আহসান হাবীব
একটি জাতির উত্থানের নির্ণায়ক যদি হয় অর্থনৈতিক ও বস্তুগত উন্নতি, তাহলে এর পতনের নির্ধারক নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। যে কোনো জাতির উত্থান কিংবা পতনের জন্য নৈতিক ও বস্তুগত বিষয়গুলো সমভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। পৃথিবীর কোনো জাতি বা সভ্যতাকে ততদিন অন্য কোনো জাতি পরাজিত করতে পারেনি, যতদিন ওই জাতি কিংবা সভ্যতার মানুষরা নিজেরা নিজেদের পরাজিত না করেছে। টয়েনবির ভাষায়- ‘হত্যার কারণে নয়, আত্মহত্যার কারণেই সভ্যতার মৃত্যু ঘটে।’
মানুষের স্বভাব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, নৈতিকতা তার কৃতকর্মে প্রতিফলিত হয়। মানুষের কৃতকর্মের কারণেই সমাজে দুর্নীতির প্রসার ঘটে, বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, পররাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বাড়ে, অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস-সন্দেহ-সংকট ঘনীভূত হয়। হত্যা, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, লুটপাট, চাঁদাবাজি, পাচার, শোষণ, নির্যাতন, জেল, জুলুম, ভেজাল, প্রতারণা সবকিছু মানুষেরই কৃতকর্ম। মানুষ নিজেই তার ভাগ্যের নির্মাতা। মানুষ উন্নয়নের লক্ষ্যই শুধু নয়, উন্নয়নের উপায়ও বটে। ব্যক্তির পরিশ্রমের ওপর ভিত্তি করে সমাজ উন্নত হয়। এই উন্নতির দ্বারা ব্যক্তি নিজে উপকৃত হয়। আবার এ উন্নয়নের স্থিতি, প্রগতি ও শৃঙ্খলাও নির্ভর করে ওই সমাজের মানুষের আচরণের ওপর।
এ মুহূর্তে আমাদের দেশের একটি বড় অংশের মানুষের চিন্তা, আচরণ, কর্মসহ জীবন-জীবিকার সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের লক্ষণ প্রকট। মানুষের শরীরের দগদগে ঘা’র মতো সমাজের শরীরের এই পচন দেশপ্রেমী মানুষের কাছে অসহ্য। কিন্তু যাদের কাছে অসহ্য হলে এর থেকে মুক্তির উপায় বা কার্যকর পন্থা বের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেই ক্ষমতাবান, রাজনীতিক, শক্তিমান দল বা ব্যক্তি দেখেও না দেখার ভান করে থাকলে এ অবক্ষয় বাড়বে বৈ কমবে না।
সমাজবিজ্ঞানে ‘সাংস্কৃতিক ব্যবধান’ (theory of cultural lag) নামে একটি তত্ত্ব গুরুত্বসহকারে পড়ানো হয়। যার মূল কথা হচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির ফলে বস্তুগত সংস্কৃতি দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে, যার সঙ্গে অবস্তুগত সংস্কৃতি খাপ খাইয়ে বা তাল মিলিয়ে ওই একই গতিতে এগিয়ে চলতে পারছে না। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা বা পিছিয়ে পড়া। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ডব্লিউ এফ অগবার্ন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Social Change’-এ সংস্কৃতির পশ্চাৎপদতার ব্যবধান তত্ত্ব প্রদান করেছেন। তিনি মনে করেন, সংস্কৃতির দুটি সহযোগী দিক রয়েছে : বস্তুগত ও অবস্তুগত। বস্তুগত সংস্কৃতির উন্নয়ন বলতে তিনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, অবকাঠামো, স্কুল, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদির পরিবর্তন ও উন্নয়নকে বুঝিয়েছেন। অন্যদিকে অবস্তুগত সংস্কৃতি বলতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, মূল্যবোধ, ধর্ম, বিশ্বাস, শিক্ষাব্যবস্থা, নৈতিকতা ইত্যাদিকে বুঝিয়েছেন।
এই তত্ত্বে মনে করা হয়, সংস্কৃতির সহযোগী দুটি অংশের মধ্যে একটি কোনো এক সময় অন্যটি থেকে দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে পড়ার ফলে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া অংশটিকে অগ্রসর অংশটির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। অন্যথায় সমাজে বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। নানাবিধ আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফলে সমাজের অবস্তুগত দিক যেমন- ধর্ম, শিক্ষা, মূল্যবোধ ইত্যাদির চেয়ে বস্তুগত দিক যেমন- বাসস্থান, হাতিয়ার, রাস্তাঘাট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, তৈজসপত্র ইত্যাদি দ্রুততর গতিতে পরিবর্তিত হয়। ফলে বস্তুগত অংশের সঙ্গে অবস্তুগত অংশের ব্যবধান সৃষ্টি হয়। পিছিয়ে পড়া অবস্তুগত সংস্কৃতিতে তখন শূন্যতা বা অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতা মোকাবেলায় সমাজ ও রাষ্ট্র যত পিছিয়ে পড়বে সমাজে তত বেশি সমস্যার উদ্ভব ঘটবে, বস্তুগত ও অর্থনৈতিক উন্নতি পড়বে হুমকির মুখে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসোক) উন্নয়ন নীতিমালা বিষয়ক কমিটি বা কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) তিনটি সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিনটি সূচকের দুটি অর্জন করতে পারলেই যেখানে উন্নয়নশীল তকমা পাওয়া যায়, বাংলাদেশ সেখানে তিনটি ক্ষেত্রেই পাস করেছে। এমনকি ভুটান, গিনিসহ কয়েকটি দেশ মাত্র একটি সূচক অর্জন করেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃত। নানাবিধ নেতিবাচক শিরোনামের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য এই অর্জন নিঃসন্দেহে অনেক তাৎপর্য বহন করবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূতি উজ্জ্বল হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এই স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে কিছু বৈপরীত্যও লক্ষণীয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে কিছু তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি বিবিএস ও বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আরও ভয়ঙ্কর তথ্য তুলে এনেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অতি দরিদ্রের একেবারে নিচের সারিতে অবস্থান করে এমন ৫ শতাংশের খানাপ্রতি মাসিক আয় (হাউজহোল্ড ইনকাম) ২০০৫ সালে ছিল ১ হাজার ১০৯ টাকা, যা কমে ২০১৬ সালে ৭৩৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যদিও ২০১০-এ নিুআয়ের মানুষের আয় বেড়ে ১ হাজার ৭৯১ টাকা হয়েছিল। অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০১৬ এই সময়ে তাদের আয় কমেছে। ২০০৫ সালে গ্রামের নিু আয়ের মানুষের আয় ছিল ১ হাজার ৭৩ টাকা। শহরের নিু আয়ের মানুষের আয় ছিল তখন ১ হাজার ৪০২ টাকা। গত ১১ বছরে এই শ্রেণীর জাতীয় আয় কমেছে ৫৯.১ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে ৬০.৭ শতাংশ এবং শহরে ৫১.৩ শতাংশ কমেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম, তবে শ্রমশক্তির বাইরে। এর মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নারী-পুরুষ আছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তির বাইরে (বেকার) ছিল ৪ কোটি ৬৬ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজারে। তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ ধরনের কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে (সূত্র : যুগান্তর, ২৮ মার্চ, ২০১৮)।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। নৃবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে আমার আগ্রহের জায়গাটা একটু আলাদা। আমি দেখতে চাই, এত এত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমাজকে কী দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ এ উন্নয়নকে কীভাবে নিচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ত্রৈমাসিক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সারা দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ১৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ধর্ষণের পর ১৯ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। দু’জন ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে আরও ২১ নারীর ওপর। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক হেফাজতে ও ক্রসফায়ারে আরও ৪৬ জন মারা গেছেন। পাশাপাশি কারা-হেফাজতে তিন মাসে মারা গেছেন ২৫ জন। এদের মধ্যে ১১ জন কয়েদি ও ১৪ জন হাজতি। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০৭ জন নারী। এদের মধ্যে ৭৫ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন নারী। তিন মাসে ৪২২ জন শিশু বিভিন্ন নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৭১ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ২৬ শিশু আত্মহত্যা করেছে। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১৬ জন। রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৮৮ জন।
এ ধরনের অনেক তথ্য আছে যা ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হওয়ার খবরে আন্দোলিত হওয়ার চেয়ে সাধারণ মানুষকে অধিক বিচলিত করে। এটা বড় ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের উদাহরণ। আমরা উন্নয়নের গাণিতিক শর্তগুলো পূরণ করতে পারলেও এর মানবিক শর্তগুলো পূরণ করতে পারছি না। অথচ ‘উন্নয়নশীল’ দেশের এই স্বীকৃতি টিকিয়ে রেখে ‘উন্নত’ দেশে রূপান্তরিত হতে হলে ‘উন্নয়নের’ এ মিছিলে ধর্ম-বর্ণ-দল-মত-লিঙ্গ-মর্যাদা নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উন্নয়নের ফলাফলও সবার মাঝে সমভাবে বণ্টন করে দিতে হবে। আর এটা তখনই সম্ভব হবে যখন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রিয়াশীল ও কার্যকর হবে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন সমাজের সর্বত্র তথা পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও ধর্মের বিভিন্ন অনুশীলনে ন্যায়বিচার, সমতা ও সততা নিশ্চিত করতে পারবে তখন সমাজে সংহতি প্রতিষ্ঠিত হবে ও উন্নয়ন টেকসই হবে। ‘উন্নয়নের’ অর্থনীতিতে যে অর্থ ও সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে বা বৃদ্ধি পেয়েছে তা পাচার, বিলাসিতা, দমন-নিপীড়ন, সংঘাতের পেছনে ব্যয় না করে অপচয় কমিয়ে এনে যদি মানুষের নৈতিক, দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা বৃদ্ধির কাজে অর্থাৎ ‘অবস্তুগত’ ও ‘মতাদর্শগত’ উন্নয়নের পেছনে ব্যয় করা যায়, তাহলে বিদ্যমান উন্নয়ন রক্ষা পাবে, বেশি বেশি উন্নয়ন ঘটবে, মানুষের কল্যাণ সাধিত হবে ও সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।
লেখক : নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষক, গ্রীন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ