জাকারিয়া পলাশ : সংবাদ থেকেই এসেছে সাংবাদিকতা শব্দটি। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ নিউজ (news)। আরবিতে খবর বা নাবা। আভিধানিকভাবে আরবি নবী শব্দের সঙ্গে বাংলা সাংবাদিকের কোনো তফাৎ নেই। যিনি নাবা (এলাহী বানী) বহন করেন তিনি নবী। আর সংবাদ বহনকারী হলেন সাংবাদিক। নবীদের কাজকে বলা হয় নবুওয়াত আর সাংবাদিকের কাজই সাংবাদিকতা। পারিভাষিকভাবে দুই ভাষার শব্দ দুটির সামান্য পার্থক্য হল, নবীরা বহন করেন এলাহী বার্তা।
মহাজাগতিক খবর আল্লাহর ইচ্ছায় তারা মানুষের জন্য বহন করেছেন। আর সাংবাদিক বহন করেন জাগতিক খবরাখবর। ধর্মচিন্তাবিদদের মতে, নবীদের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বাণী কিছুতেই বিকৃত করার ক্ষমতা রাখেন না। হুবহু শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেয়াই তার কাজ। একইভাবে সাংবাদিকেরও বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই কোনো সংবাদকে বিকৃত করার। ঘটনার নিখাদ ও নির্মেদ উপস্থাপনই সাংবাদিকের কাজ। সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব এখানেই স্পষ্ট।
ইংরেজিতে news শব্দটি চারটি শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। তা হল, N= North, E= East, W= West, S= South. অর্থাৎ উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণের সব কিছু মিলেই সৃষ্টি হয় নিউজ। আমাদের চারপাশের যেকোন ঘটনাই নিউজ। তবে তার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। তা হল, সত্যতা ও স্বতন্ত্রতা। মনে রাখতে হবে, সংবাদ ‘অবিশ্বাস্য’ হলেও হতে পারে কিন্তু অবশ্যই ‘সত্য’ হতে হবে। যেমন, একজন মানুষের পেটে কুকুরের ছানা জন্ম নিয়েছে। খবরটি অবিশ্বাস্য। কিন্তু এটি সংবাদ হবে তখনই যখন তা সত্য।
স্বতন্ত্রতা বিষয়টি বুঝাতে একটি পুরনো উদাহরণ দেয়া যাক। কুকুর একজন মানুষকে কামড়ালে সেটি সংবাদ নয়। কারণ তার কোনো স্বাতন্ত্র নেই। কিন্তু কোনো মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা সংবাদ। আবার একই সঙ্গে একই স্থানে অনেক লোককে কুকুরে কামড়ালে তা সংবাদ। সাংবাদিককে সমাজের আয়না হিসাবে কল্পনা করা যায়। আয়নাকে সামনে নিয়ে তার দিকে তাকালে নিজের চেহারার সৌন্দর্য্য ও খুঁতগুলো নিখুঁত ভাবে ফুটে ওঠে। সেখানে কারও গালে তিল বা দাগ থাকলে তা বড় বা ছোট করে দেখালে আয়নাটি ত্রুটিপূর্ণ ধরা যায়। একইভাবে সমাজের চিত্র বা ঘটনাবলীর অতিরঞ্জিত বা অপূর্ণ উপস্থাপনও ত্রুটিপূর্ণ সাংবাদিকতার উদাহরণ।
মনে রাখতে হবে, মানুষের জন্যই সংবাদ রচনা, ছাপা বা প্রকাশিত হয়। সুতরাং, মানুষ যেটি গ্রহণ করবে সেটি সংবাদ হবে। মানুষের সামাজিক চিন্তার সঙ্গে অসঙ্গত কিছু সংবাদ হিসাবে টিকতে পারবে না। সংবাদ তার সত্যতা ও স্বাতন্ত্র হারালে ধীরে ধীরে পাঠকপ্রিয়তাও হারাবে। দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের একটি উক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, আমরা প্রতিদিন সকালে চার লক্ষ পত্রিকা মানুষের হাতে পৌঁছে দেই। এই লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে প্রতিদিনই আমরা পরীক্ষা দেই। আমাদের কাজ ভুল হলে মানুষ আমাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতার জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ ভূমিকা নেয়ার কিছু নেই। কিন্তু, ইদানিংকালে রাষ্ট্রযন্ত্র স্বপ্রণোদিত হয়ে সাংবাদিকতার নিয়ন্ত্রণে নানা আইন ও বিধি তৈরি করে সাংবাদিকদের হয়রানির চেষ্টা করছে। সেই হয়রনির বৈধতা পর্যালোচনা এই প্রবন্ধের উদ্যেশ্য নয়।এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ও আইনি জবাবদিহিতার বাইরে সাংবাদিকের দায়িত্বশীলতা বা জবাবদিহিতার বিষয়। অর্থাৎ, সাংবাদিকতার ইথিকস সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করাই এখানে মূলকথা।
সাংবাদিকতা দিনে দিনে প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো পেয়েছে। এখন প্রচুর পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে সাংবাদিকতার পেছনে। দলে দলে পুঁজিপতিরা দৌড়ে আসছেন মিডিয়ায় ইনভেস্ট করার জন্য। নতুন নতুন কর্পোরেট গণমাধ্যম গড়ে উঠছে। যেখানে দলে দলে তরুণ সাংবাদিকের চাকরি হচ্ছে। পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। সাংবাদিকরাও আর্থিকভাবে সাবলীল জীবন যাপন করছে। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান সময়কে বলা যায়, মিডিয়া বিস্ফোরণ যুগ।
এই সময়ে এসে চিন্তাশীলদের মাথায় একটি বড় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হচ্ছে, জাতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংবাদিকতার সম্পর্ক কি; অর্থাৎ, জিডিপিতে সাংবাদিকতার ভূমিকা কি? গ্রামের একজন কৃষকের শ্রম, কষ্ট ও ঘামের বিনিময়ে আলু, পটল, ধান বা ফসল উৎপন্ন হয়। তার মূল্য যাই হোক না কেন, মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) তার ভূমিকা আছে। কিন্তু, সাংবাদিকের ভূমিকা এখানে কি?
এই প্রশ্নটির উত্তরের মধ্যেও সাংবাদিকতার দায়িত্বশীলতার বিষয়টি নিহিত। সংবাদের কারবারিরা এর বিভিন্ন উত্তর দিয়ে থাকতে পারেন। আগেই বলেছি, মানুষের জন্য সংবাদ, সংবাদের জন্য মানুষ নয়। একটি সংবাদ লিখতে হবে এজন্য একটি মানুষকে খুন নয়। বরং একটি মানুষ খুন হলে তা জানাতে এবং তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে সংবাদ লেখা হয়। এটি সমাজের অপরিহার্য বিষয়। খবর জানতে চাওয়া মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাস করতে হলে, খবর জানতে হয় মানুষকে। আদিকালে মানুষ গুহায় বাস করত। পশু শিকার ছিল তাদের আহারের উপায়। কিন্তু পশু শিকারের পর মানুষ খাওয়ার পাশাপাশি নাচত, গাইতো। পশু শিকারের ঘটনার অনুকরণে অভিনয় করে বীরত্ব প্রকাশ করতো। ছড়া কাটতো। এই আনন্দের গল্প পাথরে খোদাই করতো। পশু শিকার আর খাওয়ার বাইরে এই সব ক্রিয়াকলাপ নিশ্চয়ই তাদের মূল কাজ নয়। কিন্তু কালক্রমে এটা মানুষের সমাজবদ্ধ জীবনের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। একটা পেটের প্রয়োজনে অন্যটা প্রাণের, মনের। পরস্পরের পরিপূরক। মন-প্রাণ আছে বলেই সে মানুষ; পশু নয়।
একইভাবে, কৃষকের উৎপাদন মানুষের পেটের জন্য। সাংবাদিকের সংবাদ রচনা মানুষের মনের জন্য, বৃদ্ধিবৃত্তির জন্য। একটি আরেকটির সহায়ক। সময়ের পরিবর্তনে মানুষ বাড়ে। সমাজ বড় হয়। শিকারি আর অভিনেতা আলাদা হয়। শিকারির শিকার খায় অভিনেতা। অভিনেতার অভিনয় দেখে আনন্দ পায় শিকারি। এভাবেই মানুষের পেশার ভিন্নতা সৃষ্টি হয়। আসে স্পেশালাইজেশনের যুগ। আলাদা হয়ে যায় কৃষক আর সাংবাদিকের কাজের ক্ষেত্র। কিন্তু উভয়ই কাজ করে সমাজের জন্য, দেশের জন্য। মানুষের জন্য। কৃষক যেমন মানুষের জন্য ধান উৎপন্ন করে। ধানের স্বাদ ধানের মতোই হয়, বিষের মতো হয় না। একইভাবে সাংবাদিকের উচিত মানুষের জন্য খবর রচনা করা। খবরের স্বাদ যেন গুজবের মতো না হয়।
ইদানিংকালে রাশি রাশি অনলাইন পত্রিকা চালু হতে দেখা যাচ্ছে। যা এখন সংবাদের অবিশ্বাস্য দ্রুতগতি এনে দিয়েছে। এর মাধ্যমে তথ্য ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা অসীম। ফলে এখন খবর আর গুজব আলাদা করা হয়ে পড়েছে গভীর গবেষণার বিষয়। কিন্তু, বড় ভাবনার বিষয় হচ্ছে, একই খবর যখন সবাই হুবহু কপি করে প্রকাশ করছে যার যার ওয়েবসাইটে। তখন, তার স্বাতন্ত্র কি? উৎপাদনশীলতার কি থাকল? একজনের লেখা গান অন্যের বলা যেমন, একজনের চাষ করা ধান অন্য এক চাষা নিজের দাবি করলে তা যেমন অর্থহীন। একজনের খবর নকল করে নিজের মতো প্রকাশ করাও তেমনি অনুৎপাদনশীলতা।