সন্তান বখাটে হয় কারণ- পারিবারিক স্খলন, পর্যাপ্ত সময় বাবা-মাকে না পাওয়া, স্বজনদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের অভাব, একাকীত্ব, বিষণ্নতা, রূঢ় বাস্তবতা, হীনমন্যতা, কুসঙ্গ, কলহপ্রবণ সংসার, বিবাহ বিচ্ছেদ ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। পরিবারেই সন্তানকে সামাজিক শিক্ষা দিন, সন্তানের আত্মিক ও নৈতিক বিকাশ করুন। একজন কিশোর-কিশোরী শারীরিক পরিপক্কতা লাভ করারও অনেক পরে মানসিক পরিপক্কতা লাভ করে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, পৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম; যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। উত্তেজক ছবি ভুল পথ প্রদর্শন করে, সেক্সভায়োলেন্সের জন্ম দেয়। নেশাগ্রস্ত কেউ বন্ধু নয়, শত্রু। বাগান করা, নিজের কাপড় গুছানো, নিজের টেবিল গুছানো, কবিতা শোনা, কবিতা আবৃত্তি করা, গান শোনা, গান গাওয়া, ছবি আঁকা, লেখাপড়া করা, বইপড়া, খেলাধুলা করা, মানবসেবা করা ও সৃষ্টিশীল কাজে সময় ব্যয় করা উচিত।
গ্যাংগুলো তৈরি যেভাবে
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, অ্যাডভেঞ্চার বা ক্ষমতা প্রদর্শনেচ্ছা, মাদক, বন্ধুদের পাল্লায় পড়াসহ নানা কারণে কিশোর গ্যাংগুলো তৈরি হয়। ব্যস্ততার কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। এমনকি সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, তাদের চাহিদা কী, এসব সম্পর্কেও তারা কোন খোঁজ রাখেন না। ফলে এই সন্তানরা বন্ধুদের কাছে আশ্রয় খোঁজে, তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করে। সেখানে তারা একই ধরণের মানসিকতা খুঁজে পায়, সাপোর্ট পায়। এভাবেই তাদের ছোট ছোট দল তৈরি হয়। পরে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে বা রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের স্বার্থে এই কিশোররা জড়িত হতে থাকে।
অনেক সময় এলাকায় আধিপত্য দেখানো, সবার সামনে নিজেকে জাহির করার লোভ থেকে তারা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। দেখা যায়, ক্লাসের একজন বন্ধু কোন গ্যাংয়ের সদস্য হলে আরেকজনকে সেখানে সদস্য হতে প্রভাবিত করে। এ ধরণের ছেলেদের অন্যরা একটু ভয় পায়। ফলে সেটা তাদের মধ্যে এক ধরণের ক্ষমতার মনোভাব তৈরি হয়। ফলে তারা গ্যাংয়ের সঙ্গে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে পড়ে। পরে মাদক বা নিজেদের খরচ জোগাড় করতে তারা নানা অপরাধ করা শুরু করে। এরপর আর বেরিয়ে আসতে পারে না। অনেক সময় নিজেদের দল ভারি করতে প্রথম দিকে বিনামূল্যে মাদক সরবরাহ করে শিক্ষার্থীদের আসক্ত করে তোলা হয়। পরে তাদের গ্যাংয়ের সদস্য করে নেয়া হয়।
কিভাবে বুঝবেন
কিশোরদের গ্যাংয়ে জড়িত হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন। সন্তানের চলাফেরা, আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখলেই বুঝতে পারা যাবে যে, সে আসলে কোন গ্যাং বা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কি না। হয়তো সন্তানটি সময়মতো বাসায় ফিরছে না। ঠিকমতো খাচ্ছে না বা ঘুমাচ্ছে না। হয়তো বাসায় ফিরে নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকছে। অতিরিক্ত টাকা দাবি করছে। বাসায় বন্ধুদের নিয়ে বেশি আড্ডা দিচ্ছে। কাপড় চোপড়ের ধরণ পাল্টে যাচ্ছে। হয়তো হাতে বা কানে নানা ধরণের অলংকার ব্যবহার শুরু করেছে। কথাবার্তা বা আচরণে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এসব লক্ষণ দেখা গেলেই সন্তানের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
বাবা-মা দুজনে কর্মজীবী হলেও সন্তান কী করে, কাদের সঙ্গে মেশে, কোথায় যাচ্ছে, টাকা কোথায় খরচ করছে, ঠিক সময়ে বাসায় ফিরছে কিনা ইত্যাদি ঠিকভাবে নজরে রাখতে হবে, খোঁজ-খবর নিতে হবে। সন্তানের আচরণের দিকে লক্ষ্য রেখে বোঝতে হবে তার আচরণ-অভ্যাসের মধ্যে আসলে কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা? সে কোন গ্যাং বা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কিনা? প্রথম দিকে পরিবর্তন সনাক্ত করা গেলে খুব সহজেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। এ রকম ঘটনায় ছেলেমেয়ের টাকার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে তার বাসায় ফেরার সময়সূচিরও ঠিক থাকে না। এই দুইটি বিষয় দেখা গেলেই সতর্ক হওয়া উচিত।
কীভাবে ফেরাবেন
সন্তান গ্যাং এর সদস্য জানতে পারলে পারিবারিক কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অভিভাবকদের জন্য সন্তানকে সময় দেয়া জরুরি। তাদের সঙ্গে আস্থার-বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতিতে পশ্চিমা অনেক কিছু ঢুকে গেছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছি, বিদেশি কেতায় চলছি, সুতরাং সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই স্বাভাবিকতা নিয়ে আসতে হবে। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করাটা জরুরি। সন্তানের স্কুলে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা, কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, সেটা নিয়মিতভাবে নজরে রাখা উচিত। এছাড়া সন্তানদের হাতখরচ দেয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা উচিত, যেন সেটা অতিরিক্ত না হয়।
সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে হবে, বকাঝকা না করে তার কথা শুনতে হবে। কেন সে গ্যাং এর সাথে জড়িত হয়েছে সেটা বোঝা দরকার। সন্তানের চাহিদার ব্যাপারটি বুঝতে হবে। পরিবারে বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব থাকলে সন্তানরা মাদক বা গ্যাং জাতীয় ঘটনাগুলোয় বেশি জড়িয়ে পড়ে। সেই দূরত্ব কাটাতে অভিভাবকদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। আচরণগত ত্রুটি থাকে। এ কারণেও অনেকে গ্যাং এর সদস্য হতে পারে। এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তা নিতে হবে। এরকম ঘটনায় সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে পরিবেশের পরিবর্তন। যেমন ওই এলাকা থেকে দূরের অন্য এলাকায় চলে যাওয়া, স্কুল-কলেজ বদলে ফেলা ভালো। সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্য সমস্যাটি কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।