যৌতুক বন্ধ হোক পরিবার থেকেই। যৌতুক বিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও যৌতুকজনিত হত্যাকাণ্ড, অত্যাচার, নির্যাতন, আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। পরিণামে মা-বোন হচ্ছেন লাঞ্ছিত ও নারীকুল হচ্ছে অপমানিত। পরিবার প্রধানদের যৌতুক প্রতিরোধে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
এ অভিশপ্ত প্রথাটির মূলোচ্ছেদ এবং দেশকে যৌতুকবিহীন করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন পরিবার। প্রতিটি পরিবার যদি যৌতুক মুক্ত হয় তবে যৌতুকের অভিশপ্ত প্রথা দেশ থেকে বিলুপ্ত হতে পারে। যৌতুকের সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন।
অভিভাবক শ্রেণি, যুবক শ্রেণি এবং নারীসহ সবাই যদি যৌতুক দেওয়া বা নেওয়াকে অন্যায় বলার মতো মানসিকতার অধিকারী হয়; তবেই সম্ভব যৌতুককে না বলা। যৌতুক মুক্ত পরিবার গড়তে পরিবার প্রধানদেরও কমিটমেন্ট থাকা দরকার। তাদের অঙ্গীকার থাকতে হবে যে তারা নিজ পরিবারকে যৌতুক মুক্ত রাখবে।
যৌতুকে জড়িতদের বয়কট করুন
যৌতুক সর্বাধিক অমানবিক ও বেদনাদায়ক সমস্যা; একটি অভিশপ্ত প্রচলন এবং ঘৃণাজনক জঘন্য প্রথা। যা দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনজীবনে এক অসহনীয় অবস্থা সৃষ্টি করেছে। বিয়ে-শাদিতে যৌতুকের সাথে যারা জড়িত তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। পরিবারের মুরব্বিদের সচেতন ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যৌতুক আদায়ে যেসব পাষণ্ড স্বামী স্ত্রীকে মারধর করে বা বাবার বাড়িতে টাকা বা অর্থ আনতে পাঠিয়ে দেয় তারা পরিবারের বাইরের কেউ নয়।
কাবিননামা ফরমে ‘যৌতুকের কোনো দাবি নেই’ মর্মে আদালতগ্রাহ্য হলফনামায় স্বাক্ষরদানের ধারা প্রবর্তন করলে যৌতুকের লোভ কমবে। কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব-দুঃখী, অসহায় পরিবারের বিয়েযোগ্য মেয়ের বিয়ের বিষয়ে ধনাঢ্য, বিত্তবানরা এগিয়ে এলে সুফল মিলবে। যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন করতে যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে, যৌতুক লেনদেন বন্ধ করার মনমানসিকতা তৈরি করতে হবে। বিয়ে-শাদির মতো পবিত্র কাজকে যৌতুক লেনদেনের মতো অপবিত্র তৎপরতা মুক্ত করলে মানবিক কর্তব্য পালন হবে।
যৌতুক বন্ধে আইন
নিরোধ আইনে যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যৌতুক বলিতে শরিয়ত মোতাবেক প্রদত্ত দেনমোহর বা মোহরানা বাদে, যেকোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বুঝাইবে, যাহা- ক. বিবাহের এক পক্ষ অন্য পক্ষকে, অথবা খ. বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতামাতা বা অন্য কেহ বিবাহের যে পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহ মজলিসে বা বিবাহের পূর্বে না পরে বিবাহের পণ রূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদান করেন বা করিতে চুক্তিবদ্ধ হন।’
যৌতুক প্রথার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সামাজিক কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস, সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহ, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের বাসনা, পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের নিম্ন আর্থসামাজিক মর্যাদা ও অসহায়ত্ব ইত্যাদি।
একদিকে যৌতুকের দায়গ্রস্ত বাবার অসামর্থ্য অন্যদিকে যৌতুকলোভী স্বামীর নানামুখী নির্যাতনে বাধ্য হয়ে বিবাহিত নারীকে আত্মহত্যা করতেও দেখা যায়। অনেক সময় যৌতুকলোভী স্বামী শেষ পর্যন্ত যৌতুক না পেয়ে যে কোনো উপায়ে স্ত্রীকে হত্যাও করেন। যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হলে তা মুখ বুজে সহ্য না করে আদালতে যৌতুক আইনে মামলা দায়ের করতে হবে অথবা আইন সহায়তাকারী সংগঠন সমূহের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। প্রতিবাদী হতে না পারলে পরিবর্তন আসে না।
যৌতুককে না বলুন
যৌতুক বন্ধ করতে হলে- কন্যা যাতে পিতার সম্পত্তির ন্যায্য অংশের উত্তরাধিকার লাভ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন করতে হবে। বিবাহের ক্ষেত্রে শুধু অর্থবিত্তের পরিবর্তে পাত্র-পাত্রীর সততা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ছেলের পরিশোধের সামর্থ্যরে বাইরে দেনমোহর ধরা যাবে না। পারিবারিক পর্যায়ে নারীর অবদানের মূল্যায়ন এবং পারিবারিক সংহতি রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে, সকলের অবদানকে সমানভাবে মূল্যায়নের উদারতা তৈরি করতে হবে, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। যারা এখনো বিয়ে করেননি তারা যদি মনে করে এবং বিশ্বাস করে- যৌতুক চাওয়া মানে ভিক্ষা চাওয়া, যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি তাহলে বড় কাজ হয়। যতদিন পর্যন্ত যৌতুককে না বলতে পারবেন না কিংবা ঘোষণা দিতে পারবেন না- যৌতুক নেবও না, যৌতুক দেবও না; ততদিন যৌতুক বন্ধ করা যাবে না। যৌতুক নেয়া ও দেয়ার ব্যাপারে আমরাই দায়ী, যৌতুককে হ্যাঁ বলার প্রবণতাই দায়ী।
যৌতুক অপরাধ
বিয়ে মানে এই নয় যে একটি মেয়েকে ছেলে পরিবার কিনে নিচ্ছে। যেসব মেয়ে স্বাবলম্বী, শিক্ষিত, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী; তাদেরকে এই পর্যায়ে আনতে বাবা-মা অনেক খরচ করেছেন বরং অনেক ক্ষেত্রে ছেলের পড়া-লেখার ও আনুষঙ্গিক খরচের থেকে মেয়ের জন্য কয়েকগুণ খরচ হয়। অথচ মেয়ের বাবা মাকে মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করতে হয়, মেয়ের জন্মের পর থেকেই মেয়ের বিয়েতে কী দিবেন তা ভেবে শুরু করতে হয় সঞ্চয়, মা তার শখের গহনা রেখে দেন মেয়ের জন্য। উচ্চবিত্ত পরিবার উপহার-গিফট-উপঢৌকন বলে যৌতুক নেয়।
মেয়েকে যাতে শ্বশুরবাড়িতে কষ্ট করতে না হয় সেজন্য জামাইকে দেয়া হয় গাড়ি, বাড়ি, আসবাবপত্র ইত্যাদি। মেয়ের বাবা-মা চিন্তা করেন জামাই খুশি থাকলে মেয়েই ভালো থাকবে। বর্তমান সমাজে একটি নতুন প্রবণতা চালু হয়েছে যে ‘যৌতুক না চাইলে কন্যার পিতা বেশি দেবেন’। ফলে মেয়ের বাবা মেয়েকে স্বর্ণের গহনা, প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, ফ্রিজ, রঙিন টেলিভিশন, মোটরসাইকেলসহ নানান কিছু ট্রাকে করে নতুন জামাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেন। অথচ বিয়ের শর্ত হিসেবে ৫০০ টাকার সমমূল্যের কিছুও দেয়া যাবে না, দিলে আইন অনুসারে যৌতুক হবে এবং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। আইনে যৌতুক দেয়া ও নেয়া উভয়ই সমান অপরাধ।
সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতেই ‘যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৭’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কোনো নারীর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষের অন্য যেকোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনো নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা (প্ররোচিত করে) করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মারাত্মক জখমের জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা অন্যূন ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
যৌতুকের জন্য অঙ্গহানি করা হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে ১২ বছরের কারাদণ্ড হবে। যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম করলে তার জন্য ১ থেকে ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং উক্ত দন্ডের অতিরিক্ত অর্থদন্ড হবে। স্ত্রীর জখমের ধরন অনুযায়ী স্বামীকে অর্থদণ্ডসহ আমৃত্যু ভরণপোষণ করতে হবে। যৌতুক নিয়ে মিথ্যা মামলা করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
যৌতুক নিরোধে আইনগত সেবা
যৌতুকের জন্য নির্যাতিত নারীরা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (বিভাগীয় পর্যায়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অবস্থিত), বিভিন্ন বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জরুরি চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন। যৌতুকের কারণে কোনো নারী নির্যাতিত হলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনগত সহায়তা উপ-পরিষদ তাদেরকে আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করে। যৌতুক নিরোধে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আইনগত সেবা দিয়ে থাকে। যেমন-বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, মহিলা আইনজীবী সমিতি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট ইত্যাদি।
যৌতুক সামাজিক রোগ
যৌতুক নামক সামাজিক রোগ বন্ধ হলে স্ত্রীরা স্বামীদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হবে না, হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে অকালে মারা যাবে না। একাধিক সন্তানসহ নারীকে ঘর সংসার হারাতে হবে না। তাই আসুন আমরা তরুণদের মধ্যে যৌতুকবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলি, যৌতুক বিহীন বিয়েতে তাদের উৎসাহিত করি, তরুণীদের আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করি। নারী ও পুরুষ উভয়কে সমভাবে শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ প্রদান এবং তাদের সম-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করি। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করি। যৌতুক নামক মানবিক অপরাধ ও নির্যাতন থেকে আমরা মা-বোনদের রক্ষা করি।