মানসিক দৈন্য দশায় যারা থাকেন, তারা যুক্তি ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেয়, অকারণে স্মার্ট মানুষকে সহ্য করতে পারে না, সফল কাউকে দেখলেই মারাত্মক অহংকারী ভাবে, নানাবিধ বাজে সম্বোধন করে প্রচ্ছন্ন আনন্দ পায়। এদের চোখে যে বেশি যোগ্য, যার বেশি সম্পদ, যার বেশি সম্পত্তি, যে বেশি সুখি, সেই বড় দোষী! দৈন্যতা স্বাভাবিক জীবনের পথ রুদ্ধ করে দেয়, হতাশ করে দেয়!
যে সমাজে শিক্ষা মানে বিক্রয় হবার সার্টিফিকেট অর্জন, মেয়েকে বিয়ের বাজারে মূল্যবান করে তোলা, ছেলেকে চাকরি করার যোগ্য করে তোলা; সেই সমাজের মানুষের চিন্তার দৌড় কিংবা মানসিক দৈন্য দশা নিয়ে কথা বলা কঠিনই বটে! শিক্ষার চেয়ে সার্টিফিকেট মুখ্য হয় তখন- যখন ছেলেকে পুঁজিপতির কাছে মূল্যবান এবং মেয়েকে পুরুষের কাছে দামি করে তোলাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আমাদের যত হই-চই-আলোচনা-সমালোচনা সবই যে কাজ করে তাকে নিয়ে। যে অলস, অপদার্থ, কখনোই কিছু করবে না; তার ভুলও হবে না, তাকে বিতর্কিত করার খায়েশও কারো তৈরি হবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম সর্বত্র নেতিবাচকতার জয়জয়কার! ছকবাঁধা-গতানুগতিক কাজের বাইরে কোনো কাজ হলেই অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না, তাদের গাত্রদাহ হয়। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে জনপ্রিয় হবার জন্য যে মেহনত-পরিশ্রম দেখা যায়; তা নিজের আত্মসমালোচনা ও আত্ম উন্নয়নে ব্যয় করা অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হতো! অবশ্য যারা লড়াকু-বিপ্লবী-সংগ্রামী তারা সকল রসিকতা-তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে যান।
অনেকে নিজেকে নায়ক বানাতে চেয়ে কার্যত ভিলেন হয়ে পড়েন। কার কথায় আঞ্চলিক ভাষা চলে আসে, কার চোখের সানগ্লাসটি দামি নয়, চুলের স্টাইল সময়ের সঙ্গে মানানসই নয়, কার পোশাক স্মার্টনেস বাড়ায় না- এসব নিয়ে রসিকতা খুব নীচু স্তরের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। হীনমন্যতার কারণে অনেকে শেকড় ধুয়ে-মুছে ফেলতে চান। তারা যে গ্রামে বড় হয়েছেন তা গোপন করেন, কৃষকের সন্তান বলে পরিচয় দেন না, শহরে এসে সভ্য-সংস্কৃতিবান-আধুনিক হয়ে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলাকে অসম্মানজনক ভাবেন। অন্তরের ভেতরে বিরাজমান শ্রেণিগত বিভাজন ও হীনম্মন্যতাবোধ ইতিহাস-ঐতিহ্য আড়াল বা অতীতের বন্ধুত্ব-সম্পর্ককে অস্বীকার করার প্রবণতা তৈরি করে!
আসলে বৈষম্য ও বিভেদ তাদের অস্থিমজ্জায়; যারা শ্রেণিগত অবস্থান শক্তিশালী হলে রসিকতা করার সাহস দেখান না। আর দুর্বল হলে প্রতিনিয়ত রসিকতা করেন। প্রতিটি ভাষাকে, প্রতিটি অঞ্চলকে, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে, প্রতিটি মানুষকে সম্মান করার যোগ্যতা দুর্বল বিশ্বাসী ভাসমান সংস্কৃতির ধারকদের থাকে না। কতটা মানসিক দৈন্যে ভুগলে নিজের বাবা চাষা বলে পরিচয় দেন না। অথচ যারা নীতি-নৈতিকতা ধারণ করেন না, ন্যায় ও সত্যের পথে থাকেন না, অন্যায়- অপকর্ম করেন, নীতিহীনতা-অনৈতিকতার পক্ষে অবস্থান নেন; তাদেরকেও স্যার স্যার করতে লজ্জা পান না।
অন্যের ভালো কাজকেও অনেকে লোক দেখানো ব্যাপার বলেন, সত্য বললে বোকা ভাবেন, অন্যায়-অসত্যের প্রতিবাদ করে নিপীড়িত হলে অতি আবেগী মনে করেন। একজন নাগরিককে অপমান-অসম্মান-নিপীড়ন করার অধিকার আরেকজন নাগরিকের নেই। অন্যকে ছোট করতে গেলে, তার কাছে নিজেরা ছোট হয়ে যেতে হয়। অথচ সামাজিক ও মানসিক এমন কিছু দৈন্যতা রয়েছে যা থেকে বেরোতে পারে না অনেকেই। এরা অন্যের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য থাকা আবশ্যক মনে করে, আশেপাশের মানুষগুলোর সিদ্ধান্তকে ভুল মনে করে ভুলগুলো শুধরে দেয়ার চেষ্টা করে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে।
কারো স্নেহ-উদ্বেগ অন্যের শিক্ষা, বিয়ে, চাকরি, সংসারের সংবেদনশীল সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রশ্ন তুললে তাতে অন্যকে হেয় করাও হয়! যিনি অন্যকে নিজের পছন্দের বই পড়াতে চান, নিজের পছন্দের চাকরি করাতে চান, অন্যের সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণে উঠে পড়ে লাগেন- তিনি কি অন্যের ভাবনায় ভাবেন! অন্যের জীবনে নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য বিস্তার করা মানসিক দৈন্যতাই প্রকাশ করে! অন্যের আত্মসম্মানবোধকে আঘাতকারীর মানসিকতার মান নিশ্চয়ই নিম্ন! নিজের থেকে অধিক অর্জনের মানুষ অবধারিতভাবেই তার চোখে দোষী, নিজের মনে গড়ে তোলা প্রচ্ছন্ন ঘৃণার পাহাড় ও দৈন্যতার অনুভূতি নিজের চেয়ে উচুশ্রেণির মানুষের উপর ঢেলে দিয়ে নিজের আত্মাকে শীতল করে!
সঠিকভাবে বাংলায় কথা বলতে না পারা মানসিক দৈন্যতা, সন্তানদের মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে না শেখানো বা মাতৃভাষা বাদ দিয়ে শিশুদের ইংরেজি শেখানো মানসিক দৈন্যতা। করোনা আক্রান্তদের সঙ্গে খারাপ-অমানবিক ব্যবহার-আচরণ করা, সামাজিকভাবে হেয় করা, বাড়ির সবাইকে একঘরে করাও মানসিক দৈন্যতা। মানুষের মানবিকতা নষ্ট হলে সামাজিকভাবে দৈন্যদশায় ভূগতে হয়!
নেতিবাচক কিছু একটা ঘটলেই হাজারো ইতিবাচক অর্জনগুলো খাটো করে দেখার চেষ্টা করা মানসিক দৈন্যতা! প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মিথ্যা অপবাদ দেয়া, কুৎসা রটানো মানসিক দৈন্যতা নির্দেশ করে। অনেক বিত্তশালীও মানসিক দৈন্যতার কারণে গরিবানারই প্রমাণ দিতে পারেন!আমরা যতটা পেতে চাই, ততটা দিতে চাই না। অনেক কষ্ট-সাধনা করে ছেলেটি ক্লাসে প্রথম হয়েছে; দেখা হলেই বলবে- পরীক্ষায় প্রথম হলে মিষ্টি খাওয়ালে না! মিষ্টিতো পরিশ্রমী-অধ্যবসায়ী শিক্ষার্থীকেই খাওয়ানো উচিৎ! কাছের মানুষ কষ্টসাধ্য কাজ করেছেন আপনিতো তাকে উৎসাহিত করতে ত্যাগ স্বীকারের কথা!
কাউকে সবার সামনে অপমান করা বা প্রতিনিয়ত ভুল ধরা ঠিক না। সেলফ রেসপেক্ট আর ‘ইগো’ এক নয়। কাউকে বশিকরণ করে ছিনিয়ে নিয়েছে ভাবা মানসিক দৈন্যতা! ভিন্ন পেশার প্রতি বা ভিন্ন মত-দল-মতাদর্শের মানুষের প্রতি নিম্নমানের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণে জাতিগত দৈন্যতা বাড়ে! এক দলের সমর্থক বলে সে দলের সবকিছুকে অন্ধভাবে মেনে নেয়া এবং বাকি সব দলের সব কাজের বিরোধিতা করা মানসিক দৈন্যতা! কথার লড়াইকে সীমা ছাড়িয়ে অশ্লীলতা ও মানহানির পর্যায়ে নেয়া সমালোচনায় মানসিক দৈন্যতাই স্পষ্ট হয়! সব সময় স্যার স্যার করায় মানসিক দাসত্বের পরিচয় পাওয়া যায়!
দুর্বলের ওপর নির্যাতন সবলের মানসিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ! আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকার পরও মানসিক দৈন্যতা থাকে! উচ্চ শিক্ষিত হবার পরও মানসিক দৈন্যতা থাকে! দুর্যোগ-দুর্ভোগের মুহূর্তে বিপদাপন্ন মানুষের নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম রাতারাতি বাড়িয়ে দেওয়া, হাস্যকর সব অনুষ্ঠানাদি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকা, সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করা, দেশের সম্পদ লুটে-পুটে খাওয়া চরম মানসিক দৈন্যতা!
মানসিক দৈন্যতা থাকলে-অযথা দুশ্চিন্তা বাড়ে, নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে থাকে, আপন সৌকর্য ও সৌন্দর্যে অতৃপ্ত থাকে, অন্যের সাথে নিজের তুলনা করে, নিজেকে আপন মহিমায় তুলে ধরে না, যাপিত জীবনের সময়কে মূল্য দেয় না, অন্যদেরকে মানুষ বানাতে চাইলেও নিজে মানুষ হয় না, মনের দারিদ্র দূরীভূত করে না, সুন্দর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে না, স্বস্তা জনপ্রিয়তা এড়িয়ে চলে না। মানসিক সঙ্কীর্ণতা আচ্ছন্ন করে রাখলে হিংসা-পরশ্রীকাতরতা এবং অসহিষ্ণুতা অক্টোপাসের মতো ঘিরে রাখে। কেউ কাউকে ছাড় না দেয়া, সুযোগ পেলেই অন্যের চরিত্রহননে মেতে উঠা, কটুক্তি করা, বে-আদবি করা, অশালীন মন্তব্য করা- অশুভ চর্চা। এসব চেষ্টা থেকে মানসিক দৈন্যতা ও চিন্তার সঙ্কীর্ণতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠে।
যারা নিজের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই দেখে শেষ করতে পারেনি তারাও বলে- টাকার জন্য ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ করতে পারি না। অথচ বিদেশীরাও কক্সবাজার-সুন্দরবন-সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করতে টাকা জমায়। ভ্রমণে টাকার অজুহাত মানসিক দৈন্যতা। শুধু ছবি তোলার জন্য ভ্রমণ একদমই অপ্রয়োজনীয়। সেলফি তোলার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠার উচ্ছ্বাস, হুড়োহুড়ি ও সেলফি তোলার ঘটনা সেলফিকে গুরুত্বহীন করেছে। সেলফিবাজির ব্যাপকতায় সেলফি এখন খুবই হালকা আচরণে পরিণত হয়েছে, সেলফি কান্ড ইমেজকে হেয়ও করছে। তোষণকারী এবং সেলফিবাজি রাজনীতি দেশকে নিচে নামাচ্ছে।
মানসিক দৈন্যদশা অবস্থা হতাশার জন্ম দিচ্ছে। কারো শ্রমকে মূল্যায়ন না করার প্রবণতা সমাজের মানসিক দৈন্যতা । যে মানসিক দৈন্যতায় ভুগে তার কথা ও কাজের মিল থাকে না। মানসিক দৈন্যতা কোথায় এসে দাঁড়ালে সামাজিক বিভক্তিটা এমন চরমে যায় যে- একজন অপমানিত হলে একটি অংশ বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়, একই ধরনের ঘটনা আরেকজনের বেলায় ঘটলে তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না। অসভ্যতায় নিশ্চুপ থাকা মানে, অসভ্যতাকে মেনে নেয়ার মানসিক দৈন্যতায় ভোগা।
আসুন আমরা মানসিক দৈন্যতা কাটিয়ে উঠি!