শিশুবান্ধব পরিবার দরকার। সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখবেন। আদরের চেয়ে শাসন বেশি করবেন না। অতিরিক্ত শাসনে সন্তানের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং অনেক সময় সন্তান ভালো হওয়ার বদলে বিপথে চলে যায়। কারণে-অকারণে বকাঝকা করলে সন্তান বাবা-মাকে ভয় পেতে শুরু করে। তারা বাবা-মায়ের কাছ থেকে সবকিছু আড়াল করতে চায়, মিথ্যা বলায় পটু হয়ে ওঠে, উদ্ধত আচরণ করে। এর ফলে তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়। তারা নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তাই কচি ও কোমল সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের সুখ-দুঃখের সাথি হওয়া প্রয়োজন।
তারা ভুল করলে সেটি শুধরে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে যেন এ রকম না হয় সে ব্যাপারে তাদের সতর্ক করুন। সন্তানদের পাশে থেকে পর্যাপ্ত সময় দিন, স্নেহ-মমতার সঙ্গে ভালো-মন্দের শিক্ষা দিন, কাদের সাথে মিশে বা কোথায় যায়-খেয়াল রাখুন। সন্তানকে বড়দের শ্রদ্ধা করতে এবং ছোটদেরও স্নেহ করতে শিখান। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন, আবেগগতভাবে সংযুক্ত হোন। সম্ভব হলে সপ্তাহে একদিন, সম্ভব না হলে মাসে অন্তত একদিন বাচ্চার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে খোঁজখবর নিন। কোচিং বা প্রাইভেট টিউটর থাকলে তাদের সাথেও সন্তানের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করুন। সাপ্তাহিক ছুটিতে বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যান।
স্বীকৃতি দিন
শিশুরা হলো বিস্ময়কর, তাদের স্বীকৃতি দিন। শিশুরা হলো মূল্যবান, তাদের মূল্য দিন। শিশুরা হলো বিশ্বাসযোগ্য, তাদের বিশ্বাস করুন। শিশুরা হলো উৎসুক, তাদের উৎসাহ দিন। শিশুরা হলো কর্মচঞ্চল, তাদের পরিচালনা করুন। শিশুরা হলো উদ্ভাবক, তাদের সমর্থন দিন। শিশুরা হলো নিরপরাধ, তাদের সাথে আনন্দ উপভোগ করুন। শিশুরা হলো স্বত:স্ফূর্ত, তাদের উপভোগ করুন।
শিশুরা হলো আনন্দপূর্ণ, তাদের মূল্যায়ন করুন। শিশুরা হলো কর্মদক্ষতা সম্পন্ন, তাদের উন্নয়নে এগিয়ে নিন। শিশুরা হলো দয়ালু, তাদের থেকে শিখুন। শিশুরা হলো অনন্য, তাদের সত্যতা সমর্থন করুন। শিশুরা হলো মনোরম, তাদের সযত্নে লালন করুন। শিশুরা হলো আকাক্সক্ষা সম্পন্ন, তাদের প্রতি মনোযোগী হোন। শিশুরা হলো উন্নত চরিত্রের, তাদের শ্রদ্ধা করুন। শিশুরা হলো হাস্যজ্জ্বল, তাদের সাথে হাসি তামাসা করুন। শিশুরা হলো খোলা মনের, তাদের শিক্ষা দিন।
একজন শিশুর সামগ্রিক বিকাশের জন্য যেসব দক্ষতা থাকা দরকার-নৈতিক দক্ষতা, শিক্ষাগত উৎকর্ষতা, ভাষাগত দক্ষতা, বিশ্লেষণ দক্ষতা ও সামাজিক দক্ষতা। নৈতিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হলে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া যায় না। ধর্ম জানার অভ্যাস ও মানার চর্চা তৈরি করতে হবে। অনুসরণীয় আদর্শের সন্ধান দেয়া, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ধারণ ও হালাল-হারামের সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।
হতাশামুক্ত জীবন গড়তে শিশুকে ইমাম গাজালির এই বাণীটি বোঝাতে হবে- ‘তোমার জন্য যা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা যদি দুই পাহাড়ের মাঝেও লুকানো থাকে, তবুও তা পৌঁছানো হবে। আর যা বরাদ্দ নেই, তা যদি দুই ঠোঁটের মাঝেও থাকে, তবুও তা পৌঁছবে না’। স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অভিভাবক বয়স কমিয়ে দেয়ায় জীবনের প্রাথমিক স্তরেই মিথ্যা দিয়ে শুরু হয়। আপনার সন্তান ছোটো হলেও ওর নিজস্ব একটা জগৎ আছে, নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, স্বপ্ন আছে।
কৈশরে খুব আবেগ প্রবণ হওয়ায় ধৈর্যের সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শাস্তি ও বকুনি তাদের মধ্যে বিদ্রোহ করার মনোভাব বাড়াতে পারে। ছোটবেলা থেকেই নিয়মানবর্তিতা তৈরি করতে পারলে তাদের সামলানো সহজ হয়। উত্তম গুণাবলি সম্পন্ন পিতা-মাতা পাওয়া সন্তানের অধিকার। সন্তানের শিশুকালে তার জন্য অনাবিল উচ্ছ্বাস ও আনন্দের সুযোগ সৃষ্টি করা বাবা-মায়ের দায়িত্ব।
জন্ম নিবন্ধন করুন
আইন অনুযায়ী প্রত্যেক শিশুর জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। নবজাতকের একটি নাম ও একটি জাতীয়তা নিশ্চিত করতে এটি হচ্ছে প্রথম আইনগত ধাপ। জন্ম নিবন্ধন প্রতিটি শিশুসহ বয়স্কদেরও একটি অধিকার। এটি নাগরিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। পৃথিবীতে একটি শিশু জন্মানোর পর রাষ্ট্র থেকে প্রথম যে স্বীকৃতি সে পায় সেটি হলো জন্ম নিবন্ধন। দেশের অন্যান্য নাগরিকের সাথে সে সমান অধিকারে এক কাতারে সামিল হয় এই জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে।
জন্ম নিবন্ধনের মধ্যদিয়ে একটি শিশু একটি নাম লাভ করে যা সারাজীবন তাকে একটি পরিচিতি দেয়। জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি শিশু প্রথম নাগরিকত্বও লাভ করে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইনে বলা হয়েছে, বয়স, জাতি-গোষ্ঠি, ধর্ম-কিংবা জাতীয়তা সকল নির্বিশেষে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণকারী প্রত্যেকটি মানুষের জন্য জন্ম নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষে জন্মনিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিবন্ধনকারীকে একটি সার্টিফিকেট দেন। নিবন্ধনের সময় শিশুর নামের বানানের ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখা উচিৎ।
পরীক্ষাভীতি দূর করুন
জানা সত্ত্বেও খাতায় না লেখা, পরীক্ষার আগে খাওয়া, ঘুম বাদ দেওয়ার মতো সমস্যাসহ পরীক্ষা নিয়ে শিশুর অহেতুক ভীতি বা উদ্বেগই পরীক্ষাভীতি। পরীক্ষা বিষয়টিকে সহজে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। মূলত বেশি আকাক্সক্ষার কারণে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। আকাক্সক্ষা কমলে চাপও কমবে, এতে পরীক্ষাভীতিও কমে যাবে। যারা মানসিক চাপমুক্ত পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের পরীক্ষার ফল ভালো হয়েছে। পরীক্ষাভীতি কাটানোর ভালো উপায় হলো আগে থেকেই যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া।
মা-বাবার মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা ও আশানুরূপ ফল না হলে তাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা শিক্ষার্থীর পরীক্ষাভীতির অন্যতম কারণ। মেধা বা যোগ্যতা যাচাই না করেই সন্তানের ওপর প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দেয়া,সন্তানের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক অবস্থানের নিয়ামক ভাবা, নিজের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে চাওয়া ঠিক না। প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল না হলে সন্তানকে বকাবকি, অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা, এমনকি অনেক সময় মারধর করতেও দেখা যায়। কাক্সিক্ষত ফলাফলের দুশ্চিন্তায় শিশু সঠিকভাবে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতেই পারে না।
শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত শাসন শিশুর পরীক্ষাভীতির কারণ হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের কাছে নিজের অবস্থান বজায় রাখার দুশ্চিন্তা থেকেও মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। খুব অল্প কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তাই এমন হতে পারে যে সে যেকোনো বিষয়েই আগে থেকে অহেতুক উদ্বেগ বা ভীতিতে ভোগে। মূলত আত্মবিশ্বাসের অভাব নিয়ে বড় হলে এমন হতে পারে।
নিয়মিত পড়াশোনা করলে আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে এবং শিশুকে অহেতুক ভীতি থেকে মুক্ত করা সহজ হবে। পরীক্ষার আগেই পড়া ভালোভাবে শেষ করে কয়েকবার রিভিশন দিতে হবে। পরীক্ষার ঠিক আগে নতুন কোনো বিষয়ে পড়তে যাওয়া ঠিক নয়। সন্তানকে আশ্বাস দিন ফলাফল ভালো বা খারাপ যাই হোক, আপনারা তার পাশে আছেন। পরীক্ষায় প্রথম হওয়া যেন জীবনের উদ্দেশ্য না হয়, শিশু যেন জেনে-বুঝে তারপর লিখতে পারে সেই শিক্ষা দিন।
শিশুকে আনন্দ নিয়ে শেখাবে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক বেছে নেওয়া খুব জরুরি। রুটিন করে পড়াশোনা করতে হবে। পড়াশোনার জন্য সকাল ও সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময় ভাগ করে নিতে হবে। খুব বেশি রাত জেগে পড়াশোনা করা যাবে না। রাতে যেন পর্যাপ্ত ঘুমের সময় থাকে। টানা অনেক সময় ধরে না পড়ে বিরতি দিয়ে পড়লে পড়া ভালো মনে থাকবে, পড়ায় বিরক্তি বা অবসাদ আসবে না। যেকোনো বিষয় পড়া হয়ে গেলে তা বারবার লেখার চর্চা করলে বানান ঠিক হবে, সহজে ভুলে যাবে না, হাতের লেখা দ্রুত হবে এবং পরীক্ষার টাইম ম্যানেজমেন্টও শেখা হবে।
পড়াশোনার মতোই রুটিন করে বাসায় প্রতি সপ্তাহে এক দিন শিশুর পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে স্কুলেও সপ্তাহে এক দিন পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে কঠিন প্রশ্ন দেখে না ঘাবড়ে সহজ এবং জানা উত্তরগুলো আগে লিখতে শেখান। শুধু প্রতিভা আর পরীক্ষার ফলাফল নয়; সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াই হলো তাদের সাফল্যের মূল সূত্র।
শরীরচর্চা ও পুষ্টিকর খাবার
স্কুলগামী শিশুদের প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু শরীরচর্চা করা উচিত। এতে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়, মনঃসংযোগ বৃদ্ধি পায় এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। সহজে কোনো নেতিবাচক প্রভাব মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে না। খেলাধুলা শরীর ও মনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। টেলিভিশন ও কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকে পড়ার ফলে শিশুদের চোখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, মেরুদণ্ডের দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা, হাতের কবজিতে ব্যথাসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মস্তিষ্ক।
নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বসবাসের কারণে শেয়ারিংয়ের প্রবণতা কমে গেছে, বিনোদনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, হয়ে পড়ছে অনেক বেশি মাত্রায় অনুভূতিহীন। এ ছাড়া নিয়মিত পুষ্টিকর সুষম খাবার খেতে হবে। মস্তিষ্ক সচল ও কার্যক্ষম রাখতে শাকসবজি, ফল, ডিম, দুধ ও শস্যজাতীয় খাবার খেতে হবে। শিশুদের জন্য পড়াশোনার মাঝে একটু বিনোদনের সুযোগ থাকতে হবে।
একঘেয়ে পড়াশোনায় মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে গেলে শিশুর জন্য পড়া মনে রাখা কঠিন হয়ে যায়। শিশুর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। গান শোনা বা গাওয়া, টিভি দেখা, যেকোনো খেলাধুলা ও ছবি আকার মতো বিষয়গুলো মনকে সহজেই চাপমুক্ত করতে পারে। পরীক্ষার আগের রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। ভালো ঘুম হলে পরদিন ঠাণ্ডা মাথায় সুন্দর করে সব প্রশ্নের উত্তর লেখা সম্ভব হবে।