মোসাহেবি বা চাটুকারিতার অনুশীলন কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। মোসাহেবি রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিবীদ নেতা-কর্মীদের ভাগ্যের বদল হতে পারে তবে জনগণের কোনো লাভ হয় না। মোসাহেবি সমাজের মোসাহেবি প্রথা আর চামচামি করার প্রবণতা পুরো স্বাভাবিক সিস্টেমটাকেই অচল, অসুস্থ ও অগ্রহণযোগ্য করে দিতে যথেষ্ট!
চাটুবৃত্তি এক ধরনের মানসিক দাসত্ব! চাটুকাররা পর নির্ভরশীলতা পছন্দ করেন, ঋণী হতে পছন্দ করেন। কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের মাথার উপর যখন পয়সাকড়ির চাপ প্রবল হয় আর সেই পয়সাকড়ি আয়ের জন্য দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রয়োজন হয়; তখন তার পক্ষে মৌলিক কিছু সৃষ্টি করা বড্ড কঠিন!
কারণ তারা মাধ্যমটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন না বরং মাধ্যমটিসহ নিজের মস্তিষ্ককেও অন্যকে খুশি করতে কাজে লাগান। তবে চাটুবৃত্তি করে সম্মানজনক ও মর্যাদাজনক জীবন-জীবিকা মিলে না; মাঝে মাঝে অপমান সহ্য করা আর পশুর মতো বেঁচে থাকা ছাড়া কোনো লাভ নেই। চামচা মনে করে নিরাপদ জীবন নিশ্চিত হলেই হলো; যদিও তার এ জীবন অর্থহীন, এর কোনো সার্থকতা নেই।
কিছু কিছু মানুষ রয়েছে যাদের জন্মই হয়েছে যেন চাটুবৃত্তি করবার জন্যে! এরা অন্যের মন পেতে বা তাদের মনোরঞ্জনে নিজের বাকশক্তি ও চিন্তাশক্তিকে উৎসর্গ করেন। চাটুভাষিণী নারী ও চাটুভাষী পুরুষ অন্যের চিত্তরঞ্জনে ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দেন। অনকে শক্তিমানের মিথ্যা প্রশংসা করে সুযোগ সুবিধা বগলদাবা করেন, স্তাবকতা করেই উত্তাল ময়দানেও স্বস্তি ও প্রশান্তির সাথে নিরাপদে টিকে থাকেন।
যারা চাটুবৃত্তির পথ অবলম্বন করেন তারা পরের মনোযোগ পেতেও মিথ্যা বলেন এবং নিজের বোধবুদ্ধিকেও অনেক সময় তুচ্ছজ্ঞান করেন। নিজেকে অবহেলা ও উপেক্ষা করে হলেও স্বার্থের প্রয়োজনে চাটুকারিতা করতে দ্বিধা করেন না। নির্লজ্জ স্তাবকের স্বার্থমুখী স্তাবকতা মানহীন প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হলেও খয়ের-খাঁদের শেষ পরিণতি হয় ভযাবহ।
চাটুবৃত্তি আছে সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রেও। অনেক সময় বসের তোষামদি আর সরকারের চাটুবৃত্তির চেয়েও সাহিত্যের চাটুবৃত্তি হয় বেশি দূর্ভাগ্যের; কারণ এসবের মাধ্যমে দাসত্বের মানসিকতা দীর্ঘদিন প্রজন্মের পর প্রজন্মে টিকে থাকে।
কিছু মানুষ আছে যারা যার চাটুবৃত্তি করেন, সামান্য স্বার্থেই তার প্রতি কৃতঘ্নতা দেখান। অবশ্য রাজনৈতিক চাটুবৃত্তি খুবই দেখা যায়, যার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলও খুব মারাত্মক। কেউ বসের চামচামি করে, কেউ নেতার চামচামি করে, কেউ মালিকের চামচামি করে।
চাটুক্তি বা চাটুবাদ লজ্জাস্কর ও ঘৃণিত বাস্তবতাকে হাজির করে! নির্লজ্জ চাটুবৃত্তির ফলেই দাস্যসুখে হাস্যমুখ দেখা যায়। চাটুবৃত্তি স্বভাব যার সে চাটুবৃত্তি করবেই, সুপারিশের কাঙালপনায় পৌরুষকে অপমানিত করবেই।
স্তাবকতা করে যে মানুষ বাঁচে, সে আসলে প্রকৃত মানুষ থাকে না। নিম্নমেধার স্তাবকদের ন্যূনতম বোধবুদ্ধি কাজ করে না, আর উচ্চমেধার স্তাবকদের কমনসেন্সই লোপ পায়। যারা স্তাবকতা করলে তাদের বেশি যোগ্য ভাবেন, তারা অধিকাংশই যোগ্যতায় নয় স্তাবকতা করেই ওঠে আসা।
পা ছুঁয়ে স্তাবকতা করলেই শত দোষ গুণে পরিবর্তিত হয়ে যায় না। নির্লজ্জ স্তাবকতা কখনো গ্রহণযোগ্য যোগ্যতা হতে পারে না। স্তাবকতা করতে না পারায় যারা কৃত্রিম আন্তরিকতা দেখানোয় ব্যর্থ হয়ে পেছনে থাকেন, তারা স্তাবকতা ছাড়াও সামনে যাওয়ার যোগ্যতা রাখার সম্ভাবনা আছে।
স্তাবকতা করে প্রথম সারিতে থাকার চেয়ে স্তাবকতা না করে প্রথম সারিতে না থাকাও ঢের সম্মানজনক। দুর্নীতিগ্রস্তরা স্তাবকতা করে সামনের সারিতে চলে আসেন! যারা স্তাবক পরিবৃত হয়ে থাকতে ভালোবাসে, তাদের অধিকাংশই জানে না স্তাবকতা কতটা ক্ষতি করে! কবিতায় স্তাবকতা, গানে স্তাবকতা, লেখায় স্তাবকতা, বলায় স্তাবকতা!
উন্নত রুচিবোধ সম্পন্নরা স্তাবকতা পছন্দ করেন না। আর রুচিহীনরা স্তাবকতাকে অভ্যাসে পরিণত করেন, স্তাবকতা করার শক্তি লাভ করেন। আসলে অন্যের স্তাবকতা করে নিজে বড় হওয়া যায় না; পশুকে মানুষ স্বীকৃতি দানকারী মানুষই নিজেকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে আনে। অযোগ্য স্তাবক কখনো জয় করতে পারে না, বিজয়ীও হয় না, অর্জনও থাকে না; তবে দখল করতে পারে, কেড়ে নিতে পারে, হামবড়া ভাব ধরতে পারে।
স্তাবকতা যুক্তিবোধহীনতাকে আশ্রয় করেই দিনে দিনে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। যুক্তিবোধহীন বিরোধিতার মানসিকতা থেকেই নিঃশর্ত ক্রীতদাসত্বের এই প্রবণতাটি তৈরি হয়। স্তাবকতার জন্যে বিশেষ যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। হীন স্তাবক দালাল হিসেবে উপযুক্ত হতে পারেন, কাজের বিনিময়ে অর্থ-অনুগ্রহ-বখশিশ-পুরস্কার পেতে পারেন; তবে নড়বড়ে অবস্থান থেকে কখনো মজবুত অবস্থানে পৌঁছাতে পারেন না।
স্তাবকতায় কারো প্রকৃত কোনো লাভ হয় না। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে স্তাবক হওয়া মেরুদণ্ডহীন-ব্যক্তিত্বহীন কমেডিয়ান বানিয়ে ছেড়ে দেয়! নেক নজরে থাকতে নির্লজ্জ দলদাস বা ব্যক্তির দাসরাই স্তাবকতা ছড়াতে সক্ষমতা প্রদর্শন করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে- আজকালতো ভালোকে খারাপ এবং খারাপকে ভালো বলে স্তাবকতা করতে পারলেই তোষামোদকারীর নম্বর বেশি; সুবিধাভোগীর সুযোগও বেশি, কদরও বেশি!
স্তাবকরা অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় অতিপ্রশংসা করেন, তোষামোদ করেন, অতিভক্তি প্রদর্শন করেন। যখন সকলে মিলে স্তাবকতা আর তোষামোদিতে ব্যস্ত হন তখন পতন ত্বরান্বিত হয়। স্তাবকতা না ছাড়লে অনাকাঙ্ক্ষিত পচন থেকে বাঁচাও যায় না, বাঁচানোও যায় না। স্তাবকতা না ছাড়লে শিরদাঁড়া সোজা হয় না, স্তাবক কোনো সম্মানও পায় না! স্তাবকতা করে ভাব দেখানোর কিছু নেই, যেমন পা চাটাতে গর্বের কিছু নেই!
অনেকে গোপনে নয়, প্রকাশ্য দিবালোকেই স্তাবকতা আর প্রশংসা শুনতে চাওয়ার লোভ প্রকাশ করে। ফলে স্তাবকতাও এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তা তেলবাজী তৈলমর্দন আর তোষামোদের পথে অ্যারাবিয়ান হর্সের গতিতে দৌঁড়াতে থাকে। অথচ স্তাবকতা ও স্তুতি করে অর্জনের চেয়ে বর্জনই বেশি শ্রেয়! স্তাবকতায় অভ্যস্ত হওয়া চরম বেহায়াপনা!তাঁবেদারিমুক্ত প্রশাসন দালালির চরিত্র পরিবর্তন করলেই কেবল টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।
মোসাহেবের সাপ্লাই যতই হোক, এদের ডিমান্ড কম, বেশিদিন আবেদন থাকে না! মোসাহেবির পারঙ্গমতা যতই থাকুক, এটি একটি সর্বব্যাপী ব্যাধি মাত্র! নিজের স্বার্থ হাসিল করতে সাময়িকভাবে কিছুটা সহায়ক হলেও মোসাহেবি করে জানোয়ারের মতো জীবনই যাপন করা যায়! সারাক্ষণ অবাস্তব প্রশংসা করা মোসাহেবদের জন্য সোজা কাজ নয়, কখনো কখনো বিপজ্জনকও। তেল মারায় ব্যস্ত পদলেহী চামচারা কর্মদক্ষতা বাড়ানোর সময় পান না, ফলে আজীবন নতজানু হয়েই কাটাতে হয়।