সাংবাদিকতার ভবিষ্যত নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। ভবিষ্যতের সাংবাদিকতার ব্যাপারে সাক্ষাত্কারও দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। মিডিয়া নির্বাহীরা আশা-নিরাশা ও সমস্যা-সম্ভাবনার কথা বিভিন্ন আলোচনায় জানিয়েছেন। নিবন্ধ-প্রতিবেদন-গবেষণা এবং সেমিনার-গোলটেবিল আলোচনার ভিত্তিতে মিডিয়া ও সাংবাদিকতা আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে সম্পর্কিত অনুমান-ভবিষ্যদ্বাণী-ধারণা নিবন্ধটিতে উপস্থাপিত হবে। সাংবাদিকতায় পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
পরিবর্তন কেন অপরিহার্য?
অর্থের বিনিময়ে বিশেষ সুবিধা
নিউইয়র্ক টাইমসের একটি পেপার-সংস্করণ আন্তর্জাতিক খবর থেকে শুরু করে খেলাধুলা এবং ব্যবসায়ের সমস্ত সংবাদ একটি প্যাকেজে গ্রাহককদের কাছে পৌঁছে দেয়। গ্রাহকদের কাছ থেকে সাবস্ক্রিপশন ফি নেয়ার এই বিজনেস মডেলটি তৈরি হয়েছে প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদার কারনেই। ডিজিটাল মিডিয়া পাঠকদের সহজেই বিভিন্ন ধরণের কনটেন্ট একটি উত্স থেকেই বাছাই করার সুযোগ দেয়। ফেসবুকের মাধ্যমে নিউজ পড়তে হলে ভবিষ্যতে সাবস্ক্রাইব করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সংবাদপত্রের ১০টির বেশি নিউজ পড়তে চাইলে ব্যবহারকারীকে সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হবে। জনপ্রিয় মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার বাণিজ্যিক ও টুইটডেকের বিশেষ সুবিধার জন্য সাবস্ক্রিপশন ফি নেয়ার চিন্তা করছে। ‘নিউজ সাবস্ক্রাইব’ অপশন চালুর পদক্ষেপ দিন দিন বাড়ছে।
সাংবাদিক ও শ্রোতা-পাঠক-দর্শকদের সীমারেখা অস্পষ্ট
একজন ‘প্রকৃত সাংবাদিক’ এর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা কখনো পাওয়া যায়নি। অতীতে মিডিয়া মার্কেটে প্রবেশের জন্য অনেক বেশি অর্থ বিনিযোগ করতে হতো। ফলে তুলনামূলকভাবে কয়েকটি মিডিয়া সংস্থাই এই খাতে আধিপত্য বিস্তার করতো। কাকে নিয়োগ দেয়া হতো তার উপর ভিত্তি করে ক্ষমতায় রদবদল হতো। বর্তমানে অনলাইনসহ একটি নতুন মিডিয়া সংস্থা শুরু করার জন্য ব্যয় আগের তুলনায় শূন্যের কাছাকাছি। পর্যাপ্ত ভালো কনটেন্টসহ যে কেউ অনলাইনে কাজ শুরু করতে পারে এবং পর্যাপ্ত পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারে। জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় আয় করতে পারে। ফলে কে সাংবাদিক এবং কে সাংবাদিক নয় সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা চলে যায় পাঠকদের কাছে। কারণ তারা প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া সংস্থাগুলির সম্পাদকদের চেয়েও নয়া গণমাধ্যমের কাউকে বেশি বিশ্বাস করছেন, বেশি পছন্দ করছেন, বেছে নিচ্ছেন।
মুদ্রিত সংবাদপত্র মারা যাচ্ছে
একটি সংবাদপত্র পড়া খুবই উপভোগ্য বা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হতে পারে। তবে সংবাদ উপস্থাপনের জন্য গাছকে মেরে ফেলে ব্যবহার করা একটি খারাপ ধারণা। একদিকে ছাপা সংবাদপত্র ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে পাঠকের কাছে পৌঁছে। ব্যয়ের ৬০-৭০ ভাগই মুদ্রণ ও বিতরণে ব্যয় হওয়ায় ছাপা সংবাদপত্র ব্যয়বহুল। ঘটনা ঘটার একদিন পরে পাঠক পড়তে পারে। গাছ কেটে তৈরি কাগজ, ফলে পরিবেশের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে- অনলাইনে ঘটনা ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রদর্শিত হয়। কাগজের বই বা মুদ্রিত ম্যাগাজিনগুলির গ্রহণযোগ্যতা-চাহিদা কম-বেশি ভবিষ্যতেও থাকবে, এ নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে এটি স্পষ্ট যে, মুদ্রিত সংবাদপত্র মারা গেছে, মারা যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপনগুলি আরো স্মার্ট হবে
সাধারণত মিডিয়া টার্গেটভিত্তিক বিজ্ঞাপনগুলি ব্যবহার করে। একটি নতুন গাড়ি অনুসন্ধান করলে গাড়ী ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন দেখতে পাবেন। তবে এই বিজ্ঞাপনগুলি সবসময় খুব স্মার্ট হয় না। আপনি যদি ব্রাজিলের কোনও ট্রিপ বুক করেন, আপনি ফিরে আসার অনেক পরেও সাও পাওলোতে হোটেলগুলির বিজ্ঞাপন দেখতে পাবেন। অথচ আগামীতে গ্রাহকের কখন এবং কী কী প্রয়োজন তা বোঝার জন্য সাইটগুলি আচরণের বিষয়ে আরও স্মার্টবোধ তৈরি হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট প্রকাশ করবে কে কে ছুটি থেকে ফিরে এসেছে, এটিই নির্দেশ করবে যে তাদের আর হোটেলের দরকার নেই।
সাংবাদিকতা সেবায় পরিণত হবে
স্বাধীন সাংবাদিকরা জনসাধারণের প্রয়োজন পূরণে সহায়তা করতে পারে। সাংবাদিকরা প্রতিবেদন ছাড়াও গল্প বলার মাধ্যমে দরকারি তথ্য জানিয়ে উপকার করতে পারে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিভিন্ন ব্যক্তির স্বতন্ত্র প্রয়োজনগুলির ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি বাড়তে পারে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সমস্যঅর সমাধানে সহায়তা করা, সামর্থ্য বাড়াতে সম্ভাবনার বিকাশ করে ক্ষমতায়িত করতে সাহায্য করতে পারে। একটি অনলাইন ভ্রমণ সাইট কোন শহরে কোন রেস্তোঁরাগুলি ভালো তা জানাতে পারে, চাহিদা পূরণ করতে সহায়তা করতে পারে এবং পরিস্থিতির আলোকে সন্তোষজনক বিকল্প বেছে নিতেও পরামর্শ দিতে পারে।
সফটওয়্যার-রোবটের কারণে চাকরিচ্যুতি
সফটওয়্যার বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য খুঁজে এনে, সেই তথ্যের ধরন ও প্রবণতা বুঝে, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ব্যবহার করে সেই প্রবণতাকে প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে মিলিয়ে – বিশেষণ, উপাধি ও রূপকসহ আধুনিক বাক্য গঠন করতে পারে। অনেকগুলো কাজ সফটওয়্যার দ্বারা সম্পাদন করা হয়, তবে সফটওয়্যারগুলো কম্পিউটার ব্যতীত চালানো মোটেই সম্ভব হয় না। অনেক মিডিয়া হাউজ তথ্য বিশ্লেষণের জন্য উপযুক্ত গবেষক নিয়োগ করতে পারে না। অথচ অনেক সংবাদপত্রই গবেষকের বিশ্লেষণের পরিবর্তে সফ্টওয়্যার দ্বারা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন । এমন অবস্থায় এটি আশা করা সমীচীন হবে না যে, মিডিয়া সংস্থাগুলি কর্মীদের ছাটাই করে ব্যয় হ্রাস করবে না বা ব্যয় কমানোর জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করবে না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে অনেক সাংবাদিকের চাকরিই বিপদের মুখে পড়বে।
দক্ষতা অর্জন
একইসঙ্গে বেতার, টিভি, অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমের কথা মাথায় রেখে সাংবাদিকতা করতে গেলে, রেডিও বা টিভির জন্য তৈরি একটা স্টোরি কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উপযুক্ত করে লেখা যায় বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের স্টোরি কীভাবে বেতার সম্প্রচারের উপযুক্ত করা যায়, সেই দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন।
মান বাড়ানো
ফ্রন্টলাইন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মার্ক টালি বলেন, সার্বিকভাবে টিভি সাংবাদিকতার মান মারাত্মকভাবে নেমে গেছে। তারা সাংবাদিকতার সস্তা পথ বেছে নিয়েছে। শুধু সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন করছে। তৃণমূলের মানুষ কী ভাবছে, তা খতিয়ে দেখছে না। এ ছাড়া কোনো গণমাধ্যম ফলোআপ করতেও আগ্রহ দেখায় না। একটা-দুটো প্রতিবেদন করে দায়িত্ব শেষ করে। এটি কাঙ্ক্ষিত নয়।
বিজ্ঞাপনে নির্ভরশীলতা কমানো
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের বড় সমস্যা হলো এর উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। ২০ পাতার একটি পত্রিকা মুদ্রণে (কাগজ ইত্যাদিসহ) খরচ হয় ২০ টাকার কাছাকাছি। নির্ধারিত মূল্য ১০ টাকা। হকার বা এজেন্টের কমিশন বাদ দিয়ে পাওয়া যায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ টাকা। ফলে বিজ্ঞাপনই আয়ের প্রধান উৎস। বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হলে পত্রিকার দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যেখানে পাঠক প্রায় বিনামূল্যে সব তথ্য হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছেন, সেখানে পত্রিকার দাম বাড়ানো কতটা বাস্তবসম্মত, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়। টেলিভিশন শিল্পের দুর্দিনের আরো একটি কারণ হলো বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া। যে হারে গণমাধ্যমের অনুমোদন দেয়া হয়েছে সে হারে কিন্তু বিজ্ঞাপনের বাজার বাড়েনি। আগে বিজ্ঞাপন অফিসে আসতো আর এখন বিজ্ঞাপনের জন্য নানা তদ্বির লাগে।