মুক্তবাজার অর্থনীতি : উন্নত বিশ্বের ভন্ডামী

মো. ইজাজুর রহমান (সৌমিক) : এ পর্যন্ত বিশ্বে যত ধরনের অর্থনৈতিক মতবাদ আবির্ভূত হয়েছে তাকে তিনটি বিশেষ শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথমত, পুঁজিবাদী অর্থনীতি যা সৃষ্টির আদি থেকেই চলে আসছে। দ্বিতীয়ত, ইসলামী অর্থনীতি যা ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে শুরু এবং তৃতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি যা গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সৃষ্ট।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল বক্তব্যই হচ্ছে যেভাবে পার উৎপাদন বাড়াও, সুফল ভোগ করো এবং নিজের সম্পদের পাহাড় দ্রুত স্ফীত করো। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ব্যক্তির সৃজনশীলতাকে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ব্যক্তি রাষ্ট্রের অধীন দাস মাত্র। অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত সৃজনশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হলেও তাকে কোনোভাবেই স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ দেয়া হয়নি।

বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির দ্বারা। এ পুঁজিবাদী অর্থনীতির আরেকটি রূপ হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতি পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিরই অপর নাম। কেননা এই নাম নিয়ে যত সহজে বিভ্রান্তি ছড়ানো যায় সরাসরি পুঁজিবাদ অথবা সাম্রাজ্যবাদের গুণগান ও জয়কীর্তন করে তত সহজে কাজ হাসিল করা যায় না। আর পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধারক বাহক হচ্ছে উন্নত বিশ্ব এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য পূরনের একটি কৌশল মাত্র।

মুক্তবাজারের মূলনীতি হচ্ছে- বাজার হবে সর্বদা ক্রেতার বাজার। বাজারে প্রতিযোগিতা হবে, একাধিক ব্যবসায়ী বাজারে পণ্য নিয়ে আসবে। এতে বাজারে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। প্রতিযোগিতায় দাম কমে যাবে এবং ক্রেতারা কম দামে পণ্য ক্রয় করতে পারবে। কিন্ত মুক্তবাজারের এ নীতি অনুন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে অচল। কেননা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণের অভাব ঘটে। নেতিবাচকভাবে স্বার্থপর ব্যবসায়ীরা সীমাহীন মুনাফা লাভের চেষ্টা করে। আবার পূর্ণ প্রতিযোগিতার অভাবে সমগ্র সমাজে একচেটিয়া বা অস্থির বাজার পরিস্থিতি বিরাজ করে।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণের অভাব বা নেতিবাচক উপজাত দ্রব্যাদির তৈরির দরুন সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিয়ন্ত্রণের অভাবে বাজারমূল্যের স্থিতিস্থাপকতা আসে না। তাতে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পেয়ে আয় ও সম্পদের অসম বন্টন ও দারিদ্র বৃদ্ধি পেতে পারে। নিয়ন্ত্রণের অভাবে উৎপাদনমুখী নয়, এমন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নীতি সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

মুক্তবাজার অর্থনীতি খুবই উদার ও উৎপাদনমুখী, এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণের অভাবে অপূর্ণ প্রতিযোগিতার কুফল, নেতিবাচক বা সামাজিকভাবে ক্ষতিকারক উপজাত দ্রব্যাদি তৈরি, সুষ্ঠু আন্তর্জাতিক এবং অর্থনৈতিক রীতি-নীতির অভাব, বাজারমূল্যের অস্থিতিস্থাপকতা, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি ও আয়ের অসম বন্টন ইত্যাদি অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এ অর্থনীতিতে তাই নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে সরকারকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হয়।

যেটি আমরা উন্নত বিশ্বে লক্ষ্য করি। উন্নত বিশ্ব একটি সময় পর্যন্ত তার বাজারকে ঠিকই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা অন্যদের ক্ষেত্রে অবাধ বানিজ্যের বিধান আর নিজের ক্ষেত্রে যতক্ষণ না বাজারের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করতে পারে ততদিন অবাদি ‘বাণিজ্য শৃংখলা’ আরোপ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত জাপান তার বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল।

বর্তমান বিশ্বের অর্থনেতিক শক্তি চীন এবং ভারতও তাদের বাজারকে বহু বছর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এ সকল রাষ্ট্রগুলো তার বাজারকে তখনই মুক্ত করে দেয় যখন তারা মনে করলো যে বাজার উন্মুক্ত করায় তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। এবার আমরা উন্নত এবং অনুন্নত বিশ্বের উপর মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্ব অনুন্নত বিশ্বের সাথে কিভাবে ভন্ডামী করছে সেটি দেখবো।

বহি:বিশ্বের চাপে বলিভিয়া মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশের জন্য তার দেশের বানিজ্যিক বাধা নিষেধ কমিয়ে আনে, যে বাধা নিষেধ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও নিম্ন পর্যায়ের। শুধু বাধা নিষেধ কমিয়ে আনাই নয় একই সংজ্ঞে বলিভিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞে সহযোগিতার মাধ্যমে কোকা উৎপাদন দৃশ্যত নির্মূল করে যা ছিল কোকেন তৈরির মূল উপাদান।

এ কোকা ফসলটি বলিভিয়ার দরিদ্র কৃষকদের অধিক আয় নিশ্চিত করতো। কিন্ত এর উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় বিকল্প ফসল দ্বারা কৃষকরা পূর্বের ন্যায় অধিক আয় করতে পারতো না। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে য়ুক্তরাষ্ট্র বলিভিয়া থেকে কৃষিজ সামগ্রীর জন্য তাদের বাজার বন্ধ দেয়। যেমন- চিনি, যা বলিভিয়রা রফ্তানীর জন্য উৎপাদন করে থাকে। এর জন্য কি আমেরিকার বাজার উন্মুক্ত হয়েছে?

সাধারণত বলা হয় যে, কোন দেশের বাজার উন্মুক্ত না হলে ঐ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয় না এবং এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয় না। কিন্তু যদি চীনের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, চীন যদিও সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ লাভ করেছে, তারপরও তারা কিন্তু পশ্চিমাদের পরামর্শ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা পত্রই অনুসরন করেনি এবং সাবধানী ও সতর্কতার জন্য তারা পরিপূর্ন বাজার উন্মুক্ত করা থেকে বিরত থাকে।

পূর্ব এশিয়ার অধিক সফলতা সম্পন্ন উন্নয়নশীল দেশ যেমন মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান নিজেদের বাজারকে বহি:বিশ্বের কাছে খোলা মেলা করেছিল খুবই ধীর স্থিরভাবে এবং কিছু নিয়ম নীতি মেনে। এসব দেশ বিশ্বায়নের সুযোগ গ্রহন করে তাদের রফতানী বাড়িয়েছিল এবং এভাবেই দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। এসকল দেশগুলো তার বাজার ব্যবস্থার উপর থেকে সংরক্ষণের দেয়াল তখনই যত্নের সংঙ্গে ও পর্যায়ক্রমে অপসারন করেছিল যখন তারা মনে করলো যে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং এর জন্য পর্যাপ্ত পুঁজির প্রবাহ রয়েছে।

১৯৬০ এর দশকেও কেনিয়া ছিল একটি ধনী ও উর্বর রাষ্ট্র। কিন্ত আই এম এফ এর পরামর্শে উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ায় কেনিয়ায় সংকটের সূচনা হয়। বলা হয়ে থাকে কেনিয়ার এ সংকটে সুদের অতি উচ্চহার আই এম এফ এর পরামর্শেই ঘটেছিল। ফলে তাদের সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এ সংকট থেকে তারা আজ পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারেনি।

১৯৮৮ সালে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন কার্লোস মেনেম। এ সময় আর্জেন্টিনার মুদ্রাস্ফীতির বার্ষিক হার ছিল ৪৯.২৩ শতাংশ। এ মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে তিনি বিশ্ব ব্যাংক এবং আই এম এফ এর পরামর্শে চালু করলেন কাঠামো গত সংস্কার। এ সংস্কারের মধ্যে রয়েছে- সরকারী খরচ কমিয়ে বাজেট ঘাটতি কমানো, সরকারী প্রতিষ্ঠানের বেসরকারীকরন, বিদেশি পন্য আমদানী, বিদেশি বিনিয়োগের উপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া, ইচ্ছেমত শ্রমিক ছাটাই এর সুযোগ করে দেওয়া প্রভৃতি। এ সবই এক অর্থে চাপিয়ে দেওয়া মুক্ত বাজার অর্থনীতিরই একটি রূপ।

এর ফলে আর্জেন্টিনার পুরো চেহারাটাই বদলে গিয়েছিল। বড় বড় শহরগুলি ভরে উঠেছিল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং চেইন শপে। বুয়েনস্ আয়ারস শহরটি ছেয়ে যায় মার্কিন কায়দায় শপিংমলে। আর এসবই ঘটে আর্জেন্টিনার অর্থমন্ত্রী পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ডোমিনগো কাভাল্লোর ‘কারেন্সী পেগিং’ নীতির কারনে। তিনি আই এম এফ এর পরামর্শে এ নীতি চালু করেন। এ নীতির ফলে ২০০০ সালে দেশটির ঋণের পরিমান দাড়ায় ১৩,২১৪ কোটি ডলার এবং দেশটি ব্যাপকভাবে বানিজ্য ঘাটতির সম্মূখীন হয়। ফলে আর্জেন্টিনা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সম্মূখীন হয়।

বর্তমানে উন্নত বিশ্বের যে সকল রাষ্ট্রগুলো মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচারের কথা বলছে তাদের দেশেই লক্ষ লক্ষ লোক কাজ হারিয়ে বেকার হচ্ছেন, বাসস্থানের অভাবে সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ লক্ষ লোক ফুটপাতে, ব্রীজের নীচে অথবা গাছতলায় রাত্রি যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বাজার অর্থনীতির সবোর্চ্চ বিকাশ যে দেশগুলোতে হয়েছে সে দেশগুলো যখন সংকটগ্রস্থ, তখন অনুন্নত দেশগুলোর এ মুক্তবাজার নীতির কারনে কি অবস্থা হয় তা সহজেই অনুমেয়।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *