মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় অহংকার

মানুষের একটি মারাত্মক মানসিক ও চারিত্রিক ব্যাধি অহংকার। অহংকার করে জেনেও কোনো ব্যক্তিই অহংকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না। এই রোগের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। অহংকারী ব্যক্তি চরম ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত। যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতেও যেতে পারবে না।

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন

অহংকার কী?

অহংকারের আরবী নাম কিব্র (الْكِبْر)। যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করাই এর অন্তর্নিহিত অর্থ। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।

কিবর হলো ‘তাওয়াদু’ বা বিনয়, ‘খুশু’ (ভীতি) ও ‘খুদু’র (নম্রতা) বিপরীত। হাদিসের পরিভাষায় অহংকার হলো- ‘সত্যকে অস্বীকার করা; মানুষকে হেয় করা।’ নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় জানা এবং অন্যকে তুচ্ছ-নিকৃষ্ট মনে করাই অহংকার।

অহংকার বা দাম্ভিকতা বা ঔদ্ধত্য বলতে বোঝায় অতিমাত্রায় গর্ব করা বা নিজেকে চরমভাবে অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করার আচরণ। এটি হলো বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীনতা আর নিজের সক্ষমতাকে অতিমূল্যায়ন করা।

অহংকার হলো- কোনো বিষয়ে নিজেকে অন্যের তুলনা সম্মানিত বা বড় মনে করা। অহংকার হলো অর্থ-সম্পদ বা বয়সে বা ক্ষমতায় বড় হয়ে ছোট কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বা অবজ্ঞা করা বা হেয় করা।

আবু ওয়াহাব আল-মারওয়াযী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারককে প্রশ্ন করলাম ‘অহংকার’ (الْكِبْر) কাকে বলে? তিনি বললেন, মানুষকে হেয় জ্ঞান করা। পুনরায় প্রশ্ন করলাম, ‘আত্মম্ভরিতা’ (العُجْب) কাকে বলে? তিনি বললেন, তোমার কাছে যা আছে, অন্যের কাছে তা নেই বলে ধারণা করা।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনটি ধ্বংসকারী বস্ত্ত থেকে মানুষকে সাবধান করেছেন (১) প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া (২) লোভের দাস হওয়া এবং (৩) আত্ম অহংকারী হওয়া। তিনি বলেন, এটিই হ’ল সবচেয়ে মারাত্মক (وَهِيَ أَشَدُّهُنَّ)।

অহংকার সম্পর্কে ইবনু তায়মিয়াহ

শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক আল্লাহর ইবাদত করে এবং সাথে অন্যেরও করে’।

 কুফরীর মূল উৎস হলো অহংকার

হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, – সমস্ত পাপের উৎস হ’ল তিনটি : (১) অহংকার, যা ইবলীসের পতন ঘটিয়েছিল। (২) লোভ, যা জান্নাত থেকে আদম-কে বের করে দিয়েছিল। (৩) হিংসা, যা আদম (আঃ)-এর এক সন্তানের বিরুদ্ধে অপর সন্তানকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল।

যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি বস্ত্তর অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকতে পারবে সে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। কেননা কুফরীর মূল উৎস হ’ল ‘অহংকার’। পাপকর্মের উৎস হ’ল ‘লোভ’। আর বিদ্রোহ ও সীমালংঘনের উৎস হ’ল ‘হিংসা’।

অহংকার সম্পর্কে ইমাম যুবাইদি

ইমাম যুবাইদি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘অহংকার হলো নিজেকে বড় মনে করা, নিজের ভালো গুণে প্রীত হওয়া, অন্য মানুষকে নীচ ও ছোট মনে করা, যাদের প্রতি বিনয়ী হওয়া দরকার তাদের চেয়ে নিজকে উঁচু মনে করাই অহংকার।

অহংকারীর কিছু ধরন

নিজেকে নিরহংকার ভেবে অনেকে মনের অজান্তেও অহংকারী হয়ে ওঠে। আবার অনেক সময় কিছু কথা ও ভাব এভাবে ফুটে ওঠে-

১. সে কিছুই জানে না এমনভাবে চলাফেরা করলেও মনে মনে ভাবে- সে বেশি বা অনেক জানে।

২. যে কোনো বিষয়ে নিজেকে অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ জানা।

 

৩. অন্যকে তুচ্ছ বা চুনোপুঁটি ভাবা।

৪. কাউকে ছোট লোক বা ছোট লোকের বাচ্চা মনে করা।

৫. এখানকার সবার কাছে পরিচিত বলে ভাব নেওয়া।

 

৬. আমিত্ব ভাব প্রকাশ করা যেমন- আমি না হলে…; আমি না থাকলে…।

৭. এমন বলে ভাব নেওয়া- যা করেছি তা শুধু তোদের জন্য….।

৮. অন্যকে বোকা বা মূর্খ আখ্যায়িত করে বলা- আরে, তার কথা বলেন না! আমি না থাকলে ওর কোনো কিছুই হতো না বা ভাতও জুটতো না… ইত্যাদি।

দুনিয়ায় প্রথম অহংকারী  শয়তান

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ব প্রথম অহংকারী ও দাম্ভিকতা প্রদর্শনকারী হলো- শয়তান। অহংকার করে হজরত আদমকে আ. সিজদা করতে আল্লাহর নির্দেশের অমান্য করে এবং তার শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি ঘোষণা করে। যে কারণে ‘মুয়াল্লেমুল মালায়েকা’ খ্যাত ইবলিসকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল।

আল্লাহ বললেন, ‘কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছে যে, (আদমকে) সিজদা করছ না; যখন আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি’? সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১২)

অহংকারই দুনিয়ার প্রথম পাপ

আল্লাহ তাআলা সব ফেরেশতাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সেজদা কর। সব ফেরেশতা সেজদা করলেও অহংকারবশতঃ ইবলিসই তা অস্বীকার করেছিল এবং অমান্য করেছিল। আর সেটিই ছিল দুনিয়ার প্রথম পাপ, পৃথিবীর প্রথম অহংকারের সূচনা।

আল্লাহ তাআলা  বলেন- এবং যখন আমি হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলিস ব্যতিত সবাই সেজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করলো। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৩৪)

অহংকার পাপের জননী

অহংকার একটি মারাত্মক ব্যাধি। পৃথিবীর প্রথম পাপ কাজ হলো অহংকার। এ অহংকারের কারণেই ইবলিস আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অমান্য করে নজির স্থাপন করেছিল। আরবিতে এ অহংকারকে উম্মুল আমরাজ বা সব রোগের জননী বলা হয়।

মানুষ কেন অহংকার করে?

১. যখন শয়তান তাকে কৌশলে গ্রাস করে ফেলে। তখন তার নিজের কথা, কাজ ও কৌশলকে নিখুঁত, নির্ভেজাল ও সর্বোত্তম ভাবতে শুরু করে। অন্যের বিশ্বাস, কথা ও কাজকে সন্দেহ করতে থাকে এবং  অন্যের ভুলকে বড় করে ধরে নিজের গৌরবকে ফুটিয়ে তোলে।

২. নিজের বোকামি থাকলে অন্যকেও বোকা মনে করে; যা প্রকান্তরে অহংকার।

৩. নিজের বড় বড় ত্রুটি ঢাকতে অন্যের ত্রুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

৪. আল্লাহর ভয় কম থাকলে বা না থাকলে অহংকার ঢুকে যায়।

৫. নিজের আশ-পাশে চাটুকার ও অযোগ্য লোক থাকলেও লোকেরা অহংকারী হয়ে যায়।

৬. নিজে যা পাবার যোগ্য তার চেয়ে বেশি পেয়ে গেলেও মানুষে অহংকারী হয়ে যায়।

৭. নিজের প্রশংসা অন্যের মুখে বেশি করে শুনতে থাকলেও মানুষ অহংকারী হয়ে যায়।

৮. নিজের আত্মসমালোচনা যত কম হয়, অহংকার ততবেশি পেয়ে যায়।

৯. অন্যের মুখে নিজের সমালোচনা শোনার ধৈর্য্য কমে গেলেও আস্তে আস্তে মনে অহংকার ঢুকে পড়ে।

১০. কথা-কাজ-আচরণে বিনয় কমে গেলে অহংকার জায়গা করে নিতে থাকে।

অহংকারের ক্ষতি বা কুফল

অহংকারের ক্ষতি বা কুফল অনেক বেশি। অহংকারী ব্যক্তি যেহেতু নিজেকে অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে; তাই সে সাধারণত সবার সঙ্গে ওঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা, কথা-বার্তা বলাকে নিজের মর্যাদাহানি মনে করে। যখন মানুষের সামনে যায় বা মেশে; তখন এমনটি কামনা করে যে, মানুষ তাকে সম্মান করুক; মর্যাদা দেওয়া হোক।

এ কারণেই আল্লাহ তাআলা অহংকারীকে পছন্দ করেন না মর্মে কোরআনে ঘোষণা এসেছে-‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নেবে না। আর জমিনে দম্ভভরে চলাফেরা করবে না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক; অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৮)

অহংকারীর ইবাদত কবুল হয় না। আত্ম-অহংকার মানুষকে অন্ধ করে দেয়, তখন সে ন্যায়–অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।অহংকার সাধারণত মানুষের ক্ষতি করে। অহংকার নেতিবাচক মানসিকতার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়।

অহংকারীর পরিণতি জাহান্নাম

রাসুলুল্লাহ সা. ঘোষণা করেছেন, যার অন্তরে অহংকার আছে সে জান্নাতে যেতে পারবে না। অহংকারী ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম। হাদিসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যার অন্তরে এক যাররা (অনু) পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম, মিশকাত)

রাসুলুল্লাহ সা. অহংকারীদের ব্যাপারে মুমিন বান্দাকে সতর্ক করেছেন। তিনি তার উম্মতকে হুশিয়ার করে দিয়ে জানিয়েছেন কারা হবে জাহান্নামি। হাদিসে এসেছে- হজরত হারিসাহ ইবনু ওহাব খুযায়ী রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জান্নাতীদের সম্পর্কে জানাবো না? (তারা হলেন) : ওই সব লোক- যারা অসহায় এবং যাদের তুচ্ছ মনে করা হয়। তারা যদি আল্লাহর নামে শপথ করে, তাহলে তা তিনি নিশ্চয়ই পুরা করে দেন। আমি কি তোমাদের জাহান্নামীদের সম্পর্কে জানাবো না? তারা হলো- কর্কশ স্বভাবের অধিকারী; শক্ত হৃদয়ের অধিকারী এবং অহংকারী।’(বুখারি)

প্রিয়নবি সা. বলেছেন, ‘যার অন্তরে তিল পরিমাণ অহংকার থাকবে; সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যার অন্তরে তিল পরিমাণ ঈমান রয়েছে সে জাহান্নামে যাবে না।’ (তিরমিজি)

অহংকারী হয়ে উঠার কারণ

কারও প্রতি ভদ্রতা ও ভালোবাসার অভাবের ফলেও অহংকার তৈরি হয়ে থাকে। এর উদাহরণ হলো নিজেকে অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া ও নিজেকে আলাদা ভাবা। অহংকারী পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুরা নিজেরাও অহংকারী হয়ে উঠতে পারে।

নিরাপত্তাহীনতা থেকেও অনেক সময় অহংকার জন্ম নিতে পারে। আর আত্মবিশ্বাস হল মূলত নিজের দুর্বলতাকে যাচাই করা ও তা কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।

অহংকার থেকে মুক্ত থাকতে করণীয়

দুনিয়া ও পরকালে অহংকারের ক্ষতি ও ভয়াবহতা থেকে মুক্ত থাকতে মুমিন মুসলমানের উচিত, কোনোভাবেই অহংকার না করা। দাম্ভিকতা বা বড়ত্ব পরিহার করা।

অহংকার মুক্ত থাকতে এ দোয়াটি বেশি বেশি করা- ‘হে আমাদের প্রভু! নিশ্চয় আমরা আমাদের নফসের উপর অত্যাচার করেছি, আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবো।’(সুরা আরাফ : আয়াত ২৩)

অহংকারী ব্যক্তি বড় গোনাহগার

কুরআন-সুন্নাহর বর্ণনায় অহংকার অনেক বড় গোনাহ। অহংকারের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছিল দুনিয়ায় প্রথম পাপ। শয়তানের অনুসরণে যে বা যারা অহংকার করবে তারাও বড় গোনাহগার। এই কবিরা গোনাহ আল্লাহ তাআলা সহ্য করেন না।

অহংকার বশতঃ যদি কেউ আল্লাহ নির্দেশ অমান্য করে তবে সে ব্যক্তি অস্বীকারকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যেমনিভাবে ইবলিস আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।

অহংকার পতনের মূল

আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি (তোমাদের ডাকে) সাড়া দেব। যারা আমার ইবাদত নিয়ে অহংকার করে তারা শীঘ্রই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা মুমিন : আয়াত ৬০)

যারা আল্লাহ তাআলার দাসত্বকে লজ্জাবোধ করবে কিংবা আল্লাহকে প্রভু বলে মেনে নিতে অহংকার করবে, তাদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা হজরত ঈসা আ. ও ফেরেশতাদের উদাহরণ উল্লেখ করে ঘোষণা দেন- মসীহ (ঈসা) আল্লাহর বান্দা হবেন, তাতে তার কোনো লজ্জাবোধ নেই এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাদেরও (আল্লাহর দাসত্ব করবে তাদেরও) লজ্জাবোধ নেই। বস্তুতঃ যারা আল্লাহর দাসত্ববোধকে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে, তিনি তাদের সবাইকে (পরকালে) নিজের কাছে সমবেত করবেন।

অতঃপর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তিনি তাদেরকে পরিপূর্ণ সওয়াব দান করবেন, বরং স্বীয় অনুগ্রহে আরও বেশী দেবেন। পক্ষান্তরে যারা লজ্জাবোধ করেছে এবং অহংকর করেছে তিনি তাদেরকে দেবেন বেদনাদায়ক শাস্তি। আল্লাহকে ছাড়া তারা কোনো সাহায্যকারী ও সমর্থক পাবে না। (সুরা নেসা : আয়াত ১৭২-১৭৩)

অহংকারী জান্নাতে যাবে না

অহংকারের কারণেই ইবলিস বিতাড়িত হয়েছিলেন জান্নাত থেকে। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করতে গিয়েও অহংকারের অপরাধে কথা সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘তুমি এ স্থান থেকে নেমে যাও; এখানে থেকে অহংকার করবে তা হতে পারে না। সুতরাং বের হয়ে যাও। তুমি অধমদের অন্তর্ভূক্ত।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১৩)

অহংকার মানুষকে অন্যায়ের দিকে ধাবিত করে। যে কারণে আল্লাহ তাআলা অহংকারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৮)

অহংকার জান্নাতের অন্তরায়, জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তাই মুমিন মুসলমানের অহংকারমুক্ত থাকা জরুরি। হাদিসে এসেছে-‘যার অন্তরে এক যাররা (অণু) পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম, মিশকাত)

অহংকারী অনেক নেয়ামত থেকে বঞ্চিত

অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না। তিনি অহংকারী ব্যক্তিকে অনেক নেয়ামত থেকে বঞ্চিত রাখবেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন-‘দুনিয়াতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার নিদর্শনাবলী থেকে বিমুখ রাখবো।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১৪৬)

ঈমানের বিপরীতে অহংকার

জান্নাতে যেতে হলে বা পরকালের চূড়ান্ত সফলতা পেতে হলে অবশ্যই তাকে অহংকারমুক্ত থাকতে হবে। অহংকারের ফলেই যুগে যুগে বড় বড় নেতা তথা ফেরাউন, নমরুদ, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা এবং আবু জাহেলরা সত্যকে মেনে নিতে পারেনি।

হাদিসে পাকে জান্নাতের বিপরীতে যেভাবে জাহান্নামের কথা বলা হয়েছে তেমনিভাবে হাদিসে ঈমানের বিপরীতে অহংকারের কথা বলে মুমিন মুসলমানকে সতর্ক করা হয়েছে। যাতে মুমিন ব্যক্তি অহংকার ত্যাগ করে ঈমানকে মজবুত করতে পারে। অহংকার থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

অহংকার আল্লাহর চাদর

অহংকার আল্লাহর চাদর। যে ব্যক্তি অহংকার নিয়ে টানাটানি করবে, আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না বরং ধ্বংস করে দেন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- বড়ত্ব আমার কুদরতের চাদর আর মহানত্ব আমার পরিধেয় (ইজার-লুঙ্গি)। কেউ যদি এ দুইটির কোনো একটির ব্যাপারে আমার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় তবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।’ (মুসলিম, মিশকাত)ৎ

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি বলল- (হে আল্লাহর রাসুল!) প্রত্যেক ব্যক্তিই তো এটা চায় যে, তার কাপড়খানা সুন্দর হোক, তার জুতা জোড়া উত্তম হোক। (এটাও কি অহংকারের অন্তর্ভূক্ত?)

রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহ স্বয়ং সুন্দরকে ভালোবাসেন। (অর্থাৎ উত্তম পোশাক পরা অহংকারের অন্তর্ভূক্ত নয় বরং তা সৌন্দর্যের অন্তর্ভূক্ত।) প্রকৃতপক্ষে অহংকার হলো- সত্যের পরোয়া না করা আর অন্যকে হীন, নিকৃষ্ট বা অধম মনে করা।’ (মুসলিম)

সুন্দর পোশাক পরা অহংকার নয়

সুন্দরের বহিঃপ্রকাশ উত্তম পোশাক পরা। যার যার অবস্থান-সামর্থ্য-ক্ষমতা-মর্যাদা অনুযায়ী সুন্দর ও উত্তম পোশাক পরা ইসলামের নির্দেশনা ও আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের শোকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। নিজেকে উত্তম-সুন্দর-মার্জিত পোশাকে প্রদর্শন করায় কোনো অহংকার নেই।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহকে সা. জিজ্ঞাসা করলাম- হে আল্লহার রাসুল! আমার মনোরম ও উত্তম কাপড় পরা কি গৌরব ও অহংকার হবে? তিনি বললেন- ‘না’, এটাতো সৌন্দর্য আর আল্লাহ তাআলা সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন।’ (ইবনে মাজাহ)

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে আরও একটি বর্ণনা রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা.বলেছেন, ‘নামাজ আদায় করার জন্য উত্তম কাপড় পরবে (অর্থাৎ পরিপূর্ণ পোশাক পরে সেজে-গুজে যাবে)। ওই ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যধিক যোগ্য যে, মানুষ তাঁর দরবারে উপস্থিতির সময় (অর্থাৎ নামাজ আদায়ের সময়) ভালোভাবে সেজে-গুজে যাবে।’ (মিশকাত)

হজরত আবু আহওয়াছ রা. এর বাবা নিজের একটি ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, আমি একবার রাসুলুল্লাহর সা. দরবারে খুব নিম্নমানের কাপড় পরিধান করে উপস্থিত হলাম।

তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কী কোনো ধন-সম্পদ আছে?

আমি বললাম- জ্বী, আছে।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- কী ধরণের ধন-সম্পদ আছে?

আমি বললাম- আল্লাহ তাআলা আমাকে উট, গরু, বকরি, ঘোড়া, গোলাম ইত্যাদি সব ধরণের ধন-সম্পদই দান করেছেন।

তিনি বললেন- আল্লাহ তাআলা যখন তোমাকে সব ধরণের ধন-সম্পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন তখন তোমার শরীরেও তাঁর দান ও অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ থাকা উচিত।’ (মিশকাত)

উত্তম জিনিসপত্র ব্যবহার অহংকার নয়

সুন্দর ও উত্তম কাপড় কিংবা ব্যবহৃত জিনিসপত্র ব্যবহারের আকাঙ্খাকে প্রিয় নবি সা. সমর্থন করেছেন, উৎসাহিতও করেছেন। সম্মতি দিয়েছেন উত্তম জিনিস ব্যবহারের। হাদিসে এসেছে-

এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহকে সা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার আকাঙ্ক্ষা হয় যে, আমার পোশাক অত্যন্ত উত্তম হোক, মাথায় তেল দেয়া থাকুক, জুতাগুলোও উত্তম হোক। এভাবে সে অনেকগুলো জিনিসের কথা বলল। এমনকি সে বলল- আমার আকাঙ্ক্ষা হয় যে, আমার হাতের লাঠিটিও অত্যন্ত সুন্দর হোক!

রাসুলুল্লাহ সা. তার উত্তরে বললেন, ‘এসব কথা পছন্দনীয়, আর আল্লাহ তাআলা সুন্দর রুচিকে ভালোবাসেন।’ (মুসতাদরেকে হাকেম)

অহঙ্কার যেভাবে ধ্বংস করে

অহংকার এমন এক মারাত্মক আচরণ। যা একজন বিনয়ী ও সফল ব্যক্তিকে তার সফলতার উচ্চস্থান থেকে মুহূর্তের মধ্যে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কোনো বক্তিকে গরিব বলে ছোট বললে অহংকার হবে না বরং তাকে হেয় করলেই তা অহংকার হিসেবে পরিগণিত হবে।

শ্রেষ্ঠত্ববোধ থেকেই আত্ম-অহংকার

ইবলিস আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ভিত্তি কোনো ভুল ধারণা কিংবা দ্বিধা-সংশয় নয়; বরং আত্ম-অহংকারই ছিল এর ভিত্তি। শ্রেষ্ঠত্ববোধ থেকেই ইবলিসের এ অস্বীকৃতি এসেছিল। হজরত কাতাদাহ র. বলেন যে, এই অহংকারের পাপই ছিল সর্বপ্রথম পাপ। যা ইবলিস হতে প্রকাশ পেয়েছিল।

আত্ম-অহংকারের কারণে ইবলিস তার গলদেশে অভিশাপের গলাবন্ধ পরিধান করেছে। মহান আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ে বিতাড়িত হয়েছে। এবং অহংকারের কারণে কোনো মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাই অহংকারমুক্ত জীবন গড়তে চেষ্টা করতে হবে। কারণ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করা বা সবার কাছে নিজেকে শ্রেষ্ঠ করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা, অন্যকে তুচ্ছ ভাবা ধ্বংসের কারণ।

অধিকাংশ পাপের উৎস অহংকার

অহংকারী কাফেরের জান্নাতে প্রবেশ করা ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ ছুঁচের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ অসম্ভব। অহংকারী ব্যক্তি স্বীয় অহংকারের উপরে দৃঢ় থাকে ও এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়। অহংকার তাই মারাত্মক পাপ। যা অন্য অধিকাংশ পাপের উৎস।

‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ার সমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না ছুঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি’ (আ‘রাফ ৭/৪০)।

অহংকার দমনেই মানুষের কৃতিত্ব

ধনে-জনে ও পদমর্যাদায় নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি মনের মধ্যে কোন তুচ্ছভাব উদ্রেক হওয়াটা অহংকারের লক্ষণ। অতএব এই স্বাভাবিক রোগ কঠিনভাবে দমন করা অবশ্য কর্তব্য।

‘অহংকার’ মানব স্বভাবের একটি নিকৃষ্ট অংশ। একে দমন করে সৎকর্মে লাগানোর মধ্যেই মানুষের কৃতিত্ব নির্ভর করে। মানুষের মধ্যে ষড়রিপু হ’ল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এর মধ্যে ‘মদ’ হ’ল দম্ভ, গর্ব, অহংকার।

‘মাৎসর্য’ হ’ল ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ৬টি আগুনের মধ্যে ‘মদ’ বা অহংকার ও আত্মম্ভরিতা হ’ল অন্যতম প্রধান স্ফুলিঙ্গ। যা একবার জ্বলে উঠলে ও নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানবগাড়ীটাকে খাদে ফেলে ধ্বংস করে ছাড়ে।

মালের আধিক্যে অহংকারী কারুন

অধিক ধন-সম্পদ মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে তোলে। মানুষ অনেক সময় এর কারণে অহংকারে স্ফীত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ কারুনের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘কারুন ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। আমরা তাকে এমন ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম, যার চাবিসমূহ বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না।’

… ‘সে বলল, এ সম্পদ আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চাইতে শক্তিতে প্রবল ছিল এবং সম্পদে প্রাচুর্যময় ছিল। আর অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না (তারা সরাসরি জাহান্নামে যাবে)’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৬, ৭৮)।

কারুনী ধন সবাই পেতে চায়। কিন্তু তা মানুষকে অহংকারী করে তোলে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমরা কারুনকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে ধ্বসিয়ে দিলাম। ফলে তার পক্ষে এমন কোন দল ছিল না, যে আল্লাহর শাস্তি হতে তাকে সাহায্য করতে পারে এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮১)।

 আত্মম্ভরিতা নিজেকে ধ্বংস করে

অহংকার ও আত্মম্ভরিতা দু’টিই বড়াই ও বড়ত্বের একক উৎস থেকে উৎসারিত। বস্ত্ততঃ এই রোগে যে আক্রান্ত হয়, সে নিজেকে নিজে ধ্বংস করে। তার দ্বারা সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্র এমনকি নিজ পরিবারও ধ্বংস হয়।

অহংকারী অন্যকে ছোট মনে করে

মূসা ও হারূণ (আঃ) ফেরাঊনের কাছে গেলে ‘তারা বলেছিল, আমরা কি এমন দু’ব্যক্তি উপরে বিশ্বাস স্থাপন করব যারা আমাদেরই মত এবং তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে’ (মুমিনূন ২৩/৪৭)।

মক্কার কাফের নেতারাও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে বেলাল, খোবায়েব, ছুহায়েব, ইবনু মাসঊদ প্রমুখ দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সরিয়ে দিতে বলেছিলেন, যাতে তারা তাঁর সঙ্গে বসে কথা বলতে পারেন। তখন আয়াত নাযিল হয়, ‘যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের ইবাদত করে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে সরিয়ে দিয়ো না। তাদের কোন আমলের হিসাব তোমার দায়িত্বে নেই এবং তোমার কোন আমলের হিসাব তাদের দায়িত্বে নেই। এরপরেও যদি তুমি তাদের সরিয়ে দাও, তাহ’লে তুমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/৫২)।

কিয়ামতে দুর্বলদের পায়ের নীচে থাকবে অহংকারীরা

অন্যকে হেয় গণ্যকারী ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন উঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তারা ঐসব দুর্বল শ্রেণীর লোকদের পায়ের নীচে থাকবে। এটি হবে তাদেরকে দুনিয়ায় হেয় জ্ঞান করার বদলা স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘অহংকারী ব্যক্তিগণ কিয়ামতের দিন উঠবে মানুষের রূপে পিঁপড়া সদৃশ। সর্বত্র লাঞ্ছনা তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। অতঃপর তাদের ‘বূলাস’ নামক জাহান্নামের এক কারাগারের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেখানে লেলিহান অগ্নি তাদেরকে ঢেকে ফেলবে। সেখানে তারা জাহান্নামীদের পোড়া দেহের গলিত পুঁজ-রক্তে পূর্ণ ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক নদী থেকে পান করবে।

অহংকারীর মধ্যে জাহেলিয়াত রয়েছে

একদিন ছাহাবী আবু যর গিফারী (রা.) নিগ্রো মুক্তদাস বেলাল (রা.)-কে তার কালো মায়ের দিকে সম্বন্ধ করে তাচ্ছিল্য করলে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘হে আবু যর! তুমি তাকে তার মায়ের নামে তাচ্ছিল্য করলে? তোমার মধ্যে জাহেলিয়াত রয়েছে’। আবু যর গিফারীর ন্যায় একজন নিরহংকার বিনয়ী ছাহাবীর একদিনের একটি সাময়িক অহংকারকেও আল্লাহর রাসূল (সা.) বরদাশত করেননি।

অহংকারী নিজের দুর্বলতা ঢেকে রাখে

মূসা (আ.) যখন ফেরাঊনকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর নিদর্শন দেখালেন, তখন ফেরাঊন ভীত হলো। কিন্তু নিজের দুর্বলতা ঢেকে রেখে সে তার লোকদের জমা করে ভাষণ দিয়ে বলল, ‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা’। ‘ফলে আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন’ (নাযে‘আত ৭৯/২৩-২৪)।

বস্তুত ফেরাঊনী চরিত্রের লোকের কোনো অভাব সমাজে নেই। সমাজ দুষণের জন্য এসব লোকেরাই প্রধানতঃ দায়ী। আজকাল নেতাদের গাড়ী বহর, মটর সাইকেল শোভাযাত্রা ও রাস্তায় রাস্তায় তোরণের ছড়াছড়ি ফেরাঊনী অহংকারের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

অহংকার বড় ফিৎনা

একবার হযরত উবাই ইবনু কা’ব রা. এর পিছনে পিছনে একদল লোককে চলতে দেখে খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব রা. তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করলেন। এতে চমকে উঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি হে আমীরুল মুমেনীন! জবাবে খলীফা বললেন, ‘এটা অনুসরণকারীর জন্য লাঞ্ছনাকর এবং অনুসৃত ব্যক্তিকে ফিৎনায় নিক্ষেপকারী’।

এখানে ‘ফিৎনা’ অর্থ অহংকার। অথচ উবাই বিন কা‘ব (রা.)-এর ন্যায় বিখ্যাত ছাহাবীর জন্য এরূপ ফিৎনায় পড়ার কোন অবকাশ ছিল না। কিন্তু খলীফা ওমর (রা.) চেয়েছিলেন উবাইয়ের মনের মধ্যে যেন কণা পরিমাণ অহংকারের উদয় না হয়। তিনি চেয়েছিলেন যেন তার এক ভাই অহেতুক অহংকারের দোষে দোষী হয়ে জাহান্নামে পতিত না হয়।

অহংকারী বড়ত্ব যাহির করে

একদল লোককে পেছনে চলার এরূপ দৃষ্টান্ত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা.) থেকেও এসেছে। তিনি তাঁর পিছনে অনুসরণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার যে কত পাপ রয়েছে তা যদি তোমরা জানতে, তাহ’লে দু’জন লোকও আমার পিছনে হাঁটত না এবং অবশ্যই তোমরা আমার মাথায় মাটি ছুঁড়ে মারতে। আমি চাই আল্লাহ আমার গোনাহসমূহ মাফ করুন’।

অহংকারী অসদ্ব্যবহার করে ও কঠোর হয়

মানুষের সাথে অসদ্ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি কঠোর হওয়া অহংকারের অন্যতম লক্ষণ। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একদিন জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎপ্রার্থী হলো। তিনি বললেন, তোমরা ওকে অনুমতি দাও। সে তার গোত্রের কতই না মন্দ ভাই ও কতই না মন্দ পুত্র! অতঃপর যখন লোকটি প্রবেশ করল, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তার সাথে অতীব নম্রভাবে কথা বললেন।

পরে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি লোকটি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলেন। আবার সুন্দর আচরণ করলেন, ব্যাপারটা কি? জবাবে তিনি বললেন, হে আয়েশা! ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই ব্যক্তি যাকে লোকেরা পরিত্যাগ করে ও ছেড়ে যায় তার ফাহেশা কথার ভয়ে’।

অহংকারী অন্যের হক নষ্ট করে

শক্তি ও প্রভাব খাটিয়ে বা বুদ্ধির জোরে অন্যের হক নষ্ট করা অহংকারের একটি বড় নিদর্শন। আল্লাহ কাউকে বড় করলে সে উদ্ধত হয়ে পড়ে এবং যার মাধ্যমে তিনি বড় হয়েছেন ও যিনি তাকে বড় করেছেন সেই বান্দা ও আল্লাহকে সে ভুলে যায়। সে এই কথা ভেবে অহংকারী হয় যে, আমি আমার শক্তি বা বুদ্ধির জোরে বা যোগ্যতা বলেই বড় হয়েছি। সুতরাং, যাদের ধন-সম্পদ থাকে না তারা অযোগ্য ও অক্ষম।

ফলে সে আর অন্যকে সম্মান করে না। সে তখন শক্তির জোরে বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অন্যের হক নষ্ট করে। এই হক সম্মানের হতে পারে বা মাল-সম্পদের হতে পারে। অন্যায়ভাবে কারু সম্মানের হানি করলে ক্বিয়ামতের দিন অহংকারী ব্যক্তিকে পিঁপড়া সদৃশ করে লাঞ্ছনাকর অবস্থায় হাঁটানো হবে। অথবা তাকে ঐ মাল-সম্পদ ও মাটির বিশাল বোঝা মাথায় বহন করে হাঁটতে বাধ্য করা হবে।

অহংকারী অধীনস্তদেরকে নিকৃষ্টভাবে খাটায়

অহংকারী  দুর্বলদের প্রতি সদ্ব্যবহার করে না, তাদের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলে না, উত্তম আচরণ করে না। বিশেষকরে অহংকারী মালিকেরা তাদের অধীনস্ত শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতি খারাপ আচরণ করে থাকে। এই স্বভাবের লোকেরা এভাবে প্রতিনিয়ত ‘হক্কুল ইবাদ’ নষ্ট করে থাকে।

অতঃপর তাদের হক পূরণ না করে নিজেরা ঘন ঘন হজ্জ ও ওমরায় যায়। আর ভাবে যে, সদ্য ভূমিষ্ট সন্তানের ন্যায় তারা পাপমুক্ত হয়ে ফিরে এল। আদৌ নয়। আল্লাহর হক আদায়ের মাধ্যমে কখনোই বান্দার হক বিনষ্টের কাফফারা আদায় হয় না। বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।

অহংকারী মিথ্যার উপর অটল থাকে

অহংকারী সত্যের দিকে ফিরে আসার চেয়ে মিথ্যার উপরে টিকে থাকাকে উত্তম মনে করে। ভুল স্বীকার করাকে নিজের পরাজয় মনে করে। মিথ্যা বা ভুলের উপর যিদ করা অহংকারের অন্যতম নিদর্শন। নবীগণ যখন লোকদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন, তখন তারা বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করতো এবং নিজেদের ভুল ও মিথ্যার উপরে যিদ করতো। যদিও শয়তান তাদেরকে (এর মাধ্যমে) জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তির দিকে আহবান করে (লোকমান ৩১/২১)।

কেবল কাফেরদের মধ্যে নয়, বরং মুসলমানদের মধ্যেও উক্ত দোষ পরিলক্ষিত হয়। যেমন শিরক ও বিদ‘আতে অভ্যস্ত লোকেরা বিভিন্ন অজুহাতে উক্ত পাপের উপর টিকে থাকে। অমনিভাবে বিচারক ও শাসক শ্রেণী তাদের ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন না। বরং একটি অন্যায় প্রবাদ চালু আছে যে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। অথচ মানুষের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক।

অহংকারী নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে

শক্তিশালী ব্যক্তি, সমাজনেতা, রাষ্ট্রনেতা, যেকোন পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তি বা কর্মকর্তা ও ধনিক শ্রেণীর কেউ কেউ অনেক সময় নিজেকে এরূপ ধারণা করে থাকে। সে ভাবতেই পারে না যে, আল্লাহ যেকোন সময় তার কাছ থেকে উক্ত নেয়ামত ছিনিয়ে নিতে পারেন।

আবু জাহল এরূপ অহংকার করেছিল। সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে তার বিরাট দল ও শক্তিশালী জনবলের ভয় দেখিয়েছিল। তার পরিণতি অবশেষে কি হয়েছিল, সবার জানা। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘কখনই না। মানুষ অবশ্যই সীমালংঘন করে’। ‘কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (আলাক্ব ৯৬/৬-৭)।

মানুষের জন্য অহংকার অশোভনীয়

আল্লাহ একেক জনকে একেক মেধা, প্রতিভা ও যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রত্যেক মানুষই পরস্পরের মুখাপেক্ষী। কেউ অভাবমুক্ত নয়। তাই মানুষের জন্য অহংকার শোভা পায় না।

আল্লাহ কেবল ‘মুতাকাবিবর’ (অহংকারী)। ‘অহংকার তাঁর চাদর’ । সকল প্রকার বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের মালিক তিনি। তাই অহংকার কেবল তাঁরই জন্য শোভা পায়।

অহংকারীরা আনুগত্য করাকে অপমানজনক মনে করে

অহংকারীরা অন্যের সেবা ও আনুগত্য করাকে নিজের জন্য অপমানজনক মনে করে। এই প্রকৃতির লোকেরা সাধারণতঃ উদ্ধত হয়ে থাকে। এরা মনে করে সবাই আমার আনুগত্য করবে, আমি কারু অনুগত হব না।

এরা ইহকালে অপদস্থ হয় এবং পরকালে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘পরকালের ঐ গৃহ আমরা তৈরী করেছি ঐসব লোকদের জন্য, যারা এ দুনিয়াতে উদ্ধত হয় না ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে না’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।

অহংকারীরা নিজেকে অন্যের চাইতে বড় মনে করে

যেমন ইবলীস আদমের চাইতে নিজেকে বড় মনে করেছিল এবং আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল। সে যুক্তি দিয়েছিল, ‘আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আদমকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে (আ‘রাফ ৭/১২)। অতএব ‘আমি কি তাকে সিজদা করব, যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? (ইসরা ১৭/৬১) এই যুক্তি ও অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাকে বলেন, ‘বের হয়ে যাও এখান থেকে। কেননা তুমি অভিশপ্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬)।

মানব সমাজেও যারা অনুরূপ অবাধ্য ও শয়তানী চরিত্রের অধিকারী, তারা সমাজে ও সংগঠনে এভাবেই ধিকৃত ও বহিষ্কৃত হয়। তবে যারা আল্লাহর জন্য বিতাড়িত ও নির্যাতিত হন, তারা ইহকালে ও পরকালে পুরস্কৃত হন।

ভালোর প্রতি হিংসা থেকে অহংকার

আসমানে প্রথম ভালোর প্রতি হিংসা করেছিল ইবলীস। সে আদমের উচ্চ মর্যাদার প্রতি হিংসাবশে তাকে সিজদা করেনি। অতঃপর যমীনে প্রথম হিংসা করেছিল ক্বাবীল তার ভাই হাবীল-এর প্রতি। কারণ হাবীলের কুরবানী আল্লাহ কবুল করেছিলেন। কিন্তু ক্বাবীলের কুরবানী তিনি কবুল করেননি। অথচ এতে হাবীলের কোনো হাত ছিল না।

ভালোর প্রতি হিংসা যুগে যুগে এটা জারি আছে। যেজন্য নবী-রাসূলগণ ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ সর্বদা দুষ্টুদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও অহংকারীরা সর্বদা নিজেদের সাফাই গেয়ে মিথ্যা বলে থাকে।

ইলম থেকে অহংকার

ইলম অনেক সময় আলেমকে অহংকারী বানায়। জন্মগতভাবে বদ চরিত্রের লোকেরা যখন ইলম শিখে, তখন ইলমকে তার বদস্বভাবের পক্ষে কাজে লাগায়। এইসব আলেমরা কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করে এবং নিজেকে অন্যদের তুলনায় বড় আলেম বলে যাহির করে। এদের মধ্যে ইলম থাকলেও সেখানে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি থাকে না। তাদের সকল কাজে লক্ষ্য থাকে দুনিয়া অর্জন করা ও মানুষের প্রশংসা কুড়ানো। যা তাদেরকে অহংকারী করে ফেলে।

দ্বিতীয় কারণ হলো অল্প বিদ্যা। যেমন কিছু ইলম শিখেই নিজেকে অন্যের তুলনীয় মনে করা এবং বলা যে, ‘তারাও মানুষ ছিলেন, আমরাও মানুষ’। আমরা ও তারা সমান। এটা তাদের অহংকারের পরিচয়। নিঃসন্দেহে পূর্ববর্তী বিদ্বানদের মর্যাদা বেশী। কেননা তাদের পথ ধরেই পরবর্তীরা এসেছে। তাছাড়া সমকালীন প্রত্যেকেই পৃথক গুণ ও মেধার অধিকারী। অতএব কেউ কারু সমান নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।

অহংকারী দম্ভভরে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে

মানুষ কখনো কখনো নিজেকে শ্রেষ্ঠ করে দেখানোর জন্য সত্যকে চাপা দেয়। অন্যের অবদানগুলো নিজের বলে চালিয়ে দেয়। অন্যকে দাবিয়ে রাখতে বিভিন্ন জায়গায় তাকে তুচ্ছ করে দেখায়। এটাও মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।

দম্ভভরে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা হলো অহংকারের প্রধান নিদর্শন। অহংকার এমন এক মারাত্মক আচরণ, যা একজন বিনয়ী ও সফল ব্যক্তিকে তার সফলতার উচ্চাসন থেকে নিমিষেই নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এটি করা হয়ে থাকে মূলতঃ দুনিয়াবী স্বার্থের নিরিখে। কখনো পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে, কখনো ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বার্থের দোহাই দিয়ে বা অন্য কোন কারণে।

সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও নিজের ভুলের উপর যিদ ও হঠকারিতার বিষয়টি অহংকারীদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই গর্বিত থাকে। নিজেকে সংশোধনের আকাংখা তাদের মধ্যে দেখা যায় না। বংশের নেতারা বড়াই করেন তাদের আভিজাত্য নিয়ে।

নারীরা অহংকার করে তাদের সৌন্দর্য নিয়ে, ধনীরা অহংকার করে তাদের ধন নিয়ে, আলেমরা অহংকার করেন তাদের ইলম ও অনুসারী দল নিয়ে, দলনেতারা অহংকার করেন তাদের দল নিয়ে, রাষ্ট্রনেতারা অহংকার করেন তাদের শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে।

পদমর্যাদা থেকে অহংকার

উচ্চ পদমর্যাদা মানুষের মধ্যে অনেক সময় অহংকার সৃষ্টি করে। মূর্খরা এটাকে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করে। জ্ঞানীরা এর মাধ্যমে মানব কল্যাণে অবদান রাখেন। পদমর্যাদা একটি কঠিন জওয়াবদিহিতার বিষয়। যিনি যত বড় দায়িত্বের অধিকারী, তাকে তত বড় জওয়াবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।

যে ব্যক্তি পদমর্যাদা বা দায়িত্ব পেয়ে অহংকারী হয় এবং পদের অপব্যবহার করে, সে জান্নাত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। যুলুম-খেয়ানত-বিশ্বাসঘাতকতা সবকিছুর উৎপত্তি হয় পদমর্যাদার অহংকার থেকে। দায়িত্বের জন্য কৈফিয়ত দেয়ার ভয়ে অহংকারীর হৃদয় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে না।

বংশ মর্যাদা থেকে অহংকার

বংশ মর্যাদা মানুষের উচ্চ সম্মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদন্ড। এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে, যতক্ষণ বংশের লোকেরা বিনয়ী ও চরিত্রবান থাকে। উক্ত দু’টি গুণ যত বৃদ্ধি পায়, তাদের সম্মান তত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি সেখানে কথায় ও আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়, তাহলে কচুর পাতার পানির মত উক্ত সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়।

অহংকারী অপরের উপর গর্ব করে এবং অপরের উপর বাড়াবাড়ি করে। বাপ-দাদার নামে গর্ব করে। জাহেলিয়াতের অহমিকা ও বাপ-দাদার অহংকার করে। অথচ মানবজাতি সবাই আদমের সন্তান। আর আদম হলো মাটির তৈরী; অতএব অহংকার করার মত কিছুই নেই।

বংশ মর্যাদার তারতম্যকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করলেই সেটা দোষের হয়। অন্যায়ভাবে বংশের গৌরব করা জাহেলিয়াতের অংশ। ভালো উদ্দেশ্যে বংশমর্যাদা প্রশংসিত, কিন্তু অন্যায়ভাবে বংশগৌরব করাটা নিন্দনীয়।

ইসলামে বংশ মর্যাদা স্বীকৃত ও প্রশংসিত হলেও দ্বীন ও তাক্বওয়া না থাকলে তা নিন্দিত ও মূল্যহীন। এখানে সকলের সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড হ’ল ঈমান ও তাক্বওয়া। মুসলমান সবাই ভাই ভাই। দাস-মনিবে কোন প্রভেদ নেই। কেবল অহংকারী ব্যক্তিরাই এর বিপরীত আচরণ করে থাকে।

নেক আমল থেকে অহংকার

ইবাদত ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলেও তা অনেক সময় মুমিনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। বহু নেককার ও ইবাদতগুযার ব্যক্তি অলি-আউলিয়া, গাউছ-কুতুব-আবদাল, পীর-মাশায়েখ ইত্যাদি লকবে অভিহিত হন। তারা ভক্তের ভক্তি রসে আপ্লুত হতে ভালবাসেন।

নযর-নেয়ায, পদসেবা গ্রহণ ইত্যাদি তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। যা তাদের মধ্যে লোভ ও অহংকার সৃষ্টি করে। অথচ যখন ঘর থেকে বের হবে, যখন তুমি যাকেই দেখবে, তাকেই তোমার চাইতে উত্তম বলে মনে করবে।

অহংকারীর বোধশক্তি লোপ পায়

দুনিয়াতে অহংকারের পরিণতি হলো লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে এর পরিণতি হলো ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ অর্থাৎ জাহান্নামীদের পুঁজ-রক্ত পান করা। যার অন্তরে যতটুকু অহংকার সৃষ্টি হবে, তার জ্ঞান ততটুকু হ্রাস পাবে। যদি কারু অন্তরে অহংকার স্থিতি লাভ করে, তবে তার জ্ঞানচক্ষু অন্ধ হয়ে যায়। বোধশক্তি লোপ পায়।

সে অন্যের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কাম্য সম্মান না পেলে সে মনোকষ্টে মরতে বসে। তার চেহারায় ও আচরণে, যবানে ও কর্মে অহংকারের দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। ফলে মানুষ তার থেকে ছিটকে পড়ে। এক সময় সে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। একাকীত্বের যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকে। কিন্তু বাইরে ঠাট বজায় রাখে। এভাবেই সে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যায়।

অহংকারী অন্যের সম্মানকে মেনে নিতে পারে না

হযরত আদম আলাইহিস সালামের উচ্চ সম্মান দেখে ইবলীস অহংকারী হয়ে ওঠে এবং সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে। নবী-রাসূলগণ ও তাঁদের অনুসারীগণ সর্বদা অহংকারীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছেন যুগযুগ ধরে।

অহংকারীর প্রাধান্য বিস্তারের অভিলাষ থাকে

একজন অহংকারী, সে মনে করে, সমাজে তার প্রাধান্য বিস্তার, সবার নিকট প্রসিদ্ধি লাভ ও নেতৃত্ব দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাকে এ লক্ষ্যে সফল হতেই হবে। কিন্তু যদি সমাজ তার কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য মেনে না নেয়, তখন সে চিন্তা করে, তাকে যে কোন উপায়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। চাই তা বড়াই করে হোক অথবা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তখন সে যা ইচ্ছা তাই করে এবং সমাজে হট্টগোল সৃষ্টি করে।

অহংকারী নিজের দোষকে আড়াল করে

একজন অহংকারী তার স্বীয় কাজ কর্মে নিজের মধ্যে যে সব দুর্বলতা অনুভব করে, তা গোপন রাখতে আগ্রহী হয়। কারণ, তার আসল চরিত্র যদি মানুষ জেনে যায়, তাহলে তারা তাকে আর বড় মনে করবে না ও তাকে সম্মান দেবে না।

যেহেতু একজন অহংকারী সব সময় মানুষের চোখে বড় হতে চায়, এ কারণে সে পছন্দ করে, তার মধ্যে যে সব দুর্বলতা আছে, তা যেন কারো নিকট প্রকাশ না পায় এবং কেউ যাতে জানতে না পারে; কিন্তু মূলত: সে তার অহংকার দ্বারা নিজেকে অপমানই করে, মানুষকে সে নিজেই তার গোপনীয় বিষয়ের দিকে পথ দেখায়।

অহংকারী যেভাবে অহংকারের সুযোগ পায়

কতেক লোকের অধিক বিনয়ের কারণে অহংকারীরা অহংকারের সুযোগ পায়। অহংকারীরা যখনই কোন সুযোগ পায়, তা তারা কাজে লাগাতে কার্পণ্য করে না। অনেক সময় দেখা যায় কিছু লোক এমন আছে, যারা বিনয় করতে গিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি করে, তারা নিজেদের খুব ছোট মনে করে, নিজেকে যে কোন প্রকার দায়িত্ব আদায়ের অযোগ্য বিবেচনা করে এবং যে কোন ধরনের আমানতদারিতা রক্ষা করতে সে অক্ষম বলে দাবি করে, তখন অহংকারী চিন্তা করে এরা সবাইতো নিজেদের অযোগ্য ও আমাকে যোগ্য মনে করছে, প্রকারান্তরে তারা সবাই আমার মর্যাদাকে স্বীকার করছে, তাহলে আমিই এসব কাজের জন্য একমাত্র যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি। সুতরাং, আমিতো তাদের সবার উপর নেতা। শয়তান তাকে এভাবে প্রলোভন দিতে ও ফুঁসলাতে থাকে, আর লোকটি নিজে নিজে ফুলতে থাকে। ফলে এখন সে অহংকার বশতঃ আর কাউকে পাত্তা দেয় না, সবাইকে নিকৃষ্ট মনে করে। আর নিজেকে যোগ্য মনে করে।

অহংকারী মানুষকে মূল্যায়ন করতে জানে না

মানুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার মানদন্ড কী এবং মানুষকে কীসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে, তা অহংকারী জানে না বা বুঝতে চায় না। অহংকারের অন্যতম কারণ হল, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড নির্ধারণে ত্রুটি করা। একজন মানুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার মানদন্ড কি তা আমাদের অনেকেরই অজানা।

যার কারণে দেখা যায়, যারা ধনী ও পদ মর্যাদার অধিকারী তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে, যদিও তারা পাপী বা অপরাধী হয়। অন্যদিকে একজন পরহেজগার, মুত্তাকী ও সৎ লোক তার ধন সম্পদ ও পদমর্যাদা না থাকাতে সমাজে তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না এবং তাকে মূল্যায়ন করা হয় না।

অথচ মানুষের মর্যাদা তার পোষাকে নয়, বরং মানুষের মর্যাদা, তার অন্তর্নিহীত সততা, স্বচ্ছতা ও আল্লাহ-ভীতির উপর নির্ভর করে। যার মধ্যে যতটুকু আল্লাহ-ভীতি থাকবে, সে তত বেশি সৎ ও উত্তম লোক হিসেবে বিবেচিত হবে।

অহংকারী নিজেকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র মনে করে

একজন অহংকারী মনে করে, সে তার সাথী সঙ্গীদের চেয়ে জাতিগত ও সত্তাগতভাবেই বড় এবং সে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, তার সাথে কারো কোন তুলনা হয় না। ফলে সে কাউকেই কোন প্রকার তোয়াক্কা করে না, কাউকে মূল্যায়ন করতে চায় না এবং কারো আনুগত্য করার মানসিকতা তার মধ্যে থাকে না। যার কারণে সে সমাজে এমনভাবে চলা ফেরা করে যে, মনে হয় তার মত এত বড় আর কেউ নাই।

অহংকারীরা অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে

অর্থ-সম্পদ, সৌন্দর্যের কারণে অন্যের প্রতি অন্তরে কোনো তুচ্ছভাবের উদ্রেক হওয়াটা অহংকারের লক্ষণ। মক্কার কাফের নেতারাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট থেকে হযরত বেলাল, খোবায়েব, সুহায়েব, ইবনু মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমসহ দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সরিয়ে দিতে বলেছিল, যাতে তারা তাঁর সঙ্গে বসে পৃথকভাবে কথা বলতে পারে।  ধনে-জনে ও পদমর্যাদায় নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি মনের মধ্যে কোন তুচ্ছভাব উদ্রেক হওয়াটা অহংকারের লক্ষণ। অতএব এই স্বভাবগত রোগ কঠিনভাবে দমন করা অবশ্য কর্তব্য।

অহংকারীদের সফলতা অস্থায়ী

জীবন ধ্বংসকারী একটি মারাত্মক স্বভাব হলো অহংকার। এই স্বভাবের লোকেরা তাদের উন্নতি ও সফলতা বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। আত্মীয়-স্বজন ও কাছের মানুষদের ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে তারা। তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্র এমনকি নিজ পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অহংকারে হক্ব থেকে দূরে যারা

অভিশপ্ত ইবলিসের কুফরি করা ও আল্লাহর আদেশের অবাধ্য হওয়ার একমাত্র কারণ তার অহংকার। অনুরূপভাবে ফেরআউনের কুফরি করার কারণ ছিল, তার অহংকার। হযরত সালেহ আলাইহিস সালামের কওম তথা সামুদ গোত্রের কুফরির কারণও একই। অর্থাৎ, তাদের অহংকার।

এছাড়া হযরত হুদ আলাইহিস সালামের কাওম তথা আদ সম্প্রদায়, তারা যমীনে অযথা অহঙ্কার করত এবং বলত, ‘আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কে আছে’?  মাদায়েনের অধিবাসী হযরত শুয়াইব আলাইহিস সালামের কওম থেকে যে নেতৃবৃন্দ অহঙ্কার করেছিল তারা বলল, ‘হে শু‘আইব, আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে অবশ্যই আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব।’

হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কওম দম্ভভরে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে’। বনী ইসরাঈল নবীর আহ্বান মনঃপূত না হলেই অহঙ্কার করেছ, অতঃপর [নবীদের] একদলকে মিথ্যাবাদী বলেছে আর একদলকে হত্যা করেছে। আরবের মুশরিকরা অন্তরে অহঙ্কার পোষণ করেছে এবং গুরুতর সীমালংঘন করেছে।

দুনিয়াতে অহংকারীর শাস্তি

কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এমন কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, সেখানকার লোকেরা ধন-সম্পদের অহংকার করত। এই যে তাদের বাড়িঘর পড়ে আছে, যেখানে তাদের পর কম লোকই বসবাস করেছে। শেষ পর্যন্ত আমি (এ সবেরই) মালিক হয়েছি।’ [সুরা আল কাসাস: ৫৮]

আল্লাহ তাআলা অহংকারের শাস্তি শুধুমাত্র আখেরাতে নয় দুনিয়াতেও দিয়ে থাকেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগেকার অনেক জাতি ধন-সম্পদ ও শাসনক্ষমতা নিয়ে অহংকার ও বাড়াবাড়ি করার কারণে আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করেছেন। দুনিয়াতে অহংকারীর শাস্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে-

ঘৃণা ও অপমান

একজন অহংকারীকে তার চাহিদার বিপরীত দান করার মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়। যেমন, সে মানুষের নিকট চায় সম্মান কিন্তু মানুষ তাকে বিপরীতটি উপহার দেয় তথা ঘৃণা। অহংকারীকে লোকেরা নিকৃষ্ট মানুষ মনে করে এবং ঘৃণা করে। এটি হল, একজন অহংকারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষ শাস্তি।

দুনিয়ার চিরন্তন নিয়মই হল, অহংকারীকে কেউ ভালো চোখে দেখে না, সবাই তাকে ঘৃণা করে। আর যে ব্যক্তি অহংকার করে, নিজেকে বড় মনে করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ছোট করে দেন, তার মর্যাদাকে কমায়ে দেন, মানুষ তাকে অসম্মান ও অপমান করেন।

 উপদেশ উপেক্ষা

চিন্তা-ফিকির, উপদেশ গ্রহণ করা ও আল্লাহর আয়াতসমূহ হতে নছিহত অর্জন করা হতে একজন অহংকারী বঞ্চিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা অন্যায়ভাবে যমীনে অহঙ্কার করে আমার আয়াতসমূহ থেকে তাদেরকে আমি অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব।

আর তারা সকল আয়াত দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না এবং তারা সঠিক পথ দেখলেও তাকে পথ হিসাবে গ্রহণ করবে না। আর তারা ভ্রান্ত পথ দেখলে তা পথ হিসাবে গ্রহণ করবে। এটা এ জন্য যে, তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং সে সম্পর্কে তারা ছিল গাফেল। [সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৪৬]

বিপদ আসা

দুনিয়াতে তাদের নানা শাস্তি দেয়া হয়। রাসূল সা. অহংকারীদের দুনিয়াতে শাস্তির ঘোষণা দিয়ে এরশাদ করেন, একজন মানুষ সর্বদা অহংকার করতে থাকে। অত:পর একটি সময় আসে তখন তার নাম জাব্বারিন তথা অহংকারীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়, তখন তাকে এমন আযাব আক্রান্ত বা গ্রাস করে, যা অহংকারীদের গ্রাস করেছিল।

নেয়ামত ছিনিয়ে নেয়া

অহংকার নেয়ামতসমূহ ছিনিয়ে নেয়া ও আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হয়ে থাকে। হযরত সালামাহ ইবনুল আক্ওয়া রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন এক লোক রাসূল সা. এর দরবারে বাম হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করলে রাসূল সা. তাকে বললেন, তুমি ডান হাত দিয়ে খাও।

উত্তরে লোকটি বলল, আমি পারছি না! তার কথার প্রেক্ষাপটে রাসূল সা. তাকে বললেন, তুমি পারবেও না? মূলত: রাসূল সা. এর কথার অনুকরণ করা হতে তাকে তার অহংকারই বিরত রাখে। বর্ণনাকারী বলেন, লোকটি আর কখনোই তার হাতকে তার মুখ পর্যন্ত উঠাতে পারেনি।

জমি ধ্বস ও কবর আযাব

রাসূল সা. অহংকারীদের দুনিয়াতে শাস্তির ঘোষণা দিয়ে এরশাদ করেন, হযরত আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. এরশাদ করেন, তোমাদের পূর্বের যুগের এক লোক একটি কাপড় ও লুঙ্গি পরিধান করে ও তার চুলগুলো তার কাঁধের উপর ঝুলিয়ে অহংকার করে হাঁটছিল।

কাপড়দ্বয় লোকটিকে অহংকারের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হঠাৎ ভূমি তাকে গ্রাস করে ফেলল । যমিন তার অভ্যন্তরে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত লোকটিকে পুঁততে থাকবে। আর সে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এ দিক সেদিক নড়াচড়া করতে থাকবে।

পরকালে অহংকারের শাস্তি

অহংকারীর সর্বশেষ পরিণতি হলো জাহান্নাম। কেননা সে অহংকারের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার অধীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে বেপরোয়া হয়ে যায়। নিজকে অনেক বড় ও ক্ষমতাবান এবং শক্তিশালী মনে করে এবং মানুষকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। গর্ব ও অহংকার একমাত্র আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য।

অহংকারী ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকদের সাথে ধ্বংস হবে

হযরত ফাদ্বালা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. এরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির পরিণতি সম্পর্কে তোমরা আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।

এক. যে ব্যক্তি আল্লাহর বড়ত্ব নিয়ে আল্লাহর সাথে ঝগড়া করে। কারণ, বড়ত্ব হল আল্লাহর কুদরতের চাদর আর তার পরিধেয় হল ইজ্জত।

দুই. যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে।

তিন. যে ব্যক্তি আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়।

অহংকারীরা কিয়ামত দিবসে সবচেয়ে ঘৃণিত

অহংকারীরা কিয়ামত দিবসে রাসূল সা. এর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ও অবস্থানের দিক দিয়ে অনেক দূরে হবে। এই ব্যাপারে  হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত, রাসুল সা. এরশাদ করেন, ‘ক্বিয়ামত দিবসে আমার নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি এবং মজলিসের দিক দিয়ে আমার সর্বাধিক কাছের লোক সে হবে, তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র খুব সুন্দর।

আর কিয়ামত দিবসে তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত ব্যক্তি, মজলিসের দিক দিয়ে আমার থেকে সর্বাধিক দুরের লোক, যে ইচ্ছা করে বেশি কথা বলে, কথার মাধ্যমে মানুষের উপর অহংকার করে এবং যে ব্যক্তি দীর্ঘ কথা বলে অন্যের উপর নিজের ফযিলত বর্ণনা করে।’

অহংকারীর উপর আল্লাহ ক্ষুব্ধ

অহংকারীরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে, যে অবস্থায় আল্লাহ তাআলা তার উপর ক্ষুব্ধ। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মনে মনে নিজেকে বড় মনে করে এবং হাঁটার সময় অহংকার করে, সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে যে অবস্থায় আল্লাহ তাআলা তার উপর রাগান্বিত।

কিয়ামতের দিন অপমান ও অপদস্থ হবে

অহংকারীদের আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন অত্যন্ত অপমান ও অপদস্ত করে একত্রীত করবেন। রাসূল সা. এরশাদ করেন, অহংকারীদের কিয়ামতের দিন মানুষের আকৃতিতে ছোট ছোট পিপড়ার মত করে একত্র করা হবে। অপমান অপদস্থ সব দিক থেকে তাকে গ্রাস করে ফেলবে।

তারপর তাকে জাহান্নামের মধ্যে একটি জেলখানা যার নাম ‘বুলাস’ তার দিকে টেনে হেঁচড়ে নেয়া হবে। তাদেরকে জাহান্নামের প্রজ্বলিত আগুন চতুর্দিক থেকে গ্রাস করে ফেলবে। আর জাহান্নামীদের পিত্ত, পুঁজ ও বমি তাদেরকে পানীয় হিসাবে দেয়া হবে।

অহংকারীদের জন্য জাহান্নাম

হারেসা ইবনে ওহাব আল খুযায়ী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছি, আমি তোমাদের থেকে কারা জান্নাতি তাদের বিষয়ে খবর দিব কি? তারা হলো সব দুর্বল ও অসহায় লোকেরা তারা যদি আল্লাহর শপথ করে আল্লাহ তাআলা শপথ পূর্ণ করেন এবং তাদের দায় মুক্ত করে। তারপর রাসূল সা. এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদের কারা জাহান্নামে যাবে তাদের বিষয়ে খবর দিব? তারা হল, সব অহংকারী, দাম্ভিক ও হঠকারী লোকেরা।

হযরত আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. এরশাদ করেন, জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে বিতর্ক করে, জাহান্নাম বলে, হে আল্লাহ! কেন আমার নিকট বড় বড় দাম্ভিক ও অহংকারীরা প্রবেশ করবে? আর জান্নাত আল্লাহকে বলে, কেন আমার ভিতর শুধু দুর্বল ও মিসকিন লোকেরা প্রবেশ করে?। তখন আল্লাহ তাআলা জাহান্নামকে বলেন, তুমি হলে আমার আযাব। আমি তোমার মাধ্যমে যাকে চাই তাকে আযাব দিব। অথবা আল্লাহ বলেন, তোমার মাধ্যমে আমি যাকে চাই তাকে পাকড়াও করবো। আর জান্নাতকে আল্লাহ তাআলা বলেন, তুমি আমার রহমত আমি তোমার দ্বারা যাকে চাই তাকে রহম করব। আর তোমাদের উভয়ের জন্য রয়েছে যথাযোগ্য অধিবাসী।

অহংকারীদের জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, আর কাফিরদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন জাহান্নামের কাছে এসে পৌঁছবে তখন তার দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কি রাসূলগণ আসেননি, যারা তোমাদের কাছে তোমাদের রবের আয়াতগুলো তিলাওয়াত করতেন এবং এ দিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করতেন’?

তারা বলবে, ‘অবশ্যই এসেছিল’; কিন্তু কাফিরদের উপর আযাবের বাণী সত্যে পরিণত হল। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর চিরকাল তোমরা সেখানে অবস্থান করবে। অহংকারীদের বাসস্থান কতই না মন্দ।[সূরা যুমার, আয়াত: ৭১,৭২]

আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন, আর তোমাদের রব বলছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশতঃ আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ [সূরা গাফের, আয়াত: ৬০]

 

 

অহংকার দূরীকরণের উপায়

অহংকার মানুষের ভিতরে লুক্কায়িত একটা বিষের নাম। একে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। কিন্তু একে দমিয়ে রাখতে হবে, যেন মাথা উঁচু করতে না পারে। যেমন ঝাড়িয়ে সাপের বিষ নামাতে হয়। মনের মধ্যে এই বিষ-এর এর উদয় হ’লেই বুদ্বুদের মত একে হাওয়া করে দিতে হবে। তাই কেবল অহংকার দূরীকরণের আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং এ রোগের রীতিমত চিকিৎসা ও প্রতিষেধক প্রয়োজন।

মৃত্যুর কথা সর্বদা স্মরণ করা

মানুষ তার জন্মের সময় উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। মৃত্যুর পর সে লাশে পরিণত হবে। আর মৃত্যুর ঘণ্টা সর্বদা তার মাথার উপর ঝুলে আছে। হুকুম হলেই তার রূহ যার হুকুমে তার দেহে এসেছিল তার কাছেই চলে যাবে। তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে থাকবে দুনিয়ায় পোকার খোরাক হবার জন্য।

মানুষের জন্য অহংকার করার মত কিছু নেই। কেননা সে তার রোগ-শোক. বার্ধক্য-জ্বরা কিছুকেই প্রতিরোধ করতে পারে না। শতবার ঔষধ খেলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার রোগ সারে না। শত চেষ্টাতেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার বিপদ দূরীভূত হয় না। ফলে সে একজন অসহায় ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তার উচিত সর্বদা নিরহংকার ও বিনয়ী থাকা।

আখেরাতে জওয়াবদিহিতার ভয়ে ভীত হওয়া

ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে দেয়া হবে! আমলনামায় ছোট-বড় কিছুই বাদ যাবে না, সবকিছুই লিখে রাখা হবে। কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে।

তাই  আখেরাতে আল্লাহর নিকটে যথাযথ জওয়াবদিহিতার কথা সর্বদা স্মরণ করতে হবে এবং কিভাবে সে দায়িত্ব আরও সুন্দরভাবে পালন করা যায়, তার জন্য সর্বদা চেষ্টিত থাকতে হবে। এই তীব্র দায়িত্বানুভূতি তাকে অহংকারের পাপ থেকে মুক্ত রাখবে ইনশাআল্লাহ।

নিজেকে জানা ও আল্লাহকে জানা

প্রথমেই নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে যে, মৃত শুক্রাণু থেকে সে জীবন পেয়েছে। আবার সে মরবে। অতএব তার কোন অহংকার নেই। কেবল বিনয় ও আনুগত্য কাম্য। অতঃপর আল্লাহ সম্পর্কে জানবে যে, তিনিই তাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন।

তিনিই তাকে শক্তি দিয়ে মেধা দিয়ে পূর্ণ-পরিণত মানুষে পরিণত করেছেন। তাঁর দয়ায় তার সবকিছু। অতএব প্রতি পদে পদে আল্লাহর দাসত্ব ব্যতীত তার কিছুই করার নেই। নিজেকে সর্বদা আল্লাহর দাস মনে করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অহংকার বিদূরণের প্রধান ঔষধ।

অহংকার দূরীকরণের মহৌষধ স্রষ্টার ক্ষমতায় বিশ্বাস

আল্লাহর দান যেকোন সময় তিনি ফিরিয়ে নিতে পারেন। বহু জ্বালাময়ী বক্তা সুস্থ থেকেও নির্বাক হয়ে আছেন, বহু লেখক লুলা হয়ে গেছেন, বহু ধনী নিঃস্ব হয়েছেন, বহু নেতা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। বহু শক্তিমান পুরুষ প্যারালাইজড হয়ে বা স্ট্রোক হয়ে বা বার্ধক্যে জরজর হয়ে পড়ে আছেন। তাদের অসহায় চেহারাগুলি চিন্তা করলেই নিজের মধ্য থেকে অহংকার নিমেষে হারিয়ে যাবে।

মুমিনদের উদ্দেশে ক্বোরআনুল করীমে আল্লাহ বলেন, ‘মাটির বুকে গর্বের সঙ্গে চলবে না। নিশ্চয়ই তুমি কখনো পদচাপে জমিনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না। আর পাহাড়ের সমান উঁচুও হতে পারবে না।’[সুরা বনি ইসরাইল: ৩৭]

ইচ্ছাকৃতভাবে হীনকর কাজ করা

হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের জুতা নিজে ছাফ করতেন, কাপড় সেলাই করতেন ও বাড়িতে বিভিন্ন কাজ করতেন, যেমন তোমরা করে থাক। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) অন্যান্য মানুষের ন্যায় একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কাপড়ের উকুন বাছতেন, ছাগী দোহন করতেন এবং নিজের অন্যান্য কাজ করতেন। মসজিদে নববী নির্মাণের সময়, খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের সময় তিনি নিজে মাটি কেটেছেন ও পাথর বহন করেছেন। বিভিন্ন সফরে তিনি ছাহাবীদের সঙ্গে কাজে অংশ নিয়েছেন।

তাঁর অনুসরণে ছাহাবায়ে কেরামও এরূপ করতেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রা.) একদা কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে বাজার অতিক্রম করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আব্দুল্লাহ! আল্লাহ কি আপনাকে এ কাজ করা থেকে মুখাপেক্ষীহীন করেননি? (অর্থাৎ আপনার তো যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ রয়েছে! আপনি কেন একাজ করছেন?) জবাবে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ! কিন্তু আমি এ কাজের মাধ্যমে আমার অহংকারকে দমন করতে চাই। কেননা আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।

অতএব সাধ্যে কুলায় এমন যেকোন হীনকর কাজ করার মানসিকতা অর্জন করতে পারলে মনের মধ্য থেকে সহজে অহংকার দূর হয়ে যাবে। যেমন আপনি অফিসের বস। টেবিলের ধূলা নিজে মুছলেন, মাকড়সার জালগুলো নিজে দূর করলেন, প্রয়োজনে টয়লেট ছাফ করলেন, এমনকি ঘরটা ঝাড়ু দিলেন। এসব ছোটখাট কাজ হলেও এগুলির মাধ্যমে অহংকার দূর হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যের নিকট সম্মান বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি নিজের কাজ নিজে করায় রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত অনুসরণের ছওয়াব পাওয়া যায়। লোকেরা আপনাকে সামনে নিয়ে মিছিল করতে চায়, আপনার ছবি তুলতে চায়, আপনার নামে প্রশংসামূলক শ্লোগান দিতে চায়, আপনার সামনে আপনার নামে অভিনন্দন পত্র পাঠ করতে চায়, আপনি সুযোগ দিবেন না অথবা এড়িয়ে যাবেন।

অহংকার চূর্ণ করার মহৌষধ

আল্লাহ সব কাজ দেখছেন ও সব কথা শুনছেন, দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস পোষণ করা অহংকার থেকে বাঁচাবে। এছাড়া গরীব ও ইয়াতীমদের সঙ্গে থাকা ও রোগীর সেবা করার মাধ্যমে অন্ধকার দূর হয়। অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা, যেকোনো সেবামূলক কাজ নিঃস্বার্থ হলে এবং পরকালীন লক্ষ্যে হলে, সেগুলি অহংকার চূর্ণ করার মহৌষধ।

এছাড়া নিজের সৎকর্মগুলি আল্লাহর নিকটে কবুল হচ্ছে কি-না সেই ভয়ে সর্বদা ভীত থাকলে অহংকার দূর হয়। ভুলক্রমে বা উত্তেজনা বশে অহংকার প্রকাশ পেলে সাথে সাথে বান্দার কাছে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে অহংকার শেষ হয়ে যায়।

রাস্তা দিয়ে খুব জাঁক-জমকের সাথে তিনি চলতে পারেন না যিনি মনে রাখেন তার শুরু হলো একটি নিকৃষ্ট শুক্রাণু থেকে এবং শেষ হবে একটি মরা লাশ হিসাবে। আর এর মধ্যবর্তী সময়ে পায়খানার ময়লা বহন করে চলছে।

নিঃস্বার্থ সেবামূলক কাজ

হযরত আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন বলবেন, হে বনী আদম! আমি অসুস্থ ছিলাম। তুমি আমাকে দেখতে আসোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি তোমাকে কিভাবে দেখতে যাব? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল?

তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, আমাকে অবশ্যই তার কাছে পেতে। হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি তোমাকে কিভাবে খাবার দিতাম? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল? তুমি তাকে খাবার দাওনি।

তুমি কি জানতে না যে, সে সময় যদি তুমি তাকে খাবার দিতে তাহলে তা এখন আমার কাছে পেতে? হে বানী আদম! আমি তোমার কাছে পিপাসা নিবারণের জন্য পানি চেয়েছিলাম। তুমি পানি দিয়ে তখন আমার পিপাসা নিবারণ করোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি কিভাবে তোমার পিপাসা নিবারণ করতাম? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তখন তাকে পানি দাওনি। যদি তুমি সে সময় তাকে পানি দিতে, তাহলে তা এখন আমার কাছে পেতে।

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, জনৈক তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি মরুভূমিতে একটি কূয়ায় নেমে পানি পান শেষে উঠে দেখেন যে, একটি তৃষ্ণার্ত কুকুর পিপাসায় মরণাপন্ন হয়ে জিভ বের করে মাটিতে মুখ ঘষছে। তখন লোকটি পুনরায় কূয়ায় নেমে নিজের চামড়ার মোযা ভরে পানি এনে কুকুরটিকে পান করান এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান’।

অন্য বর্ণনায় এসেছে বনী ইসরাঈলের জনৈকা বেশ্যা মহিলা একটি কুকুরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় কূয়ার চারপাশে ঘুরতে দেখে নিজের ওড়নায় মোযা বেঁধে কূয়া থেকে পানি তুলে তাকে পান করায়। ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন’।

অহংকারী চাল-চলন পরিহার

স্বাভাবিক পোষাকের বাইরে অপ্রয়োজনে আড়ম্বরপূর্ণ কোন পোষাক পরিধান করলে ফেৎনায় পড়ে অহংকার সৃষ্টি হয়। অনেক মসজিদে বিশেষ মুছল্লীদের জন্য বিশেষ স্থান ও জায়নামায দেখা যায়। এমনকি কারু জন্য বিশেষ দরজাও নির্দিষ্ট থাকে। যেগুলি অহংকারের পর্যায়ভুক্ত।

গোপন আমল করা

নিরহংকার হওয়ার অন্যতম পন্থা হলো গোপন আমল করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণীর লোক আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া পাবে, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে একজন হ’ল ঐ ব্যক্তি … যে গোপনে ছাদাক্বা করে এমনভাবে যে ডান হাত যা ব্যয় করে, বাম হাত তা জানতে পারে না এবং ঐ ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর দু’চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়’। এজন্য তাহাজ্জুদের ছালাত রাত্রির শেষ প্রহরে একাকী নিরিবিলি পড়তে বলা হয়েছে (মুযযাম্মিল ৭৩/২-৩, ২০)।

আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা

অহংকারের মত মহাপাপ হৃদয়ে জাগ্রত হলে সেটাকে দ্রুত দমন করতে হবে, যা সহজেই অনুমেয়। যদি কেউ আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে পারে, তবে তার চোখের পানিতে অহংকার ধুয়ে-মুছে ছাফ হয়ে যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, সে ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না। যেমন দুধ পুনরায় পালানে প্রবেশ করে না।

ক্ষমা করা ও নম্রতা অবলম্বন করা

রাসূল (সা.) বলেন, ‘বান্দা কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর যখন সে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয় অবলম্বন করে, তখন তিনি তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেন’। তিনি বলেন, ‘কোনো বস্ত্ততে নম্রতা থাকলে সেটি তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং তা প্রত্যাহার করা হ’লে সেটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে’।

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বিনয় ও আনুগত্য মানুষকে উঁচু ও সম্মানিত করে। পক্ষান্তরে অহংকার ও আত্মগর্ব মানুষকে নীচু ও লাঞ্ছিত করে।

 আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা

অহংকার থেকে মুক্ত থাকার জন্য নিম্নের দোআটি পাঠ করা যেতে পারে।-আল্লাহ অতি মহান, আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা, সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর প্রশংসাসহ আল্লাহর জন্য সকল পবিত্রতা। আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি বিতাড়িত শয়তান হতে এবং তার প্ররোচনা, তার ফুঁক ও তার কুমন্ত্রণা হতে।

এছাড়াও সূরা নাস ও ফালাক্ব পড়া উচিৎ। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোন প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে পারে না এবং কোন আশ্রয়প্রার্থী আশ্রয় চাইতে পারে না এ দুটি সূরার তুলনায়’।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *