
সস্তা জনপ্রিয়তা শুধু নয় সস্তা সব কিছুই খারাপ। লজ্জা-ঘৃণা-ভয় উপেক্ষা করে বুদ্ধি বিকশিত হলেও মেরুদণ্ডটি শক্তপোক্ত না হলে সর্বনাশের পথেই ধাবমান হয়। বিনামূল্যে যা পাওয়া যায়, তার চেয়ে সস্তা আর কিছু নাই। অনেকেই পকেট থেকে দু’পয়সা কম বের করে কাজ সারতে চান৷ সেভিংসের চিন্তায় কম পয়সায় কাজ করানোয় বিল্ডিংয়ের কনস্ট্রাকশন ঠিকঠাক হয় না, নকশা ত্রুটিমুক্ত হয় না, পয়ঃপ্রণালীতে গলদ থাকে, পাইপ লাইনে লিক করে৷ খরচের ধাক্কা এড়াতে টাকা-পয়সার ব্যাপারে অতিরিক্ত সংযমীর লক্ষ্য পয়সা বাঁচানো৷ সস্তায় কাজ সারায় সাময়িক আনন্দ হলেও আদৌ লাভ হয় না! উত্পন্ন জিনিসের মান সেরা হলেই তা বেশিদিন টেঁকসই হয়; আর যার মান ভালো তার দাম একটু বেশি!
স্বাভাবিকভাবে দামী জিনিসগুলো ভালো, সস্তা জিনিসগুলো খারাপ। দামী জিনিসে সাধারণত কোনো সমস্যা থাকে না আর কম দামী জিনিসে একাধিক সমস্যা থাকে; নানা সমস্যার কারণে কিছু দিন পরই দরকারি মুহুর্তেও সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়। নোকিয়ার ফোন দীর্ঘদিন ব্যবহার করা গেলেও সস্তা চায়না ফোনে একের পর এক সমস্যা লেগেই থাকে। সস্তার তিন অবস্থা হচ্ছে — অল্প সময়ে ক্রয়কৃত পন্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। মানহীন পন্য ক্রয়ে ব্যয়কৃত পুরো টাকাটাই গচ্ছা যায় এবং পচা জিনিসটা কিনে নিজের বোকামির কারনে লজ্জা হয়! সস্তায় ভোগান্তি বাড়ে। অল্প মূল্যের বস্তু প্রায়ই খারাপ হয়। ফলে সস্তা মানেই যে লাভজনক তা কিন্তু নয়!
সস্তা জনপ্রিয়তার ফাঁদ বড় ফাঁদ। সস্তা জনপ্রিয়তার ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের তুলে ধরতে ইউটিউবে-টিকটক-লাইকিতে-ফেসবুক লাইভে বিভিন্ন ধরনের অমার্জিত ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করছে। অশালীনতা, অকথ্য ভাষায় গালাগালি, দেশীয় সংস্কৃতির অবমাননায় ভরা ভিডিও দেশের যুবসমাজকে পথভ্রষ্ট করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তায় বিপথে যাচ্ছে তরুণরা।
টিকটক লাইকিতে সস্তা জনপ্রিয়তা পেয়ে অনেক তরুণ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। কিশোর গ্যাং তৈরিতে প্রভাব রয়েছে এসব প্লাটফর্মের। সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে অভিনয় শৈলীতা ছেড়েও যৌনতা নির্ভর দৃশ্যে অবলীলায় তুলে ধরে একের পর এক অভিনয় করে চলছেন অনেক অভিনেত্রী। মানবাধিকারকে অসম্মান করা, অগ্রাহ্য করার প্রবণতাকে উস্কে দিচ্ছে রাজনীতিকদের সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা। সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে ফোটোশপের কারসাজি করা হচ্ছে।
তারপরও সত্য-সুন্দর-শাশ্বত উদ্ভাসিত হয়, মেকি খসে পড়ে, মুখোশ উন্মোচিত হয়। তাই উচিত- সস্তা জনপ্রিয়তায় গা না ভাসানো, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনকে লক্ষ্য না বানানো এবং যা না তা না করা। শর্টস-টপস-মিনি-মিডি পরলেই সুন্দরী হওয়া যায় না; গ্ল্যামারে হৃদয় কাড়াই সবকিছু নয়। চিরকাল কেউ কাউকে ঠকাতে পারে না।
সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যে হঠাৎ একদিন রাস্তা ঝাড়ু দেয়া, হেঁটে অফিসে যাওয়া, বসে ভিক্ষুকের সাথে ভাত খাওয়ায় আসলে আপনি যা তা প্রকাশ করে না। নিজে যা তা থেকেই জনহিতকর হাজারো কাজ করার সুযোগ রয়েছে। অযথা পাবলিকের নজর কাড়তে নিজেকে যা নন তা বানিয়ে ফেলার দরকার নেই।