‘মন’ কি কোনো অদৃশ্য শক্তির দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয় নাকি দৃশ্যমান বাস্তবতা দ্বারাই প্রভাবিত হয়। মানসিক প্রতিক্রিয়া কি পারিপার্শ্বিক বাস্তবতারই ফলাফল নাকি আচরণিক বহিঃপ্রকাশ মানবিক অবস্থারই প্রতিফলন মাত্র। পরিবেশ মনকে নিয়ন্ত্রণ করে নাকি মনের কার্যক্রিয়াই ‘বাস্তবতার স্বরূপ’ নির্মাণের প্রচেষ্টা চালায়। ‘মানব মন’ কতটুকু স্বাধীন? কতটুকু স্বাধীন হওয়া তার জন্য সম্ভবপর? ‘মনের স্বাধীনতা’ তার জন্যে কল্যাণকর নাকি অকল্যাণকর? ‘মানব মন নিয়ন্ত্রণ’ কতটুকু প্রাসঙ্গিক? এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? আদৌ মানব মন নিয়ন্ত্রণ বাস্তব সম্মত কি-না?
আসলে মন এর স্বরূপ, কার্যক্রিয়া এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট জগৎ অনুধাবণ আয়াসবোধ্য কিছু নয়। অত্যন্ত সরলভাবে মন সংক্রান্ত ধারণা হাজির করা কঠিন। মন প্রসঙ্গ অত্যন্ত জটিল। ‘মানব মনের স্বেচ্ছাচারিত’ সমাজে ‘ইতিবাচক’ নাকি ‘ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সামাজিক প্রয়োজনেই ‘মানব মনকে’ ‘ইচ্ছা স্বাধীনতা’ কে নিয়ন্ত্রণ করা হয় নাকি ব্যক্তিসত্তা বিদ্যমান জগতের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কে শক্তিশালী দেহ নাকি মন? মনই দেহকে সচল রাখে নাকি দেহই মনকে ক্রিয়াশীল রাখে? দেহ ও মনের কর্মকাণ্ড বা অস্তিত্বকে আলাদা করে ভাবাটা সমীচীন কী-না? একত্রে ভাবলে সেটা কীভাবে যৌক্তিক?
প্রত্যেকটা মানবদেহেই কি মনের উপস্থিতি আছে? তাহলে মানুষের এত বৈচিত্র্য, এত ভিন্নতা কেন? ধরে নেব সবার মন আছে তবে একই ধরনের নয়। দৈহিক সৌন্দর্য, শারীরিক গঠন, শিক্ষা, বংশগত ভিন্নতা এগুলোর কার্যক্রিয়া কি মনের ধরণ ঠিক করে? নাকি ভিন্ন ধরনের মনআছে? থাকলে কী রকমের? মন কি কখনো চেতন কখনো অবচেতন থাকে? এর মূলত কাজটা কী? আমরা অনেক পঙ্গু, প্রতিবন্ধি, অসুস্থ মানুষকেও দেখি অফুরন্ত প্রাণশক্তির জোরে কি বিপুল প্রাণচঞ্চলতা দেখিয়েছেন। ক্ষীপ্ততা, উদ্দীপ্ত করে, উজ্জীবিত করে, অনুপ্রাণিত করে আমাদের। শারীরিক দুর্বলতা মনের অসাধারণ শক্তির কাছে হেরে গেছে। অস্বাভাবিক জীবনযাপনকারী মানুষও মনের শক্তির জোরে অসাধ্যকে সাধ্য করেছেন। মনই মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যেখানে মনের শক্তিই সকল শক্তিকে ছাড়িয়ে গেছে।
এখন মন কীভাবে গড়ে ওঠে? এটির রূপ কি পরিবর্তন হয় নাকি স্থির? মন কী শুধু মানুষেরই আছে নাকি অন্য প্রাণীরও? শুধু মানুষের থাকলে মন থাকার জন্য কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা প্রয়োজন। মন কীভাবে থাকে, কোথায় থাকে, এর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী নাকি চিরস্থায়ী। ‘মনমরা’ ‘মনতাজা’ ‘সতেজ মনের অধিকারী’ ‘দুর্বল মনের অধিকারী’ –তার মানে মনের নানা রূপ আছে? ‘সুন্দর মনের মানুষ’ ‘অসুন্দর মনের মানুষ’ ও আছে? তাহলে মনটা ভাল হলে মানুষটাও ভাল হয় নাকি ভাল মানুষের মনটাও ভাল হয়? এখন ‘সুন্দর মন’, ‘অসুন্দর মন’ বলে কি ভিন্ন ধরনের মন নাকি ‘মন’ কে কীভাবে ব্যবহার করা হয় তার উপর নির্ভর করে এই পরিচয় নিহিত হচ্ছে। ‘অন্তর্নিহিত শক্তি’ ছাড়া ‘বাহ্যিক শক্তি’ কী আদৌ মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? মন কী আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? হলে সেটা কীভাবে? মন জগতের সাথে কী ভিন্ন কোনো জগতেও যোগসূত্র আছে। মনই মনোজগত তৈরি করে নেয় নাকি ভিন্ন কোনো জগৎ নানান প্রক্রিয়ায় মনোজগৎ গঠন করে? মনোজগৎটা আসলে কী? এ জগতের অস্তিত্বটা কীভাবে প্রমাণ করা সম্ভব? কি আচরণ করা হবে তাকি মনই ঠিক করে দেয় নাকি অন্য কেউ?
সবারই যদি মন থাকে তবে মন আছে মানে জীবন আছে। মন নেই মানে জীবন নেই। তাহলে ‘প্রাণ’ ‘মন’ জীবন এগুলোকে কীভাবে দেখা যায়? মানুষের জীবন আছে বলে জীব, প্রাণ আছে বলে প্রাণী মন আছে বলে যদি মানুষ হয় তবে কী মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর মন নেই। তাহলে ‘মনহীন প্রাণী’ আর ‘মনযুক্ত প্রাণী’ দুটোর কি কি ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে? টাকা আছে তবে মন নেই, ‘সুন্দর কিছু করার জন্য তো মন থাকা প্রয়োজন’ ‘ওর আবার মন, ওরতো মনই নেই’ তার মানে মন মানেই ইতিবাচক কিছু, ভালো কিছু, আবার মন বলে যদি কিছু থাকত তবে এমন নিষ্ঠুর কাজটা করতে পারতি না’-তার মানে সবারই মন থাকে না!
‘তোর মনটাই কুৎসিত’ তার মানে মন কুৎসিত হতে পারে, সুন্দরও হতে পারে। এক্ষেত্রে কে দায়ী মন নিজে, নাকি দেহ নাকি এ দুটো ছাড়া অন্য কেউ? মনের মতো মানুষ মানে তার আচরণ পছন্দ। তার মানে আচরণ মনের রূপের প্রতিফলন। আচরণেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মন কেমন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মন নিয়ে যত ধরনের কথাই হোক মনের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ সংশয় নেই। সুন্দর মনের মানুষ সুন্দর পৃথিবী গড়ায় ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাবে এটাই প্রত্যাশা।