প্রবীণবান্ধব হোক পরিবার

প্রবীণবান্ধব হোক পরিবার। প্রবীণবান্ধব পরিবার বৃদ্ধ ব্যক্তির আর্থিক, সামাজিক ও সামগ্রিক নিরাপত্তা প্রদান করে। জ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা থাকার কারণেই বয়স্কদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিরসনে নবীন সদস্যরা আন্তরিক ভূমিকা রাখে। প্রবীণদের প্রয়োজন পূরণ ও অধিকার পূরণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ও সচেতন থাকে। প্রবীণকে স্বস্তিদায়ক কর্মমুখর জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে তাদের জীবনকে অর্থবহ করতে সচেষ্ট থাকে। যেসব প্রবীণের মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য নেই, তাদের চাহিদা পূরণকে অগ্রাধিকার দেয়। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি বাবা-মাকে ফেলে এককভাবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেন না।

শারীরিক ও মানসিক সাপোর্ট

বার্ধক্যে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা, তাদের যাপিত জীবনের বাস্তবতা অনুধাবনের মানসিকতা রাখা, তাদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তায় সচেতন থাকা একটু বেশিই প্রয়োজন। পরিবারের কর্মক্ষম ও উপার্জনক্ষম সদস্যদের ভাবতে হবে; প্রবীণরা পরিবারের জন্য বোঝা নন বরং আশীর্বাদস্বরূপ। অবসরের পরও প্রবীণদের মেধা, প্রজ্ঞা ও সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে যথাযথভাবে কাজে লাগালে অনেক সুফল পাওয়া যায়। বার্ধক্যে মানুষের সামাজিক বিচরণের ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসে। সন্তান-সন্ততিরা নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সমবয়সী আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা কমে যায়। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে প্রবীণেরা ধীরে ধীরে প্রয়োজনহীন, মূল্যহীন, অকেজো, উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়। এমতাবস্থায় তাদের শারীরিক ও মানসিক সাপোর্ট খুব বেশি দরকার।

সহানুভূতিশীল থাকা

অনেক সময় পুত্রবধূ কিংবা নাতি-নাতনিদের হাতে স্মার্টফোন থাকা, বাসায় ডিসের লাইন থাকা, কম্পিউটার-ইন্টারনেটে ব্যস্ত থাকা, রাতে বাসায় ফেরা- প্রবীণরা পছন্দ করেন না। প্রবীণদেরও আধুনিক বিষয়গুলো গ্রহণ করতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। শুধু ভুল ধরা, রাগারাগি করা থেকে বিরত থেকে সহনশীল ও ক্ষমাশীল মানসিকতা রাখতে হবে। মা-বাবার প্রতি সন্তানদের আগ্রহ থাকলে তা নাতি-নাতনিদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়বে। প্রবীণদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতে হবে, প্রবীণদের সঠিক মূল্যায়নে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করুন। মা-বাবা আমার সাথে থাকেন- না বলে, বলুন- আমি আমার মা-বাবার সাথে থাকি। কর্মক্ষম প্রবীণদের উপযুক্ত কাজে লাগিয়ে সম্মানজনক ও সক্রিয় জীবন যাপনে সহায়তা করুন।

অসহায়ত্ব দূরীকরণ

অসুস্থ প্রবীণদের  চিকিৎসা করাতে হবে, নির্ভেজাল পুষ্টিকর খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। তাদের প্রতি অবহেলা-অযত্ন-দুর্ব্যবহার আর নির্যাতনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সর্বস্তরে সচেতনতা ও সতর্কতা বাড়াতে হবে। নবীন-প্রবীণদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান, মধ্যম-প্রবীণদের জন্য হালকা কাজকর্ম এবং অতি-প্রবীণদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করুন।

প্রবীণদের জন্য খাদ্যের নিরাপত্তা, সেবা দেয়া, সঙ্গ দেয়া, স্বাধীনতা দেয়া ইত্যাদি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংসারে প্রবীণ যেন কষ্ট না পান সেজন্য আচরণে সতর্ক থাকুন,  সম্মান দেখান, ভালোবাসুন, শ্রদ্ধা করুন। নন-কমিউনিকেবল ডিজিজগুলো প্রিভেনশন করতে ব্যায়াম বা লাইফস্টাইলের পরিবর্তনে সহায়তা করুন। প্রতিবন্ধী, শারীরিকভাবে রুগ্ন-দুর্বল এবং সামর্থ্যহীন প্রবীণদের ব্যাপারে আন্তরিক থাকুন। প্রবীণের নিরাপদ ও মর্যাদাজনক জীবন নিশ্চিত করে অসহায়ত্ব দূরীকরণে নবীনের এগিয়ে আসুন।

প্রবীণের প্রজ্ঞা পরিবারের সম্পদ

প্রবীণ সমস্যাটির সমাধানে কিছু সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। প্রবীণদের দেখুন, বুঝুন, তাদের কাছে যান, তাদের সঙ্গে সময় কাটান। তাদের কল্যাণে কাজ করতে বা টাকাপয়সা খরচ করতে আগ্রহী হোন। তাদের অধিকার পূরণে সচেতন হোন। প্রবীণদের জন্য বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করুন। পরিবারের বিভিন্ন কাজে  প্রবীণদের অন্তর্ভুক্ত করলে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নবীনদের সামনে এগিয়ে যাওয়া দ্রুততর হবে।

প্রবীণদের পক্ষে যানবাহনে চড়া, অফিস-আদালত-ব্যাংক-হাসপাতালে যাওয়া-আসা, হাঁটাচলা করা, রাস্তা পার হওয়া, বাজারঘাট ও দৈনন্দিন কাজকর্ম করা অত্যন্ত কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বয়সের ভারে রোগে-শোকে আক্রান্ত প্রবীণকে সম্পদ ও বাড়িঘর পাহারা দেওয়া, রান্না করা, শিশুদের দেখভাল ও স্কুলে আনা-নেওয়া করার মতো সাংসারিক কাজে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করা বা কষ্টসাধ্য উপার্জন কাজে নিয়োজিত করা কোনোক্রমেই সমীচীন নয়। প্রবীণদের কষ্টদায়ক কাজে নিয়োজিত করা থেকে বিরত থাকুন।

প্রবীণবান্ধব মানসিকতা

প্রবীণদের ইতিবাচক, সৃজনশীল, অর্থবহ হিসেবে চিত্রায়িত করে তুলে ধরে তাদের প্রতি ছোটদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পরিবারের বড়রা ভূমিকা রাখুন। মানবিক সমাজ বিনির্মাণে মানবিক পরিবার বিনির্মাণের বিকল্প নেই। পরিবারের সব সদস্য প্রবীণবান্ধব মানসিকতার হলে, প্রবীণদের বাস্তবতার কথা মাথায় রাখলে পরিবারও সুখী হবে। প্রতিটি পরিবার যদি পরিবারস্থ বৃদ্ধ মানুষের মানবেতর জীবনযাপন বন্ধ করার দায়িত্ব নেয়, তবে তা বৃহত্তর মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। এক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের সকল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যৌথ পরিবারের চর্চা বৃদ্ধি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দূর করতে হবে, মনমানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।

নিরাপদ ও আনন্দের জীবন

প্রবীণদের অনুৎপাদনশীল, অক্ষম, দুর্বল ও ব্যাধিগ্রস্ত মনে করা; চিন্তা-চেতনায় সেকেলে, পরিবর্তনবিমুখ মনে করা ঠিক নয়। প্রতিটি পরিবারই এমন হোক যাতে জীবন সায়াহ্নে এসে মানবেতর দিন কাটাতে হবে না কোনো প্রবীণের, ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনির ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে না, নিশ্চিত হবে ন্যায্য অধিকার, প্রবীণদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত ও ঝুঁকিপূর্ণ হবে না। পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তিরা অবহেলা, বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হবে না, সম্পত্তিভোগের পূর্ণ অধিকার পাবে। প্রবীণদের জীবন হবে না নিরাপত্তাহীন, সন্তানের সাথে দেশে বা প্রবাসে অবস্থান করতে পারবে, পরিবার-পরিজনহীন একাকী জীবন কাটাতে হবে না। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে নতুবা চেনাজানা পরিবেশ ছেড়ে শহরের বিশাল জনস্রোতের সঙ্গে মিশে ভিক্ষাবৃত্তি বা শ্রম বিক্রি করে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে না।

একাকিত্ব ও বিরক্তির উদ্রেক নয়

বৃদ্ধরা দয়া চায় না, অধিকার চায়, পূর্ণ অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়, সুখের সাথে মৃত্যু চায়। নিরাপদ বার্ধক্যে স্বস্তিময় জীবনে আনন্দময় থাকতে চায়। তাই প্রবীণ ব্যক্তি উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরলে ঠাট্টা করার মানসিকতা দূর করুন। প্রবীণবান্ধব বাড়ি ও সিঁড়ি নির্মাণ করুন। বাবা-মায়ের জন্য আলাদা কক্ষ বরাদ্দ রাখুন। অনুষ্ঠানাদিতে প্রবীণদের উপযোগী খাবার রাখুন। প্রবীণদের প্রতি অন্যায় আচরণ সংঘটিত হতে দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ করুন এবং প্রতিবিধানের জোরালো ব্যবস্থা নিন।

যাতে প্রবীণেরা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আর্থিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য দ্বারা অবহেলা ও অপব্যবহারের শিকার না হয়। প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য, খাদ্য, পোশাক ইত্যাদি সরবরাহ করা এবং কাক্সিক্ষত সঙ্গ দেওয়া জরুরি। প্রবীণকেও বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণে নিয়ে যেতে হবে। যাতে পরমুখাপেক্ষী-পরনির্ভরশীলতা প্রবীণের মাঝে একাকিত্ব, হতাশা ও বিরক্তির উদ্রেক না করে।

মর্যাদাপূণ বার্ধক্য

বার্ধক্য হতে হবে সফল, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ। দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া-পাওয়ার সমাধান করুন। বয়সের ভারে নিস্তেজ প্রবীণরা একটু সহানুভূতিতে বেঁচে থাকুক, সুখ-শান্তি ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচুক।  প্রবীণদের স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা, আত্মতৃপ্তি, সেবাযত্ন ও দেখভালের বিষয়টি গুরুত্ব দিন।

আসুন পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করি, প্রবীণদের ভালোবাসি, প্রবীণবান্ধব পরিবার তৈরি করি, সফল বার্ধক্যের স্বার্থে তাদের অধিকার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হই, শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের দেখভাল করি, নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিই এখন থেকেই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিটি পরিবার হোক সব বয়সীর বসবাসের জন্য সমান উপযোগী, সমান সুরক্ষিত ও উপভোগ্য।

 

About আনিসুর রহমান এরশাদ

শিকড় সন্ধানী লেখক। কৃতজ্ঞচিত্ত। কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। ভেতরের তাগিদ থেকে লেখেন। রক্ত গরম করতে নয়, মাথা ঠাণ্ডা ও হৃদয় নরম করতে লেখেন। লেখালেখি ও সম্পাদনার আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন সময়ে পাক্ষিক-মাসিক-ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন, সাময়িকী, সংকলন, আঞ্চলিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ ও জাতীয় দৈনিকের সাথে সম্পর্ক। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা, গবেষণা, লেখালেখি ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। পড়েছেন মিডিয়া ও জার্নালিজমেও। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা গ্রামে।

View all posts by আনিসুর রহমান এরশাদ →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *