ড. ওমর ফারুক সুজন : বর্তমান বিশ্বে আবারো আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আবারো বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে যা থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আজকে দিশেহারা। ইতোমধ্যে USA সহ বিভিন্ন দেশ বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যা পুঁজিবাদের মূল দর্শনে আঘাত হানছে। যা দেখে পুনরায় সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিশ্বাসী ব্যক্তি বা দল উৎসাহিত হচ্ছে, সমাজতন্ত্রের পূনঃবিকাশের পথ সুপ্রশস্ত হচ্ছে বলে ধারণা করছে। তাই বর্তমান সময়ের প্রতিটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে।
প্রথমেই এই বিশ্ব আর্থিক সংকটের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ৯০ এর শেষের দিকে USA এর অর্থনীতিতে যখন প্রত্যেকটি লোকের চাকুরি আছে, যথেষ্ট পরিমাণে আয় হচ্ছে এবং তা স্থায়ী ও স্থির। অর্থাৎ growing Economy তখন এই সমস্ত উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষের বাড়ী কেনার প্রতি ঝোঁক বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে সুদের হার ছিল কম। ফলে মানুষ ঋণ করে বাড়ী কিনতে শুরু করে। ব্যাংকসমূহও সহজ শর্তে তাদের বাড়ী তৈরি ও বাড়ী ক্রয়খাতে ঋণ দিতে থাকে।
Freddi Mac Foney Mac যা ফেডারেল ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এর থেকে সহায়তা নিয়ে ব্যাংকগুলো প্রচুর পরিমাণে হাউজিং লোন আস্থার সাথে দিতে থাকে। কেননা সরকার তাদের পেছনে আছে বলে মনে করে। ফলে এই সময়ে বাড়ীর দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। চাহিদাও সমানতালে বেড়েই চলে। কারণ growing economy তে ব্যক্তি বাড়ি বসবাসের জন্য ব্যবহার না করে বরং বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করে। সে যাই হোক, বাড়ীর দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে।
তাই মানুষ জন রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় বাড়ী ক্রয়ে অর্থ বিনিয়োগ করছে। প্রয়োজনে Mortgage এর মাধ্যমে অর্থ ঋণ নিয়ে বাড়ি কিনছে। কারণ বাড়ির দাম যেভাবে বাড়ছে, Mortgage নিয়ে বাড়ি কিনে দুই তিন বছর পর তা বিক্রি করলে অল্প দিনেই ধনীক শ্রেণীতে পরিণত হওয়ার মোহে তারা আচ্ছন্ন হয়। ফলে বাড়ির দাম ও চাহিদা উভয়ই দ্রুত বাড়ছে।
এই সময়ে USA নাগরিকদের ভোগের পরিমাণ ১০০% শতাংশে পৌঁছায়। তারা কোন সঞ্চয় করে না বরং বাড়ি কেনার মধ্যেই যেন তাদের সঞ্চয় নিহিত। এমনকি অনেকের সঞ্চয় নেতিবাচক (Negative) হয়ে যায়। এই সময়ে ব্যাংকগুলোর Credit card এর ব্যাপক চাহিদা-যোগান বেড়ে যায়। কেননা এই স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে Credit card এর সুবিধা দেয় যা মানুষকে অধিক ভোগ করতে উৎসাহিত করে।
যেমন- ধরি, একজন ব্যক্তির মাসিক আয় $৩০০০। এখন এই ব্যক্তি অন্তত তিনটি ব্যাংক হতে ক্রেডিট কার্ড নিতে সক্ষম। এখন ঐ ব্যক্তি যদি তিনটি ব্যাংক হতে $৩০০০ করে ক্রেডিট কার্ড সংগ্রহ করে তবে তার ঐ মাসে মোট ঋণ হবে (৩৩০০০) = $৯০০০ অর্থাৎ সে আয় করছে $৩০০০ আর ক্রেডিট কার্ডের সুবাদে ব্যয় করতে পারছে $৯০০০। অর্থাৎ প্রতি মাসে সে $৬০০০ অতিরিক্ত খরচ করছে। যা দিয়ে সে বিভিন্ন বিলাস দ্রব্য ভোগ করছে।
Travel card এর মাধ্যমে বিদেশে অবকাশ যাপন করছে। আর বাড়িতে যে বিনিয়োগ করেছে তা হতে দুই-তিন বছর পর বিশাল মুনাফা আসবে বলে নিশ্চিন্তে সময় কাটাচ্ছে। তারা বিভিন্ন ধরণের Manufacturing Good ব্যবহার করছে যা মূলত USA উৎপাদন করে না। চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশ হতে আমদানী করে। ফলে USA নাগরিকদের এই বিশাল ভোগ তাদের অর্থনীতির উন্নয়ন না করে বরং চীন, ভারতের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাদের রপ্তানী বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে USA এর জনগণ ব্যয় করেই চলেছে আর অধিক দামে বাড়ি বিক্রির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে যেহেতু Housing loan, construction loan এর ব্যাপক চাহিদা। তাই তারা Loan দেওয়ার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু কের। যেহেতু দেশের জনগণের সঞ্চয় নাই কিন্তু ঋণের চাহিদা প্রচুর। তাই তারা Freddimacac, Foney Mac সহ বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ এনে সহজশত্যে ঋণ দেওয়া শুরু করে। অর্থাৎ পুরো ঋণ নির্ভর অর্থনীতির সূচনা হয়।
এই সময়ে ইউরোপের বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো Housing Loan এর বিশাল চাহিদা দেখে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় এবং স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে প্রচুর আর্থিক সহায়তা দেয়। ফলে স্থানীয় ব্যাংক এর নিকট প্রচুর অর্থ আসতে শুরু করে। যা তাদের সহজশর্তে ঋণ দেওয়ার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। ইতোমধ্যে উচ্চ আয়ের নাগরিকদের বাড়ির খাতে বিনিয়োগ করা শেষ হয়ে যায়।
তাই ব্যাংকসমূহ এবার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ঋণ নেওয়ার জন্য বিশেষ প্রণোদনামুলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যাদেরকে সাধারণত ব্যাংকগুলো ঋণ দেয় না। কেননা তখনও তাদের কাছে দেশীয় ও বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে প্রচুর অর্থ আসছে। তাই তারা এই সকল Risky people এর জন্য তুলনামূলক স্বল্প সুদে এবং কম হারে ঋণ পরিশোধের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
অবহেলিত এই দরিদ্র ও Risky people এই সুযোগ হেলায় হারাতে চায় নি। তারা ধারণা করেছে যদি যেকোনোভাবে একটা বাড়ির মালিক হতে পারে তবে দুই-তিন বছর পরে ঐ বাড়ি কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করে অবহেলিত জীবনের অবসান করা যাবে। তাই তারা প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছে এবং যথাসর্বস্ব দিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার চেষ্টা করেছে।
অপরদিকে শর্তানুসারে যারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের ঐ বাড়ি ব্যাংকের হয়ে যাবে। এই ব্যাপারটি ব্যাংকের নিকট মুনাফার উপর মুনাফা হিসেবে দেখা হয়েছে। কেননা এতে ব্যাংকের ক্ষতি নেই বরং লাভ। কারণ দুই-তিন বছর পর ঐ বাড়ির দাম কয়েকগুণ হবে যা ব্যাংক গ্রহণ করবে। তাই তারা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাছ-বিচার করার প্রয়োজনবোধ করে নাই। ব্যাংকের এই সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কারণে একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ Housing market এ আসে এবং আরেক ধাপ বাড়ির দাম বাড়ে।
এখানে উল্লেখ্য যে, যেহেতু ব্যাংকগুলোর বীমা করা ছিল যে, যদি ব্যর্থ হয় তবে বীমা কোম্পানী তাকে ক্ষতিপুরণ দেবে তাই তারা ঋণ দিতে ঝুঁকি নিতে অগ্রগামী হয়। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বাড়ির দাম বৃদ্ধি, বাড়ি নির্মান প্রতিষ্ঠানকে অধিক পরিমাণে বাড়ী নির্মানে উৎসাহিত করে। তারা আবার ব্যাংক হতে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়ে অধিক সংখ্যক বাড়ি নির্মান করেন। এবং ২-৩ বছর পরে আরও অধিক দামে বাড়ি বিক্রির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
এভাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে এবং এই পর্যায়ে যে সমস্ত উচ্চ আয়ের ব্যক্তি বাড়ি কিনেছিল অধিক দামে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু কোনো ক্রেতা খুঁজে পায় না। এরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ভোগ করে আর বিদেশ ঘুরে ইতোমধ্যে অনেক ঋণী হয়ে যায়। তাই তারা বাড়ি বিক্রির জন্য উন্মূখ হয়ে থাকে কিন্তু বাড়ি কেউ কিনতে চায় না।
অপরদিকে যে সমস্ত নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক কষ্টে সর্বস্ব দিয়ে বাড়ী ক্রয় করেছিল অধিক দামে বিক্রি করে ধনীর কাতারে শামিল হওয়ার আশায় তারাও বাড়ি বিক্রি করতে চায়। কিন্তু ক্রেতা খুঁজে পায় না।
আরেক গ্রুপ যারা ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় তাদের বাড়ি ব্যাংক নিয়ে নিয়েছে অর্থাৎ ব্যাংকের মালিকানাধীন বাড়িগুলো বিক্রির জন্য ব্যাংক প্রস্তুত কিন্তু ক্রয় করার কেউ নেই।
নির্মান প্রতিষ্ঠানগুলোও আরও অধিক দামে বিক্রির জন্য হাজার হাজার বাড়ি তৈরি করে বিক্রির জন্য বসে আছে কিন্তু কেনার কেউ নেই। অর্থাৎ পুরো অর্থনীতিতে বাড়ি বিক্রির জন্য প্রত্যেকটা গ্রুপ অপেক্ষমান কিন্তু কেনার মানুষ নেই। তাই বাড়ির দাম হঠাৎ করে একেবারে কমে যায়।
এমতাবস্থায় যে ইউরোপীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান লাভবান হওয়ার জন্য Housing sector এর ভালো অবস্থা দেখে ঋণ দিয়েছিল স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে সেই বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান Housing market এর দরপতন দেখে অর্থ ফেরত চায়। কিন্তু স্থানীয় ব্যাংক তার অর্থ ঋণ দিয়ে রেখেছে যে সমস্ত মানুষের কাছে তারা বাড়ি বিক্রি কারতে না পেরে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। নির্মান প্রতিষ্ঠানও ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এমনকি ব্যাংকের নিকট যে বাড়ি ছিল তাও বিক্রি হচ্ছে না। তাই স্থানীয় ব্যাংকগুলো, বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।
শুধু তাই নয়, যদি কোনো ব্যাংক ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা হতে উত্তরণের জন্য বীমা করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় যেহেতু সকল ব্যাংক একই সাথে ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং একই সাথে বীমা কোম্পানীর কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে তখন বীমা কোম্পানীর পক্ষে সবাইকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই বীমা কোম্পানী যেমন- AIGও Collaps করে। অর্থাৎ পুরো আর্ন্তজাতিক অর্থ-ব্যবস্থাটিই অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় ব্যাংকগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিতে পারছে না। বিশ্বে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বেকারত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। এখানে সরাসরি প্রভাব পড়ছে ব্যাংকে নিয়োজিত শ্রমিকদের উপরে। দ্বিতীয়ত প্রভাব পড়ছে বিশ্বব্যাপী ভোগের উপর। কারণ আয় কমে যাওয়ায় ভোগ কমে যাচ্ছে ফলে ফার্ম Loss করছে এবং উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে আরেকদফা। যা পুনরায় ভোগ কমিয়ে দেবে।
এই কারণে চীন, ভারতসহ এশিয়ার Export oriented manufacturing goods এর চাহিদা কমে যায় এবং ঐ সকল দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। চীনেই এক বছরে ৬০ হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। USA এর General, Ford, Crystor, Motors প্রভৃতি কোম্পানী ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের আয়ের প্রধান উৎস হল তেল। কিন্তু বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বে একের পর এক কল-কারখান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানে প্রচুর পরিমাণে শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ায় জ্বালানী তেলের চাহিদা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে। ফলে তাদের আয় কমে গেছে। এমতাবস্থায় ঐ সমস্ত দেশে যে সকল উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তা বন্ধ হয়ে গেছে এবং ঐ সমস্ত প্রকল্পে এশিয়ার যে সমস্ত শ্রমিক নিয়েঅজিত ছিল তারা ছাঁটাই হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব ব্যাপক। বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য অংশ বৈদেশিক বাজার ও বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক শিল্প, চিংড়ি, হিমায়িত খাদ্য প্রভৃতি রপ্তানীর উপর বাংলাদেশের আয়ের খাত নির্ভরশীল। কিন্তু USA সহ পশ্চিমা বিশ্বের আর্থিক সংকটের কারণে ছাঁটাই হওয়া মানুষেরা আর আগের মতো ভোগ করছে না। এমনকি যাদের চাকরি আছে তারাও আগের মতো কেনা-কাটা, ভোগ-বিলাস করে না।
কেননা অর্থনীতি অস্থিতিশীল এবং যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তির চাকরি চলে যেতে পারে। তাই বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা বিদেশি বাজারে নেই বললেই চলে। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ হতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে রেমিটেন্স পাঠাতো, তাও কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ হতে বাংলাদেশি শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটের একটা বড় অংশের অর্থায়ন করা হয় বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর ঋণ ও সহায়তা হতে। কিন্তু এই বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের কারণে দাতাদেশগুলো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। তাই বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেট এ বিশাল ঘাটতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
USA এর এই Financial crisis আরেকবার বিশ্ব অর্থনীতিকে দারুনভাবে আক্রান্ত করেছে। এমতাবস্থায় USA সহ সব মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারক ও বাহক দেশগুলো একের পর এক যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পতন ঠেকাতে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ, Bail out package পুঁজিবাদের মূলভিত্তির উপর সজোরে আঘাত হানছে। কারণ মুক্ত বাজার অর্থনীতির মূল কথাই হলো এখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। বাজার নিজেই নিজের কলা-কৌশলের মাধ্যমে পুনরায় ভারসাম্য অবস্থায় পৌঁছাতে সক্ষম।
কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণহীন USA এর মুক্ত বাণিজ্য বিশ্ব অর্থনীতির চলমান গতিধারাকে আরেকবার থামিয়ে দিতে পেরেছে যা থেকে উত্তরণের জন্য কেবল বাজারের কলা-কৌশলের উপর নির্ভর করা যাচ্ছে না। কারণ, ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিষয়টি বাজারের উপর ভরসা করে বসে থাকায় আমরা দেখেছি USA এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (A.I.G., General, Carsar, Ford Motors etc.) প্রভৃতি হুমকির সম্মুখীন হওয়াসহ হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, তাদের জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী হচ্ছে ।
সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়েছে। এমতাবস্থায় বাজারের উপর আর নির্ভর না করে সরকার এই সকল পতনন্মুখ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে। বারাক ওবামা সরকার ৭০০ বিলিয়ন ডলারের Risk Package ঘোষণা করেছিল। A.I.G., General, Carsar, Ford Motors প্রভৃতিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেছে যা অর্থনীতির জনক মুক্ত বাজারের প্রবক্তা এডাম স্মিথ ও অন্যান্যদের মতের সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ তারা যে মত দিয়েছিলেন যে বাজার নিজেই তার সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম তা আজ আবারো মিথ্যায় পর্যবসিত হলো।
সারা বিশ্বে পুজিবাদের যখন এই অবস্থা তখন পুজিবাদের বিপরীত মেরুতে অবস্থিত সমাজতান্ত্রিক ব্লকের মধ্যে বেশ আনন্দ উচ্ছাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের সেই আনন্দ উৎসাহের পেছনে একটি কারণ হতে পারে যে মার্কস পুজিবাদ সম্পর্কে যে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল তা একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর সত্যে পরিণত হতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ মার্কসের অন্যতম কাজ পুজিবাদ এর বিশ্লেষণে তিনি বলেছেন, পুজিবাদ কোন চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয়, যুগের পরিবর্তনের সাথে সভ্যতার পরিবর্তন হবে এবং সেইসাথে পুজিবাদেরও পতন হবে এবং সেখানে অন্যকোন ব্যবস্থা আসবে। তিনি বলেন, পুজিবাদের বিকাশের মধ্যেই এর পতন নিহিত।
একটা উদাহরণের মধ্যেমে বিষয়টা স্পষ্ট হতে পারে। তাঁর মতে, পুজিবাদের বিকাশের পথে Surplus Value এর অন্বেষণে এমন এক ধরণের বাল্ব আাবিষ্কৃত হবে যা আর কখনো নষ্ট হবে না। ফলে বাল্বের চাহিদা চিরতরে দূর হবে এবং এভাবেই চাহিদার অভাবে বাজার তথা পুজিবাদ ম্রিয়মান হবে এবং সেখানে নতুন কোনো ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি অবশ্য একটা প্রক্রিয়ার কথাও বলেছেন।
পুজিবাদের বিকাশে Intra-class (একই শ্রেণীর মধ্যে যে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার বৈষম্য যেমন- একটা ফার্মের ম্যানেজারের বেতন এক লক্ষ টাকা আর শ্রমিকের বেতন ১৬৫০ টাকা মাত্র)। Intra-class (মালিক শ্রমিকদের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য) এর কারণে এবং শ্রমিকদের যন্ত্র, প্রযুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা প্রভৃতি কারণে একটা বিশাল শ্রমিক শ্রেণী যারা নিপীড়িত, নিগৃহীত ও বঞ্চনার শিকার (Industrial Reserve Army) তৈরি হয়। তারা তাদের অধিকার সচেতন হয়ে উঠবে তখনই তারা প্রচলিত সমাজের বিরূদ্ধে সোচ্চার হবে এবং তারা একটি সফল বিপ্লবের মাধ্যমে পুজিবাদের এই তখতকে গুড়িয়ে দিয়ে একটা নতুন সাম্যবাদী সমাজ গঠন করবে।
এই যখন অবস্থা তখন কিছু কিছু মার্কসের আদর্শে অনুপ্রাণিত দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি মত প্রকাশ করছেন যে, পুজিবাদের পতনের সময় এসে গেছে এবং সেই স্থলে সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথও উম্মুক্ত হয়েছে। কারণ তারা যুক্তি দেখান যে যেহেতু পুজিবাদ বার বার হোঁচট খাচ্ছে াযা মার্কস ভবিষ্যত বাণী করে গেছেন তাই মার্কসের সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ বাণীও সত্য হবে। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি ও বাস্তব সমাজ ব্যবস্থা তার সাক্ষ্য দেয় না।
একথা সত্য যে পুজিবাদের বিকাশ পর্যায়ে যুদ্ধ, দেশ দখল, উপনিবেশবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ, আকাশ সংস্কৃতি, প্রযুক্তি প্রভৃতির মাধ্যমে কিছু দেশ বাকী দেশগুলোর উপর বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের শৃঙ্খল পড়িয়েছে, শোষণ করছে অনবরত, অহর্নিশ। ফলে শাসক শ্রেণীর বিরূদ্ধে বহুজাতিক কোম্পানীর বিরূদ্ধে ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নিপীড়িত মানুষ জেগে উঠছে। কিন্তু তারা কোন নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল পাচ্ছে না। পাচ্ছে না এমন কোন মানুষকে যার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা একই সুরে কথা বলবে। যে বা যারা নিপীড়িত মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক. ধর্মীয় মূল্যবোকে যথাযথভাবে মুল্যায়ন করে সকল ধর্ম-বর্ণ, জাতির জন্য একটা নির্ভরযোগ্য ও যৌক্তিক প্লাটফর্ম গড়ে তুলবে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে এই নির্ভরযোগ্য ও যৌক্তিক প্লাটফর্মটা কি হতে পারে? সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মনে করেন যে এই প্লাটফর্মটা হবে সমাজতান্ত্রিক প্লাটফর্ম। কিন্তু এই পৃথিবীর মানুষ সমাজতন্ত্রের স্বাদ খুব ভালভাবেই ভোগ করেছে। ইতিহাস যতটুকু সাক্ষ্য দেয় তাতে এই নিপীড়িত মানুষ আর সমাজতন্ত্রের ছায়ায় আস্থা পায় না। যে শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিল, মাত্র ৭০ বছরের ব্যবধানে তা নতুন শ্রেণী-বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার আবেগী স্বপ্ন বাস্তবতার মুখ দেখেনি।
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে সক্ষম হয। তারা ১৯৩০ সালের মহামন্দায়ও নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৫০ দশকের পর হতেই এর ক্ষয় শুরু হয় এবং ১৯৯১ সালে শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। শুরুর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান এবং পরে পতনের অন্যতম কারণ যদি বলতে চাই তবে বলা যায়- প্রথমত, ব্যক্তিমালিকানাকে অস্বীকার করা।
সম্পদের মালিকানা অর্জন করা মানুষের প্রকৃতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য। মানুষ নিজের জিনিসের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে যে পরিমাণ গুরুত্ব আরোপ করে নিজস্ব মালিকানা না থাকলে ততটুকু গুরুত্ব দেয় না। কাজে ফাঁকি দেওয়ার একটা মনোভাব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ব্যক্তির মধ্যকার এই মনস্তাত্বিক অবস্থাকে কখনও অস্বীকার করা যায় না। তাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদন কম হয়, ব্যক্তি মালিকানধীন উৎপাদন ব্যবস্থার তুলনায়। মানুষকে যদি incentive বা প্রণোদনা না দেওয়া হয় তবে জোড় করে তার হতে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া সম্ভব নয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রুশ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সংকট এবং পুজিবাদের নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়ে শোষিত নিপীড়িত মানুষ মার্কসের শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ দ্বারা দারুণভাবে আশান্বিত হচ্ছিল এবং লেলিন এর নেতৃত্বে বলশেভিক ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতা দখল করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার পর সেই সকল বিপ্লবীর শোষণহীন, সাম্যবাদী সমাজ গড়ার লক্ষ্যে নিবেদিতভাবে কাজ করেছে। নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার দিকে না তাকিয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আগামী প্রজন্মের জন্য সাম্যবাদী সমাজ কায়েমের জন্য যৌথ কৃষি খামার, বিশাল বিশাল ভারী াশিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছে সেখানে, নিবেদিতভাবে কাজ করেছে। ফলে সেই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষি, শিল্প, প্রযুক্তিসহ সকল ক্ষেত্রেই উন্নতি হযেছে। কিন্তু সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে যখন দেশ একটু Stable হতে শুরু করেছে ঠিক তখন নীতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। পার্টি সভ্যদের মধ্যেও স্বেচ্ছাচারিতা, ভোগ-বিলাসীতার একটা প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর পরবর্তী সময়ে শীতল যুদ্ধের পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পদক্ষেপ নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যে আগ্রাসী ভূমিকা তা কোন অংশে সাম্রাজ্যবাদীা শক্তির চেয়ে কম ছিল না। উল্লেখ্য ১৯৫৬ ও ৫৮তে হাঙ্গেরী ও পোল্যান্ড এবং ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ায় সংশোধনকারীদের দমনের নামে যে সামরিক আগ্রাসন চালানো হয় তা মূলত গণবিচ্ছিন্ন আগ্রাসন হিসেবে পরিগণিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির স্থায়ী উপগ্রহ হিসাবে এসব দেশে আমলাতান্ত্রিক একটি ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্রের নামে কায়েম করা হয়েছিল। এসব দেশে এমনভাবে অর্থব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যবহার করে যে, প্রয়োজন অনুযায়ী শিল্পায়ন করার সুযোগ দেওয়া হয় নাই।
কাউন্সিল অব মিউচুয়্যাল ইকনমিন এইড (কমিকন) এর মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতার চাইতে এসব দেশের অগ্রগতিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে বেশি। সোভিয়েত ইউনিয়নের যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল সেসব প্রতিষ্ঠান পূর্ব ইউরোপ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে তার ফলে কাঁচামাল রপ্তানীকারক হিসাবেই অনেকের ভূমিকা নির্ধারিত হয়েছে। এসব দেশের তেল, লৌহসহ বিভিন্ন সম্পদের রপ্তানী কিংবা আমতানীতেও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল প্রধান এবং তা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আরোপিত। (পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ- আনু মুহাম্মদ : ৮১)
উপরোক্ত সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কারণে পূর্ব ইউরোপে নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের সাম্যবাদী শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় এবং তারা সমাজতন্ত্রের মুখরোচক কথার আবেশ থেকে বের হয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই এক সময়ের নিবেদিত প্রাণ সভ্যরাই নিজেদের শ্রেণী সংগ্রাম হতে বের হয়ে এসে আমলাতন্ত্রের ছত্রছায়ায় সমাজকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু করে। তারা অর্থনীতি ও রাজনীতির দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির নামে বিভিন্ন পরিবর্তন আনে এবং সেটা আনতে লেলিন, স্টালিন প্রমুখদের বিরূদ্ধে কুৎসা রটাতেও কুন্ঠাবোধ করে না। ক্রুশ্চভ ঘোষণা দিলেন- “পৃথিবী বদলে গেছে”। এজন্য তিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে সহাবস্থানের ঘোষণা দিলেন।
ব্রেজনেভ ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন উৎপাদনী প্রতিষ্ঠানকে ভিন্ন কাঠামোয় প্রতিষ্ঠা করলেন। সর্বশেষ পেরেস্ত্রয়কা প্লাসনস্ত সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের শেষ খোলস হতেও মুক্ত করা হয়। এই সকল কর্মসূচির মাধ্যমে দেখা যায় যারা একদা সাম্যবাদী সমাজ কায়েমের জন্য সংগ্রাম করেছিল, তারাই তাদের একটু বাড়তি সুবিধা অর্জন করার জন্য ব্যক্তিগত মালিকানায় সম্পদ অর্জনের জন্য সমাজতন্ত্রের প্রবক্তাদের পদক্ষেপের কঠোর বিরোধীতা করেছে এবং যুগের পরিবর্তনে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর তাই সমাজতন্ত্র যে আবেশের মধ্যে মানুষ ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছে।
আর তাই ক্রুশ্চভের ঘোষণা- আমরা আগামী ২০ বছরের মধ্যে সাম্যবাদে উত্তরন করবো। তা বাস্তবে পরিণত না হয়ে ৩০ বছরের মাথায় এমনভাবে সমাজতন্ত্র মুখ থুবরে পড়লো যে ১৯৯১ সালে রাশিয়া Oligorts নামের নতুন শ্রেণী উদ্ভব হয় যারা সে দেশীয় সমস্ত শিল্প, কল-কারখানা, প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক বনে যান। একইভাবে যদি চীনের বিপ্লবের দিকে তাকাই তবে দেখবো ১৯৪৯ সালের মাও- এর বিপ্লব লেলিনের বিপ্লব হতে আলাদা ছিল যা পরবর্তীতে মার্কসবাদী-লেলিনবাদী ও মাওবাদী দুটি ভিন্ন ধারার জন্ম দেয়।
আবার, ১৯৪৯ এর চূড়ান্ত বিপ্লবের পর মাও সেতুং, চেন বোদা প্রমুখের সাথে লিউ শাউ চী, তেং শিয়াও পিং প্রমুখদের সমাজ বিশ্লেষণ নিয়ে পার্টির কৌশল নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। মাও সেতুং যেভাবে রাষ্ট্র কাঠামো সাজিয়েছিলেন ১৯৭৬ এর পর নতুন সরকার সংরক্ষণমূলক অর্থনীতির বদলে বাজার অর্থনীতির সূচনা করে এবং বলা হয়- “মুনাফা লাভের উৎসাহ না থাকলে উৎপাদন বাড়বে না।” এভাবে মানুষের ভেতরে সম্পদের মালিকানা অর্জনের প্রতি যে স্বাভাবিক আকাঙ্খা তা বারবার আদর্শকে ভেদ করে বের হয়েছে। এই আকাঙ্খাকে আদর্শের বুলি শুনিয়ে কিছুদিন বিরত রাখা সম্ভব হলেও সম্পদের অঢেল প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে সেটার যৌক্তিক মালিক হওয়ার যে ইচ্ছা সেটাকে দীর্ঘমেয়াদে বিরত রাখা সম্ভব হয় নাই।
দ্বিতীয়ত, মার্কস তার লিখনীর মাধ্যমে সাম্যবাদের যে রূপরেখা দেখিয়ে গেছেন কিন্তু তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে না যাওয়ার কারণে বিভিন্ন আদর্শিক নেতাদের মধ্যে সমাজ বিশ্লেষণ নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতই পুজিবাদের বিকাশকে ত্বরাণ্বিত না করে বরং মন্থর করে দিয়েছে। সমাজ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, দল-গোষ্ঠী যে পথ দেখিয়েছেন যে এর গভীরে প্রবেশ করে সেরূপভাবে নিজেকে সাজানো সাধারণ মানুষের সামর্থের প্রতিকূল। তাদের অবস্থা অনেকটা অন্ধকার রাতে অন্ধ মানুষের কালো বিড়াল দর্শনের মত। তারা শুধু জানে আমরা শোষিত, শোষণ করছে শাসক শ্রেণী, মালিক শ্রেণী। অতএব তাদের গদিচ্যুত করতে পারলেই সবাই সমান হয়ে যাবে। সবাই তখন পেটভরে খেতে পারবে, ইচ্ছামত পড়তে পারবে, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে।
কিন্তু বর্তমানের সমাজটাই কোন অবস্থানে আছে, এই সময়ে কোন কৌশল বা নীতি অবলম্বন করতে হবে সেটা অনেক নেতাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে এবং তার পেছনে গ্রহণযোগ্য যুক্তি দেখাতে পারে না। এমতাবস্থায় কিছু সাধারণ ও দুর্বোধ্য কথার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে পুনরায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কায়েম করা কতটুকু সম্ভব সেটাই এখন প্রশ্ন। আর যদিও বা দৈব দুর্বিপাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেও তবে নেতৃস্থানীয়সহ বিপ্লবীরাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সুযোগ-সুবিধার স্বার্থ ত্যাগ করে অনন্তকাল পর্যন্ত শ্রেণী সংগ্রাম চালিয়ে যাবে সেটাই বা আমরা কোন ভরসায় বলতে পারি। আর যদি তা না হয় তবে হয়ত আরেক কাঠামোতে সমাজতন্ত্র আসবে কিছুদিন থাকবে সাম্যবাদে না পৌঁছে বরং শ্রেণী বৈষম্য আরও বৃদ্ধি করবে।
বর্তমানের USA সহ বিশ্বময় যে আর্থিক সংকট তার ফলে বিশ্ব নাকি পুজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে আসবে। কেননা, উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন চরমে।
কিন্তু স্টালিনের বক্তৃতা থেকে জানা যায়, সঠিক কর্মনীতি অনুসৃত না হলে সোভিয়েত সমাজেও উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব শত্র“তামূলক হয়ে উঠতে পারে এবং উৎপাদিক শক্তির অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে।
তাই আমরা দেখতে পারছি, পুজিবাদী সমাজব্যবস্থা সমাজতন্ত্রে পরিবর্তিত হলেও যে শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ কায়েম হয়ে মানুষের ঘরে ঘরে শান্তির সুবিমল বাতাস বইয়ে দেবে তা গ্যারান্টিসহ ভাবা যায় না। আবার বর্তমানের এই প্রতিকূল মুহুর্তেও উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যকার দ্বন্দ্বটা এত প্রবল ও কার্যকরী কিনা যে বিশাল সুদৃঢ় পুজিবাদের বাগাড়াম্বর ছিন্ন করে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হবে।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পুজিবাদ ঝুকির সম্মুখীন। USA, ইউরোপসহ দেশে দেশে সরকার তার শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে Reskue Package নিয়ে এগিয়ে আসছে। এই সময়ে কেইনসিয়ান মডেল এর ছত্রছায়ায় রাষ্ট্রগুলো পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেখানে যেখানে সমস্যা সেই সমস্যা দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু USA তে বিশাল আকারে বাজেট ঘাটতি সেখানে ব্যাপকহারে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করছে। পুঁজিবাদের যে বাজারের উপর পুরোপুরি নির্ভর করার ফলাফল ১৯৩৭ সালের মত পুনরায় দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তাই স্বল্প মেয়াদে Keynsian model পথ দেখালেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা সমাধানে কোন পথ দেখায় না। সেখানে পুনরায় বাজারের নিকট আত্মসমর্পন করতে হয়। তাই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটতে গিয়ে যেমন তাৎক্ষণিক অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয় তদ্রুপ অনেক চেষ্টার পর রক্ষা পেলেও দীর্ঘমেয়াদে পুনরায় বড় কোন ঝুঁকির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এমতাবস্থায় আমাদের দেখতে হবে এই পৃথিবীর মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই গতিশীল উন্নয়নের দিকে ধাবিত করতে হলে পুজিবাদ, সমাজতন্ত্র কিংবা Keynsian এর বাইরে কোন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যায় কিনা তাই আমাদের ভাবতে হবে।