অনেক পুত্রবধূ নিজের সুখ নিশ্চিত করতে নিয়ে শাশুড়িকে অভিশাপ ভেবে থাকে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। পুত্রবধূ শাশুড়ির স্থান নিজ মায়ের আসনে আসীন করলে তার শাশুড়িও তাকে মেয়ের জায়গায় স্থান দিবেন। মায়ের তুল্য শাশুড়ি ও পিতৃতুল্য শ্বশুরের সাথে যথাসাধ্য সম্মান প্রদর্শনপূর্বক মাধুর্যপূর্ণ আচরণ করা উচিত। স্বামীর ছোট বোনকে নিজের ছোট বোন ভাবা, সুন্দর ব্যবহার করা ও ভালোভাবে কথা বলা শান্তি বজায় রাখে। অনেক উচ্চশিক্ষিত পুত্রবধূ শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর বাড়ির অন্যদের খেদমত করা আইনের দৃষ্টিতে তার ওপর বর্তায় না বলে এড়িয়ে যেতে চান। তারা ভুলে যান আইনের শুষ্ক-রুক্ষ পথে সুখের সংসার রচিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন-ত্যাগ,ভালোবাসা,অন্যকে নিজের উপর প্রাধান্য দেয়ার মানসিকতা, সেবা ইত্যাদি মহৎ গুণাবলির চর্চা। সুখের নীড় রচিত করতে পুত্রবধূর উচিত স্বেচ্ছায় শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা, একে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করা। শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা আইনত ফরয না হলেও নৈতিক ফরয।
ছাড় দেয়ার মানসিকতা রাখা
পারিবারিক শান্তি অনেক বড় শান্তি। ছোটখাটো কিছু সমস্যা সব দম্পতির মধ্যেই থাকে। ছাড় না দেয়ায় সেটা বড় আকার ধারণ করলেই শুরু হয় অশান্তি। বৌয়ের সাথে নিজ পরিবারের সদস্যদের সম্পর্ক ভালো না হলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় ছেলে, সবার কাছে ছেলেটাই বেশি খারাপ হয়ে ওঠে। মা বুঝতে চায় ছেলেটি বিয়ে করে পর হয়ে গেল নাকি পরের বাড়ির মেয়ে নিজের পরিবারের সবাইকে আপন করে নিল। বৌও বুঝতে চায় স্বামী কি এখনো মায়ের আঁচল তলে আছে নাকি বউ এর বাহুবন্ধনে আছে। এই দুটি জিনিস যে পুরুষ যত ভালো করে ব্যালান্স করতে পারবে তার সংসারে বৌ-শাশুড়ি সম্পর্ক তত ভালো হয়। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায়টা ছেলের ওপরেই বর্তায়। অনেক সময় ছেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন, কোনো কুলই রক্ষা করে উঠতে পারেন না।
আপন করে নিতে হবে
কেউ নারী নাকি পুরুষ তার চেয়ে বড় কথা সে সৎ, আদর্শবান, ভালো কাজের প্রতি উৎসাহী ও জ্ঞানবান কিনা। নারীর জীবন সুন্দর ও সার্থক করতে হলে তাকে যেমন সততা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে জীবন পরিচালনা করতে হয় পুরুষকেও তেমনি। স্বামীর সংসারকে আগলে রেখে ঐ পরিবারের মধ্যে শান্তিসুখ বাড়াতে নারীর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপন করে নেওয়ার ব্যার্থতাই অনেক সমস্যার উদ্রেক ঘটায়। স্বামীর বাসাটিকে ও মানুষগুলোকে আপন করে নেওয়ার জন্য বৌ এর ইচ্ছে ও বৌকেও আপন করে নিতে পরিবারের সকলের আন্তরিকতা প্রয়োজন। অনেক পরিবারেই ছেলের বিয়ের পূর্বে পরিবারের মধ্যে যেরূপ আনন্দ ও সুখ বিদ্যমান থাকে তা শেষ হয়ে যায় ছেলের বিয়ের পর। আবার অনেক পরিবারেই ছেলের বিয়ের পর আনন্দ ও সুখ আরো বেড়ে যায়। অনেকেই মনে করেন, একটি পরিবারকে সুন্দর রাখতে পুরুষের চেয়ে নারীর ভূমিকাই মুখ্য।
এমনকি বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে রাসূল (সা) বলেছেন, ‘একজন স্ত্রী তার স্বামীর পরিজনবর্গের এবং সন্তানদের তত্ত্বাবধানকারিণী।’১৪৭ সেই স্ত্রী স্বামীকে মানসিক দিক দিয়ে প্রফুল্ল রাখতে পারে না যে স্বামীর পরিবারের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিজের অঙ্গ সংস্থান ভেবে তার সুস্থতার জন্য সার্বিক কাজ পরিচালনা করতে আন্তরিক থাকে না। একজন স্বামী তখনই নিজের স্ত্রীকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে যখন ঐ স্ত্রী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় সচেষ্ট থাকে। ধন সম্পদ, শিক্ষা, বংশ, রূপ সৌন্দর্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্ক গড়ায় ভূমিকা রাখলেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিনয়ী আচরণ ও উত্তম ব্যবহারই বেশি গুরুত্ব পায়।
সুখী পরিবার গঠনে কাম্য আচরণ
শ্বশুরবাড়ির লোকদেরও ভুলে গেলে চলবে না, বধূ শ্বশুর বাড়ির সেবিকা বা চাকরানী নয়। তাকেই গামলাভর্তি কাপড় ধুইতে হবে, থালা-বাসন পরিষ্কার থেকে শুরু করে সব কাজ করতে হবে-এমনটি নয়। সেও একটি মানুষ, তারও আছে স্বাদ-আহলাদ, দরকার আছে বিশ্রামের। শ^শুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর ও ভাসুর সবাই ঘরের বৌ থেকে খেদমত নেয়াটা তাদের মৌলিক অধিকার মনে করে। বৌ তার স্বামীর খেদমত করল কি করল না, সেটা বড় বিষয় নয়! পরিবারের অন্যদের খেদমত হল কি না সেটাই বড় বিষয়! অনেক পরিবারে বৌ আসার পর কাজের লোক রাখার প্রয়োজন অনুভব করা হয় না। পুত্রবধূ শ^শুর-শাশুড়িকে আপন পিতা-মাতার মতো তখনি মনে করবে, যখন শ^শুর-শাশুড়িও তাকে আপন মেয়ের মত মনে করবে। নিজের মেয়ে কবিরা গুনাহ করলেও তার দোষ গোপন আর পুত্রবধুর রান্নায় সামান্য দোষ হলে তা অন্যের নিকট বলার আচরণ কখনোই কাম্য নয়। একটি সুখী পরিবার গঠনে বৌ ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য- উভয়দিক থেকেই ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ কাম্য।
ছাড় দেয়ার মানসিকতা
এমন যদি হয় মা-বাবা ভেবে কষ্ট পায় ছেলের বৌ তাদের কাছ থেকে ছেলে ছিনিয়ে নিয়েছে। আর বউ স্বামীর পরিবারকে বোঝা মনে করে। তাহলে একে অপরকে পছন্দ করতে পারার অবস্থা তৈরি হবে না। ধীরে ধীরে একে অপরকে জানতে ও চিনতে পারলে তখন একে অপরের আপন হয়ে ওঠা যায়। যারা আপন হতে পারে না তারা আসলে একে অপরকে চিনে না। স্ত্রীকেও স্বামী, স্বামীর বাড়ি, স্বামীর স্বজনদের নিজের ভাবতে হবে। স্বামীর বাড়িটি তার কাছে প্রথম দিকে হোস্টেলের মতো মনে হতে পারে। ওখান থেকে ছুটে বাবার বাড়ি যেতে পারলেই শান্তি অনুভব হতে পারে। হোস্টেলের মতো থাকলে কোনদিন কারো সেবা করা যায় না। নিজের বাড়ির মতো থাকলে তখন সেবাও করা যায় এবং এটা করলে তখন নিজেকে দাসীও মনে হয় না। শাশুড়িও আগে বৌ এর আপন হয়ে পরে সেবা নিতে চাইতে পারে। শাশুড়ি যদি আপন হতে পারে তবে বৌ অবশ্যই সেবা করবে। আপন না হয়েই সেবার আবদার করাটা বোকামি। ছাড় দেয়ার মানসিকতা খুব প্রয়োজন।
অহেতুক সন্দেহ না করা
সংসার জীবনে নারী নির্ভরশীল স্বামী ও পুত্রের উপর। পুত্রের মাধ্যমে সংসারের বৈষয়িক দিকটি রক্ষিত হয় বলেই মায়েরা পুত্রের উপর নির্ভর করে। মেয়ের বিয়ে দিলে শাশুড়ি মেয়ে জামাইকে স্বাভাবিকভাবেই আদর করে থাকে। কারণ মেয়ের সুখ-দুঃখ নির্ভর করে যার সংগে তার বিয়ে হয়েছে তার উপর। সমাজব্যবস্থার কারণে বিয়ের দু’তিন বছরের মধ্যে পুত্রবধূর সন্তান না হলে শাশুড়ি পুত্রবধূর বন্ধ্যাত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ছেলে যে সন্তান জন্মদানে অক্ষম হতে পারে এ চিন্তাই করে না। তখন পুত্রের দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ দরকার এমন শাশুড়ি যারা বৌয়ের প্রতি অতি নম্র ও ভদ্র হবে। মা রূপে বৌমাকে বুকে তুলে কাছে টেনে নেবে। বৌমাও অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা ও অপরিপক্বতার কারণে অসঙ্গত কিছু বলে বা করে বসবে না। কেননা মায়ের মনে কষ্ট দিলে প্রসববেদনা থেকে শুরু করে ছেলেকে প্রতিপালনের সব কষ্ট একসাথে তার মনে পড়ে যাবে।
আরেকজনের হক আদায়
পুত্র ও পুত্রবধূকে এমন আচার ব্যবহার করতে হবে যাতে মা বুঝে তার ছেলে তারই আছে ও থাকবে এবং বৌমাও তার যত্ন নেবে-সম্মান করবে। স্বামী স্ত্রীকে বোঝতে হবে, এই সংসার সমুদ্রে একাকী নয়, একসাথে পথচলতে হবে। নতুন জীবনে চলার পথে দুজনেরই অনেক কষ্ট হলেও পাশে থেকে কষ্টের সান্ত্বনা হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একে অন্যের কষ্ট দূর করতে না পারলেও অনুভব করতে পারা এবং কিছুটা লাঘব করায় সচেষ্ট থাকতে হবে। একজন পিছিয়ে পড়লে আরেকজনকে টেনে নিতে হবে। দুজনকেই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে একজনের দ্বারা আরেকজনের হক নষ্ট না হয় এবং কারো প্রতি যুলুম না হয়।
এমনকি গৃহকর্মীকে কোনো প্রকারের শারীরিক নির্যাতন মোটেই যৌক্তিক নয়। যারা বাসা বাড়িতে কাজ করে তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া, নিজেরা যা খায় তা খাওয়ানো, বদ্ধ ঘরে মশারিবিহীন না রাখা, রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা করানো; এসব মানবিক ও নৈতিক দায়িত্বই শুধু নয়, সময় ও শ্রম দেয়ার বিনিময়ে তার ন্যায্য পাওনা ও অধিকার। সহিহ মুসলিমে আছে নবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো দাস-দাসী তোমাদের জন্য খাবার তৈরি করে এনে দেয় তখন নিজের সঙ্গে বসিয়ে তাকে খাওয়াবে। কেননা সে ধোঁয়া ও তাপ সহ্য করেছে। আর কোনো খাবার যদি পরিমাণে কম হয় তবে অন্তত দু-এক মুঠো তার হাতে দেবে।’১৪৮ অর্থাৎ গৃহকর্মীরা পরিবারের সদস্যতুল্য গণ্য হবে, তাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে। সুবিচার করতে না পারলে গৃহকর্মী রাখাই উচিত নয়।
পক্ষপাতিত্ব নয়
মাতৃভক্তিতে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা কিংবা স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মা-বাবার দিলে আঘাত দেয়া কোনটাই কাম্য নয়। মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা মূলত মায়ের প্রতি যুলুম, তদ্রƒপ স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে মায়ের হক নষ্ট করা আসলে স্ত্রীর প্রতি যুলুম। ধমক দিয়ে ও জোর খাটিয়ে সংশোধন করা যায় না, ঘরে অশান্তি আনা যায়, ঘর ভাঙ্গা যায়, আর সন্তানদের জীবনে বিপর্যয় আনা যায়। তাই পারস্পরিক আচরণ এমন হবে যেন দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন আরেকজনকে উত্তম স্বামী বা স্ত্রী মনে করে। আসলে দীর্ঘ সাধনা করেই হৃদয় জয় করতে হয়, মনের দুয়ার খোলতে হয়, অন্তরের গভীরে প্রবেশ করতে হয়।
প্রচেষ্টা ও সচেতনতা
দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্য শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা ও সচেতনতা অতি প্রয়োজন। এ বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। শ্বশুর বাড়ির কোনো দোষ ত্রুটি মা-বাপের কাছে না বলা বা শ্বশুরালয়ের কারও সম্পর্কে কোনো গিবত বাপের বাড়িতে করা উচিত না। এ থেকেই ক্রমান্বয়ে উভয় পক্ষের মন খারাপ হয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এবং ছেলে মেয়ে যেই হোক যত দিন শ্বশুর-শাশুড়ি জীবিত থাকবে তাদের সাথে কথা-বার্তা ও ওঠা-বসায় আদব-সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়।