ভেঙে যাচ্ছে পরিবার, হয়ে উঠছে রণক্ষেত্র

ভেঙে যাচ্ছে পরিবার

তিলে তিলে গড়ে তোলা সোনার সংসার মুহূর্তেই ভেঙে যাচ্ছে, অনিরাপদ ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। পরিবার ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে এখন একক পরিবার হচ্ছে। বিবাহ কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বেশিরভাগ দেশগুলিতেই সাম্প্রতিক দশকগুলিতে মানুষের বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর হার কমেছে। তবে সব দেশেরই চিত্র এমন নয়। মানুষের পবিত্র আশ্রয়ের অদ্বিতীয়  সংগঠনটি ভেঙে যাচ্ছে ঠুনকো কারণে, মাঝে মাঝে তা হয়ে উঠছে রণক্ষেত্র। যতই দিন যাচ্ছে ততই কেমন জানি ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছি। সবচেয়ে নিরাপদ ও আস্থার জায়গা পরিবারের ভেতরই সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছে।

 পরিবার ভেঙে যাওয়ার নেপথ্যে

চারদিকে ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে। আধুনিক সমাজে পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার গঠন এবং জীবনযাত্রা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়াটা কুফল বয়ে আনছে।  সমাজ পরিবর্তনের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন চর্চার বিষয়টি ভেঙ্গে পড়েছে। সমাজে একটা শূন্য অবস্থা তৈরি হওয়ায় শিশু কিশোররা নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ভিডিও চ্যাটের মধ্যে দিয়ে ভার্চুয়াল বিশ্বে বেশি সংযুক্ত হয়ে সরে যাচ্ছে নিজের পরিবার প্রিয়জনেদের কাছ থেকে!  পরিবার-পরিজনদের থেকে আলাদা হয়ে সকলেই যেন কেমন নিজের দুনিয়া গড়ে তুলছেন। বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে ক্রমাগত।  যা সমাজের জন্য অশনি সংকেত। পরিবারে অশান্তির পেছনে সাম্প্রতিক প্রবণতা নিচে দেয়া হলো-

বিবাহবিচ্ছেদের উর্ধ্বমুখী প্রবণতা

৭০ এর দশক থেকে বিশ্বব্যাপী বিবাহবিচ্ছেদের হারে উর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই হার দেশে-দেশে বিভিন্নরকম। তবে তরুণ দম্পতিদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার তুলনামূলক কম। ধনী দেশগুলিতে বিবাহ বিচ্ছেদের আগে বিবাহের গড় দৈর্ঘ্য সাম্প্রতিক দশকগুলিতে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল এবং তবে এখন কিছু ক্ষেত্রে এটি আরও বেড়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৪ সালে প্রতি ১০০০ জনে ৬.৮ জন বিবাহ করেছে এবং প্রতি ১০০০ জনে ৩.২ জনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। বিবাহিত ১০০০ নারীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ১৬.৯।দেশটিতে প্রায় ৫০ ভাগ বিয়েই ডিভোর্স বা সেপারেশনের মাধ্যমে শেষ হয়। ডিভোর্সের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটার শতকরা হার- প্রথম বিবাহের ক্ষেত্রে ৪১, দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে ৬০, তৃতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে ৭৩।

বাংলাদেশেও বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। বিবাহবিচ্ছেদের ৭০ ভাগ আবেদনই এসেছে নারীদের পক্ষ থেকে। ২০১৯ সালেও প্রতি মাসে গড়ে ৯২০টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। নারীরা উদ্যোগী হয়ে বেশি তালাক দেয়ার পেছনের কারন- নারীর ক্ষমতায়ন, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি। পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে ক্রমশ৷ যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে মানুষ৷ ভালোলাগা-ভালোবাসাও যাচ্ছে কমে৷ ফলে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ।

 

লিভটুগেদার বৃদ্ধি

বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়াই একসাথে বসবাস করছে এবং যৌন সম্পর্ক করছে এদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী অবিবাহিত জুটিদের একসাথে বসবাস করার হার ১৯৬৮ সালে ছিল ০.১% আর ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৪%। বর্তমানে বেশিরভাগ আমেরিকান বিবাহিত দম্পতির মতেই অবিবাহিত দম্পতিরাও আইনী অধিকার পেয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যে বিবাহিতদের ৮৫% মানুষই বিবাহের আগেই শারীরিক সম্পর্কে জড়ান। অনেকে বিয়ে করার আগে সঙ্গীকে জানার জন্যও লিভ টুগেদার করেন।

পাশ্চাত্য দেশগুলোতে এমনও দেখা গেছে যে ছেলেমেয়েসহ তারা বিয়ের আসরে বসেন। এমনকি ঢাকা শহরেও বিয়ে না করেই সংসার করছে অনেক জুটি, যারা বিবাহ বন্ধনে বিশ্বাসী না। উচ্চবৃত্তের দরজা পেরিয়ে লিভটুগেদার পৌঁছে গেছে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবৃত্তের দরজায়। যারা মনে করে বিয়েতে অনেক দায়িত্ব, তাই নিজেদের মতো করে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে এ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। ভালোবাসা এখন দেহনির্ভর, মনের আবেদনহীন।

অবিবাহিত যুগলের একত্রে বসবাসের উপর আরোপিত নানা বিধিনিষেধ শিথিলের ঘোষণা দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) সরকার। ভারতেও লিভ-টুগেদার সম্পর্ক আইনসভা দ্বারা অনুমোদিত এবং প্রটেকশন অফ উইমেন ফ্রম ডমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট, ২০০৫  এও বিষয়টি স্বীকৃত। তবে বিয়ের আগে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড স্বামী স্ত্রীর মতো একসঙ্গে থাকার এই লিভ টুগেদার আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ।

সম্পর্ক ভাঙার প্রবণতা বাড়ছে

দূরত্ব বাড়ছে। সুন্দর সম্পর্কগুলোর ঘটছে চরম পরিণতি। কারণ কমছে কমিউনিকেশন। কমিউনিকেশন গ্যাপ হলে সম্পর্ক মরে যায়। অত্যাধিক নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টার জেরে অন্য জন ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে। নেশাগ্রস্ত স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে কেউই সংসার করতে চান না। আর্থিক সমস্যা, অভাব-অনটন, অস্বচ্ছতা বিচ্ছেদ ডেকে আনে। পছন্দে অমিলে বাড়তে থাকে অশান্তি। ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়ার অনুভূতি সেন্স অব সেপারেশন তৈরি করে। একজন পার্টনারের পেশাগত জীবনকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া, কর্মক্ষেত্রে বেশিক্ষণ সময় দেওয়ায় অন্যজন একাকিত্বে ভুগে বা বাড়তে থাকে দূরত্ব।

পরকীয়া প্রেম

বিয়ের পর স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন পুরুষ বা মহিলার সাথে প্রেমকেই পরকীয়া প্রেম বলে।  দাম্পত্যজীবনের প্রথম শর্তই হলো ‘বিশ্বাস’ আর সেটা যদি না থাকে তাহলে অবশ্যই তা তালাকের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ দাম্পত্যজীবনকে ছেলেখেলা ভেবে অনেকেই অন্য নারী বা পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায় কিংবা পুরনো প্রেমের সম্পর্ককে আবার জিইয়ে তোলে৷ এমনটা হলে স্বাভাবিকভাবেই অপরজনের পক্ষে তা মনে নেওয়া সম্ভব হয় না, ফলে বিয়েটা ডিভোর্সে গিয়ে শেষ হয়৷

স্বামী স্ত্রীকে সময় না দেয়ার কারণে স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন৷ সেখানে কারো সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে৷ এক পর্যায়ে পরকীয়ার সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছেন তাঁরা৷ শেষ পর্যন্ত তালাক পর্যন্ত গড়াচ্ছে বিয়ে৷আমেরিকার নিউ ওমেন ম্যাগাজিনের জরিপে জানা যায় চাকরিজীবী বিবাহিত নারীরা তাদের কর্মস্থলেই ‘লাভার’-দের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করে থাকেন। আমেরিকান সমাজে অবিশ্বস্ততার হার দিনে দিনে বাড়ছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে জানা যায় যে, ২৫ শতাংশ পুরুষ পরকীয়া করছে এবং ১৭ শতাংশ নারী তাদের স্বামীদের প্রতি বিশ্বস্ত নয়।

মা-বাবার পরকীয়া প্রেমে কষ্ট পায় তাদের সন্তানরা। বিশেষ করে তাদের বয়স যদি কম হয়। হঠাৎ করে মা-বাবার মধ্যকার সম্পর্ক বা অন্যরকম আচরণ শিশুদের আতঙ্কিত করে। শিশুমনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা হয়ত সারাজীবন থেকে যায়। দাম্পত্য জীবনে অশান্তির একটি বড় কারণ হচ্ছে পরকীয়া। এ কারণে বহু সংসার ভেঙে যায়। একজন পার্টনার পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে গেলে, অন্যজন তার প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও অনেক সময় নিজেকে অন্য আরেকজনের সাথে জড়িয়ে ফেলেন।  পরকীয়ার ছোবলে একটি সুন্দর সংসার তছনছ হয়ে যায়, সন্তান হারায় তার প্রিয় মা-বাবাকে, স্বামী হারায় তার স্ত্রীকে,  স্ত্রী হারায় তার স্বামীকে এবং কোনো মা হারায় তার সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা একটি পরিবার।

পারিবারিক সহিংসতা

বাড়িতে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতন করাকে ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ বলা হয়৷ মানসিক নির্যাতন সেভাবে প্রমাণ করা না গেলেও, শারীরিক নির্যাতন তার প্রমাণ রেখে যায়৷ এই নির্যাতনের স্বীকার হয় সাধারণত নারীরাই৷ এই যন্ত্রণা ও অত্যাচার বেশি দিন সহ্য করা সম্ভব হয় না৷ তাই এ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ডিভোর্সের আবেদন করে থাকেন জার্মানিতে৷

দেরীতে বিবাহ বাড়ছে

বেশিরভাগ দেশেই মানুষ জীবনে দেরীতে বিবাহ করছে। ইংল্যান্ড ও ওয়ালসে ৩০ বছর বয়সেই বিয়ে করেছে – ১৯৪০ সালে জন্ম নেয়াদের ৮৩%, ১৯৫০ সালে জন্ম নেয়াদের ৭৯%, ১৯৬০ সালে জন্ম নেয়াদের ৬৪%, ১৯৭০ সালে জন্ম নেয়াদের ৪১% আর ১৯৮০ সালে জন্ম নেয়াদের ২৫%। সুইডেনে নারীদের বিয়ের গড় বয়স ১৯৯০ সালে ছিল ২৮,  ২০১৭ সালে ৩৪ বছর হয়েছে। ১৯৭১ সালে ব্রিটেনে ২৫ থেকে বছর বয়সী নারীদের প্রায় ৮৫% বিবাহিত ছিলেন; ২০১১ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮%।

ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ন্যাশনাল ম্যারিজ প্রজেক্ট এর এক গবেষণায় দেখা গেছে গত শতাব্দীতে ছেলেদের গড় বিয়ের বয়স ছিলো ২৩ বছর, মেয়েদের ২২ বছর।এই শতাব্দীতে ছেলেদের গড় বিয়ের বয়স ২৮ বছর,মেয়েদের ২৭ বছর। অথচ দেরিতে বিয়ে করলে বেশিরভাগ নারীই কিছু মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন। একাকীত্ব থেকে বিষণ্ণ হয়ে যাওয়া, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, নিজেকে অযোগ্য মনে করা, চাপের মুখে ভুল মানুষকে বেছে নেওয়া, খুব কাছের বোন বা বান্ধবীর প্রতিও ঈর্ষা হওয়া এবং বিয়ে করার জন্য তাড়াহুড়া করতে গিয়ে নিজেকে হাস্যকর করে ফেলা।

যুক্তরাষ্ট্রের উচাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিকোলাস এইচ উলফিঙ্গার আট বছর ধরে এক গবেষণা শেষে জানিয়েছেন, বিয়ের করার জন্য আদর্শ বয়স ২৮ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে। এ সময়ের মধ্যে যাঁরা বিয়ে করেন, দাম্পত্য জীবনে তাঁদের বিচ্ছেদের ঝুঁকি অনেক কম। ৩২ বছরের পর থেকে ৪০ বছরের মধ্যে বিয়ে করলে বিচ্ছেদের আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ৩২ বছরের পর বা তার থেকে বেশি বয়সে যাঁরা বিয়ে করেছেন, তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা প্রতিবছর গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। যাঁরা দেরিতে বিয়ে করেন, তাঁদের জীবনে সাফল্যও দেরিতে আসে। এমনকি সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়।

অনেক ছেলে দেরিতে বিয়ে করতে চায়- ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে গিয়ে, ক্যারিয়ারটা একটু গুছিয়ে নিতে চেয়ে, বিয়ে করলে স্বাধীনতা নষ্ট হবে ভেবে, মনমতো কিছু করতে পারবে না ভেবে, ছোট ভাইবোনের বিয়ে-পড়াশোনা ও বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করে, আয়-উপার্জন কম থাকায় ভয় পাওয়া, দ্রুত কমিটমেন্টে জড়াতে চায় না, সঠিক জীবনসঙ্গীর জন্য অপেক্ষা, দায়িত্বের বাড়তি ঝামেলা নিতে না চাওয়া, অন্যদের বিবাহিত জীবনে নানা সমস্যা দেখে বড় হওয়ায় বিয়েকে ভয় পাওয়া।

বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশে গড় বিয়ের বয়স প্রায় ত্রিশ। কিন্তু একজন মেয়ে প্রথম সেক্স করে গড়ে সাড়ে ষোল বছর বয়সে। এরপর ১৮ বছর হলে লিভ টুগেদারে যায় কিংবা ইচ্ছেমত পছন্দের পার্টনার খুঁজে নেয়। কিন্তু এদেশে একটা মেয়ের পিরিওড শুরু হয় গড়ে ১২-১৩ বছর বয়সে। সে বিয়ে করছে ৩০ বছর বয়সে। আর পিরিওড বন্ধ হচ্ছে গড়ে ৪৯ বছর বয়সে। প্রজননকাল (১৫ থেকে ৪৯ বছর) এর প্রথম অর্ধেক সময়ই সে অবিবাহিত অবস্থায় কাটাচ্ছে। পশ্চিমারা এসময় বিয়ে না করলেও তাদের শারীরিক চাহিদা ঠিকই মেটাচ্ছে। ত্রিশের পর থেকে মেয়েদের সন্তানধারণ ক্ষমতা কমতে থাকে, ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণমান কমতে থাকে। পঁয়ত্রিশের পর থেকে এই ক্ষমতা আরো দ্রুত কমতে থাকে এবং চল্লিশে গিয়ে এই ক্ষমতা অর্ধেকে নেমে আসে। তরুণী (১৯-২২) বয়সী মায়েরাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যবান বাচ্চার জন্ম দেয়।

প্যারেন্টিং
সুন্দর পরিবারের জন্য চাই পারস্পরিক সুন্দর বোঝাপড়া..

ছেলেদের যৌনআকাঙ্ক্ষা বিশ বছরে সর্বোচ্চ লেভেলে থাকে ও আটাশ বছর পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকে। এরপর চল্লিশ বছর পর্যন্ত ধীরে ধীরে কমতে থাকে। চল্লিশ বছর পর এই কমার হার দ্রুত হয়। একজন পঁয়তাল্লিশ বছরের লোকের অনুভুতি একজন পঁচিশ বছরের লোকের অনুভুতি অপেক্ষা অর্ধেক হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর পার হয়ে গেলে বাবা হওয়ার সক্ষমতা বিশ বছরের পুরুষদের চেয়ে পাঁচগুণ কমে যায়। এই কারণে একটা নির্দিষ্ট বয়স পার হলে অনেকে বাকি জীবন বিয়ে ছাড়াই থেকে যায়। যেসব দেশে বিয়ের বয়স বেশি, তাদের ফার্টিলিটি রেট বা সন্তানধারণ ক্ষমতার হারও অনেক কম। তারা দেরীতে বিয়ে করছে, অন্যদিকে তাদের জনসংখ্যাও কমছে।

সিঙ্গেল প্যারেন্টদের সংখ্যা বৃদ্ধি

ধনী দেশগুলোতে সন্তানপালনকারী স্ত্রী-বিচ্ছিন্ন স্বামী বা স্বামী-বিচ্ছিন্ন স্ত্রী তথা সিঙ্গেল প্যারেন্টিং একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সারা বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক দশকে সিঙ্গেল প্যারেন্টদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সাধারণত সিঙ্গেল প্যারেন্ট গৃহাস্থলীগুলো অর্থনৈতিকভাবে বেশি নাজুক অবস্থায় থাকে। ২০১৭ সালে ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে দারিদ্রতা বা সামাজিকভাবে বয়কটের ঝুকিঁতে থাকার হার সিঙ্গেল প্যারেন্ট গৃহস্থালীর ৪৭% এবং টু প্যারেন্ট গৃহস্থালীর ক্ষেত্রে ২১%।

সমলিঙ্গে বিবাহের আইনী বৈধতা

২০০০ সাল পর্যন্ত কোনো দেশেই সমলিঙ্গে বিবাহের আইনী বৈধতা ছিল না। তখন থেকে ২০ বছর পরে দেখা যায় ৩০টি দেশ সমলিঙ্গে বিবাহকে আইনী বৈধতা দিয়েছে। ২০০০ সালে নেদারল্যান্ডস প্রথম দেশ যারা সমকামীদের মধ্যে বিবাহকে আইনী স্বীকৃতি দেয়। সমলিঙ্গে বিবাহ বৈধ ছিল ২০০৫ সালে ৪টি দেশে, ২০১০ সালে ১০টি দেশে, ২০১৫ সালে ২২টি দেশে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৩০টি দেশে। ১৯৬০ সালে সমলিঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ফেীজদারি অপরাধ বিবেচনা করা হতো ৭৭% দেশে। অথচ ২০১৯ সালে সমলিঙ্গে বিবাহকে ফেীজদারি অপরাধ বিবেচনা করছে মাত্র ৩৪% দেশ।

সন্তান জন্ম দেয়ার প্রবণতা কমছে

১৯৫০ সালে একজন নারী তাঁর পুরো জীবনে গড়ে ৪.৭ টি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু ২০১৭ সালে সেটি ২.৪ এ নেমে এসেছে। একটি দেশে জন্মহার যদি ২.১ এর নিচে নেমে যায় তাহলে সে দেশের জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। অথচ ব্রিটেনের জন্মহার ১.৭। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সহজলভ্যতা ও শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসার কারণে নারীদের সন্তান জন্ম দেবার প্রবণতা কমে গেছে। যা সমাজের উপর একটি গভীর প্রভাব ফেলছে।  পশ্চিমা দেশগুলো অভিবাসনের মাধ্যমে সে ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে।

গর্ভ ভাড়া ও টেস্ট টিউব বেবি

আইনগত জটিলতা এড়াতে বাংলাদেশে গর্ভ ভাড়া দেয়া বা নেয়ার বিষয়টি গোপনে হচ্ছে ৷ আইনগত বৈধ না হওয়ায় গোপনে গর্ভ ভাড়া নিয়ে সন্তানের বাবা-মা হওয়ার ঘটনা ঘটছে৷  কেউ কেউ ঝামেলা এড়াতে বিদেশে, বিশেষ করে ভারতে গিয়ে গর্ভ ভাড়া নিচ্ছেন৷ ফিরছেন সন্তান নিয়ে৷ বাংলাদেশে গর্ভ ভাড়া নিতে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা থেকে দশ লাখ টাকা লাগে৷ গর্ভ ভাড়া দেয়া নারী (সারোগেট মাদার) ক্লিনিক বা চিকিৎসকরাই যোগাড় করে দেন৷  চেইন গড়ে উঠছে৷

তবে গর্ভ ভাড়া নেয়ার বিষয়টি প্রধানত উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে৷ অনেক ব্যস্ত নারী যাদের সন্তান ধারণের মতো দীর্ঘসময় হাতে নেই অথচ সন্তান চাই, এমন নারীরাও সারোগেট মাদারের শরণাপন্ন হন৷ তরুন এবং অল্প বয়সে তালাক প্রাপ্ত অনেকের মধ্যে সারোগেট মাদার হওয়ার  আগ্রহ দেখা যাচ্ছে৷ টেস্ট টিউব বেবি’র বিষয়টি আইনগতভাবে এখানে বৈধ  এবং প্রকাশ্য।  নিঃসন্তান দম্পতিরা আড়াই লাখ থেকে চার লাখ টাকা খরচ করে টেস্ট টিউব বেবি  নিচ্ছেন৷

 অসহায় সন্তানেরা

ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চারা বাবার বাড়ি আর মায়ের বাড়ি করে করে  ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নিজেদেরকে যাযাবর মনে করে,  ছন্নছাড়া হয়ে যায়, স্বপ্ন ভেঙে যায়, প্রচণ্ড রকমের চাপে থাকে আর সামাজিকভাবে হেয়ও হয় । দেখাশোনা করার থাকে না বা যত্ন নেয়ার থাকে না।  আসলে বাবার আসনে যেমন অন্য কাউকে বসানো যায় না, মায়ের আসনেও অন্য কাউকে বসানো যায় না। বাবা-মায়ের রিপ্লেসমেন্ট হয় না, ফলে কোনোদিন অস্বস্তিও কমে না। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায়ও কথা প্রসঙ্গে বাবা-মা এলেই কোনো একটা অজুহাত দিয়ে সটকে পড়ে। সমবয়সী ছেলেমেয়েরা ওকে খেলায় নিত না; মা-বাবা ছাড়া বেড়ে ওঠা সন্তানের ক্যাপারে মানুষের নেতিবাচক মনোভাব ও অন্যদের অবজ্ঞার আচরণের কারণে।

সূত্র: www.worldometers.info, ডয়েচে ভেলে, বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, জাগো নিউজ, যুগান্তর, আনন্দবাজার, এনটিভি অনলাইন, বাংলাদেশ প্রতিদিন, মানবজমিন, কালের কণ্ঠ, ourworldindata.org এবং www.wf-lawyers.com

About আনিসুর রহমান এরশাদ

শিকড় সন্ধানী লেখক। কৃতজ্ঞচিত্ত। কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। ভেতরের তাগিদ থেকে লেখেন। রক্ত গরম করতে নয়, মাথা ঠাণ্ডা ও হৃদয় নরম করতে লেখেন। লেখালেখি ও সম্পাদনার আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন সময়ে পাক্ষিক-মাসিক-ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন, সাময়িকী, সংকলন, আঞ্চলিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ ও জাতীয় দৈনিকের সাথে সম্পর্ক। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা, গবেষণা, লেখালেখি ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। পড়েছেন মিডিয়া ও জার্নালিজমেও। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা গ্রামে।

View all posts by আনিসুর রহমান এরশাদ →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *