মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বাঁচার উপায়

সত্যিকার সম্মান সার্থক মানুষরাই পায়। সবাই সম্মানিত হতে চায়, কেউই অসম্মানিত হতে চায় না। সম্মান এমন অমূল্য সম্পদ যার গুরুত্ব অনেকেই বুঝে, তবে সম্মান পাওয়ার উপায় জেনে তা চর্চা কমজনই করে।

অনেক বিত্তবান ও ক্ষমতাবানও মানুষ সম্মান না করায় অসুখী হন। অনেক বিত্তহীন ও ক্ষমতাহীনও সবার সম্মান পান এবং সবার ভালোবাসা অর্জন করেন। যিনি মানুষের কাজে লাগে এমন কিছু করেন, তিনি সম্মান ঠিকই পান।

বহু অর্থ আর প্রতিপত্তি থাকলেই সম্মানিত হওয়া যায় না, বহু মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হয় এমন কাজ করতে হয়। যাদের কাজ মানুষের জীবনকে সহজ করে, ইতিবাচক বদল আনে; তাঁরা নিজের অর্জনও পরকে বিলিয়ে দিয়ে সম্মানিত হন।

মাঝে মাঝেই কথা দিয়ে কথা না রাখলে মানুষের চোখে দুর্বল হয়ে যেতে হয়। না ভেবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভঙ্গ করলে মানুষের কাছে সম্মান কমে যায়। উত্তম বিকল্প ব্যবস্থা না করে শুধু সমালোচনা করলে গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ভুল-ত্রুটি হলেও স্বীকার করে আন্তরিকভাবে ক্ষমা না চাইলে বা নিজেকে সংশোধন না করলে সম্মান হারিয়ে যায়।

বিশ্বাস-সম্মান নষ্ট হওয়ায় অসম্মানিত হতে হয়। অতিরিক্ত ভালো দেখাতে বা মহত্বের পরিচয় দিতে দোষ না করলেও শান্তি রক্ষার্থে দুঃখিত বলে নিজের ঘাড়ে দোষ নেয়াটা দুর্বল মানসিকতা! যিনি অযথা অন্যের সময় নষ্ট করেন, অন্যের কথা-কাজ-সময়ের মূল্য দেন না, কোনো এ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলেও দেরি করেন, কাউকে কাজে ব্যস্ত দেখলেও ফালতু গল্পে সময় নষ্ট করেন; তিনি হন দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

ব্যক্তিত্ববান হওয়া মানে কথার সাথে কাজের মিল থাকা এবং সময় মূল্যহীন কাজে নষ্ট না করা। যিনি কোনো বিষয়ে না জেনে মন্তব্য করেন তিনি অন্যদের চোখে ছোট হয়ে যান। মতের মিল না হলেই ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করা অন্যের মতামতকে অসম্মান করা।

যিনি অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে যুক্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করেন না, ব্যক্তিগত খোঁচা দেন, জ্ঞানের স্বল্পতা নিয়ে তামাশা করেন, অন্যকে ছোট করে দেখেন; তিনি মূলত অহংকার প্রকাশ করেন। নিজেকে যোগ্য মনে করে বড়াই করে সত্যিকার সম্মান পাওয়া যায় না। নিজের যোগ্যতার ওপর যার প্রকৃত বিশ্বাস নেই সেই ইগোকে প্রশ্রয় দেয়।

তিনি প্রাপ্য মূল্য ও সম্মান পান না- যিনি নিজের যোগ্যতার বিষয়ে অতিরিক্ত বিনয় দেখায়ে অনেক ছোট করে নিজেকে তুলে ধরেন। যিনি নিজেকে খুব ছোট করে উপস্থাপন করেন, তার সঠিক যোগ্যতা অন্যরা মাপতে না পারায় তিনি যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মানও পান না। অসৎ মানুষ পূর্ণ সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন না; ফলে অন্যদের কাছ থেকে সম্মান পাওয়াও স্থায়ী হয় না।

যার কথা ও কাজে মিল নেই, চিন্তা-ভাবনা অস্বচ্ছ, অন্যায়ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন- মানুষ তার প্রতি সম্মান হারিয়ে ফেলে। নিজের কাজের ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ায়ে বিভিন্ন আলোচনা ও কাজকে ইতিবাচকভাবে অনেক বেশি প্রভাবিত করা যায়।

যার মতামত ও সিদ্ধান্তের ওপর যত বেশি মানুষের আস্থা বাড়ে- সে তত বেশি মূল্য পায় এবং অন্যের কাছ থেকে সম্মান আদায় করাও তার জন্য সহজ হয়। নেতিবাচক ও হতাশদের কেউ সম্মান করে না। যারা ইতিবাচক-আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী থাকেন, তারা অন্যদের অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করতে পারায় সম্মানও পান।

যারা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না- তারা সম্মান পান না। মিথ্যাবাদী চাপাবাজ ভীরুরা অন্যদের সম্মান পায় না; সত্য প্রকাশ পেলেই একসাগর ঘৃণা পায়।

মর্যাদা ও সম্মান কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কেউই অসম্মানিত হতে চায় না, বিভিন্ন পন্থা ও উপায় অবলম্বন করে সম্মান পেতে চায়। সম্মানিত- মর্যাদাশীল-মর্যাদাবান হবার উপায় হচ্ছে- কারো অঢেল সম্পদ-অর্থ, কারো নেতৃত্ব, কারো স্কুল-কলেজ-মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কারো সামাজিক প্রভাব, কারো রাষ্ট্রীয় প্রতিপত্তি, কারো বড় পদ-পদবি এবং কারো অফিসিয়াল পদ-পদবি।

চরিত্র হারালে বিত্তবান বা পদ-পদবির অধিকারীরও সমাজের কাছে কোনো মর্যাদা থাকে না। অবশ্য আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান ও চরিত্রের গুণে দরিদ্র ব্যক্তিও সমাজে সম্মানিত হয়ে থাকে; সম্মানের সাথে ভালোবাসা সংযুক্ত। ত্রুটি ও খাদহীন নির্ভেজাল সম্মান অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে। ভয় ও সমীহ থেকে ভালোবাসাহীন মেকি সম্মান প্রাপ্তদেরকে মানুষ পেছনে দুই হাত নিয়ে নেয়।

সম্মান-মর্যাদা-ইজ্জত দেয়ার মালিক আল্লাহ; তা কেড়ে নিয়ে লাঞ্ছিত ও হেয়ও করেন আল্লাহ। ক্ষমা করার দ্বারা মানুষের মান বহুগুণে বেড়ে যায়। যারা দান না করে কৃপণতা করে, রাগ নিয়ন্ত্রণ না করে ঔদ্ধত্য দেখায় এবং সৎকর্ম না করে অসৎকর্ম করে- তাদের মর্যাদা ও সুখ-শান্তি কমে যায়। যারা অল্পে তুষ্ট ও পরকালমুখী তারা অন্যদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেন এবং মূর্খতা-দুনিয়াদারী-স্বার্থপরতাকে এড়িয়ে চলেন।

রাগ মানুষকে অভদ্র, উদ্ধত, বদমেজাজি ও অহঙ্কারী করে; রাগ নিয়ন্ত্রণ বিনয়ী-নম্র-ভদ্র বানায়। যারা বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ করে তারা দুনিয়ায় অসম্মানিত হয় এবং পরকালেও অপমানিত হবে। যারা অন্যের কল্যাণ কামনা করে, অন্যকে অকল্যাণের পথ থেকে ফিরিয়ে কল্যাণের পথ প্রদর্শন করে, অন্যের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা লাঘবে সচেষ্ট থাকে তার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

যারা মানুষের মধ্যে বিভেদ লাগায়, গালিগালাজ করে, চায় মানুষ বিভক্ত হয়ে যাক, আলাদা আলাদা সমাজ চায়, মানুষকে অপমান করতে তৃপ্তি পায়, দলাদলি ও কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি করে, অন্যের ন্যায্য অধিকার হরণ করে- মানুষের মনে তাদের জন্য সামান্য পরিমাণও প্রকৃত সম্মান থাকে না।

সম্মান দীর্ঘস্থায়ী হবার জন্য লাগে- চিন্তাধারায় পরিচ্ছন্নতা, স্বভাবে প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, চরিত্রে পবিত্রতা, আচরণে মাধুর্যতা, ব্যবহারে নম্রতা, লেনদেনে স্বচ্ছতা, কথাবার্তায় সত্যবাদিতা, ওয়াদা ও অঙ্গীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবন যাপনে সদাচার, কথাবার্তায় চিন্তার ছাপ, চেহারায় পবিত্রতার ভাব, ভদ্র ভাষায় কথা বলা, কথা ও কাজে মিল, জীবনধারারায় সঙ্গতি এবং বেশ-ভূষণে ও চেহারায় পরিশীলিত ভাব।

যারা আল্লাহকে বেশি ভয় করে, বেশি নেককার ও বেশি পরহেজগার তারাই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাশীল। বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তা সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি নয়। যারা বেহায়াপনা করে, কাজে-কর্মে নির্লজ্জতায় লিপ্ত, ফাহেশা কথা বলে, চারিত্রিক কদর্যতায় ভরা- তাদের সম্মান বিনষ্ট হয়। অবৈধ উপার্জন করে সম্মানের জন্য বৈধ পথে খরচ করে সত্যিকারার্থে সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়া যায় না।

কপট মানুষের মুনাফেকি বা দ্বিমুখী নীতি তাকে সমাজের একজন ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। অহঙ্কারবশত নাক উঁচু করে চললে মানুষ দূরে চলে যায় এবং সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়। যারা একে অপরের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে, পরস্পর শুত্রুতা করে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে তারা কখনোই সমাদৃত হয় না।

মানুষ অসম্মান করে- কথায় কথায় মিথ্যা বলা পাক্কা মিথ্যুকদের, মাত্রাতিরিক্ত মিথ্যা রচনাকারীদের, অতিমাত্রার লোভ-লালসা সম্পন্নদের, কৃপণতা কারীদের, স্বার্থান্ধতায় পরিপূর্ণ মনের, পরনিন্দা-পরচর্চা-পরশ্রীকাতরতায় ভরপুর অন্তরের। সম্মান পাবার যোগ্যরা বেহুদা কথা ও বেহুদা কাজ করেন না, জুলুম-নির্যাতন করেন না, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করেন না।

সম্মান অর্জনের উপায় হচ্ছে- এমন কিছু করা যা সত্যিই মানুষের কাজে লাগে। কথা দিয়ে কথা রাখা। দোষ না করলে দুঃখিত না বলা। ভুল করলে স্বীকার করা এবং সংশোধন করা। অন্যের সময় নষ্ট না করা। না জেনে মন্তব্য না করা, প্রয়োজনে চুপ থাকা। অন্যের মতামতকে সম্মান জানানো।

অহঙ্কার না করা। অতি বিনয় পরিহার করা। সৎ থাকা। কথা ও কাজে মিল রাখা। সব সময় নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করা। ইতিবাচক থাকা ও অন্যদের অনুপ্রাণিত করা। আবেগের বদলে যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। সব সময় সত্যি কথা বলা এবং সাহস প্রকাশ করা।

তিনিই সম্মান পাবার যোগ্য, যিনি অন্যকে মন থেকে সম্মান দিতে পারেন। তাকে অন্যরা বেশি দিন সম্মান দেয় না- যারা অন্যকে অসম্মান করে কথা বলে, অন্যকে ধোঁকা দেয়, সম্পর্ককে সম্মান করে না, বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য বিরোধিতা করে , নিজেকে বড় করে দেখানোর জন্য অন্যকে অপমান করে, অন্যকে মূল্যায়ন করে না এবং অন্যের সাথে ভালো আচরণ করে না।

অথচ সম্মান দিলেই কেবল সম্মান পাওয়া যায়! মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মানের চোখে দেখতে না পারলে নিজের সম্মানও শেষ হয়ে যায়! যারা মানুষের মধ্যে বিভেদ লাগায়, গালিগালাজ করে, চায় মানুষ বিভক্ত হয়ে যাক, আলাদা আলাদা সমাজ চায়, মানুষকে অপমান করতে তৃপ্তি পায়, দলাদলি ও কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি করে, অন্যের ন্যায্য অধিকার হরণ করে, মতবিরোধ মিটিয়ে না ফেলে নতুন নতুন বিভক্তি গড়ে তোলে- মানুষের মনে তাদের জন্য সামান্য পরিমাণও প্রকৃত সম্মান থাকে না।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *