যাদের ধর্মীয় ইলম ও উপলব্ধি রয়েছে এবং সেই অনুযায়ী আমল রয়েছে- তারা প্রশান্ত হৃদয়ের আধার। আমি দেখেছি- লক্ষ শিক্ষার্থীর প্রবীণতম শিক্ষকদের; যারা নিভৃতচারী, নিরহংকার, মিতভাষী, অনুকরণীয় প্রাণ! যারা মানুষ গড়ার অমূল্য একেকটি পরশ-পাথর! বিশিষ্ট-প্রাজ্ঞ-বিদগ্ধ আলেমে দ্বীন, অনন্য মেধার অধিকারী বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বর্ষীয়ান মুফাসসির হয়েও কেমন নির্লোভ মানুষ! জনবান্ধব ও শিক্ষার্থীবান্ধব ব্যক্তিত্ব! পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি মানুষ! সদালাপী, প্রচারবিমুখ ও দীনের একনিষ্ঠ খাদেম!
আসলে কোনো মুসলমানই প্রকৃত আলেমকে ঘৃণা করে না বরং শ্রদ্ধা করে। কারণ আলেমরা আলোর রাজপথ দেখান, মানুষকে সত্য-শান্তি-মুক্তির পথে আহ্বান জানান, মানুষকে আলোকিত মানুষ বানান, ইসলামকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করেন। নবীদের উত্তরসূরি হিসেবে নবীর কর্মসূচিকে অনুসরণ করে ইসলাম প্রচার-প্রসারে দাওয়াত দেন, ওয়াজ-বক্তৃতা করেন, লেখালেখি করেন ও পাঠদান করেন। ইলমে দ্বীনের খেদমত তো সদকায়ে জারিয়া। আর আলেমরা হলেন জাতির মাঝে কল্যাণ, নিরাপত্তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানের প্রতীক। প্রকৃত আলেমদের সংখ্যা বেশি হলে কল্যাণ বেড়ে যায়, অকল্যাণ হ্রাস পায় এবং ফিতনা-ফাসাদের কবর রচিত হয়।
অনেক আলেমরাই লক্ষ প্রাণে প্রদীপ জ্বালানো মানুষ! কর্মমুখর মানুষ! নেককার মানুষ! আমলদার মানুষ! পরহেযগার মানুষ! কি শান্ত, সৌম্য, মার্জিত, ভদ্র চেহারা! এমন অনেকে আছেন যারা অসংখ্য আলেমের উস্তাদ- যারা কখনো চিৎকার করে কথা বলেন না, রাগ করেন না, সার্বক্ষণিক স্মিত হাসি মুখে লেগে থাকে! সুললিত কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করেন! চমৎকার বাচনভঙ্গিতে পড়ান! শ্রোতাদের কানে ভেসে আসে হৃদয়গ্রাহী ও মনোমুগ্ধকর সুর! অধিকাংশই আমলে সালেহ করেন। উস্তাদরা মরে গেলেও বেঁচে থাকেন তাদের অগণিত শিক্ষার্থীদের মনের মাঝে, কর্মের মাঝে, কৃতিত্বের মাঝে, সফলতার মাঝে।
যে যাই বলুক- মরার পরে জানাযাতো কোনো আলেমই পড়ান। মক্তব্যে যারা আল কুরআন পড়া শেখান, কিংবা মাদ্রাসাতে যাদের হাতে ধর্মীয় শিক্ষার সবক শুরু হয়- তাদের খেদমতের প্রভাবতো জীবনব্যাপী। যারা হারাম খায় না, যারা দ্বীনের কথা বলে, যারা নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের কথা বলে তাদের সমালোচনা যদি এমন কেউ করে যে সুদ-ঘুষ-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত- তা বড্ড বেমানান! ভুলে গেলে চলবে না- আলেমরাও মানুষ, তাদেরও ভুল-ত্রুটি হতেই পারে! কোনো মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয় । তাই বলে দুই-একজনের জন্য পুরো আলেম সমাজের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা গণমানুষের বিরুদ্ধে অবস্থানেরই প্রমাণ, ইসলাম বিদ্বেষে হীন চেষ্টায় মেতে উঠা!
যারা নিবেদিত প্রদীপ হয়ে অনেকের মনোজগতে আলো জ্বালান, অর্থ-বিত্তের প্রতি যাদের মোহ নেই, বস্তুর প্রতি যারা অনাগ্রহী, দুনিয়ার লোভ যাদের স্পর্শ করে না- এমন অনেক আলেম রয়েছেন! নবী সা. বলেছেন, তোমাদের কি আমি বলব না যে তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে উত্তম? সাহাবীগণ বলেন, হ্যাঁ বলুন হে আল্লাহর নবী! তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ আসে। এমন অনেক উস্তাদ রয়েছেন, যারা অত্যন্ত সহজ-সরল-বিনয়ী মানুষ; যাদের মায়া-মমতা-ভালোবাসা-শ্রমের ফলে অনেক শিক্ষার্থীই আলোকিত মানুষ হয়ে সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন বিপুলভাবে।
পাঁচবার মসজিদে একত্রিত করার জন্য মানুষকে উচ্চকণ্ঠে আহ্বান জানায় মুয়াজ্জিনরা আর আখিরাতে বিশ্বাসীদেরকে মুক্তির পথে চলতে সহযোগিতা করেন নামাজের জামাতের ইমামরা। যে নিজে কুরআন সহীহ-শুদ্ধ করে পড়তে জানে না, পাপের পর পাপ করার পরও যার অনুশোচনা জাগে না- সেও এদের ভুল-ত্রুটি ধরার চেষ্টায় দিন-রাত প্রয়াস চালায়! যিনি ইমামতি করেন, যে খতিব খুৎবা দেন- তারা সংশ্লিষ্ট সমাজবাসীর নিকট যথেষ্ট সম্মানিত!
মাদরাসা-মক্তবের দ্বীনদার-আমানতদার-দায়িত্ববান আদর্শ শিক্ষকরা যথাসময়ে ক্লাসে আসেন! দরদ দিয়ে পাঠদান করেন। কী নিষ্পাপ মায়াবী মুখ! কী নূরানী চেহারা! সফেদ দাড়ি ও সাদা পোশাকের মানুষেরও কী যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি! একসময় মীরহাজিরবাগ ছিল নিয়মিত বিচরণ ক্ষেত্র। ২০০০-২০০২ সালে তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় ছিল প্রতিদিনের পদচারণা। তখন সরাসরি দেখেছি এমন শিক্ষকদের! বছরের পর বছর দেখা না হলেও যেসব হুজুরদের অস্তিত্ব হৃদয়ের গভীরে আছে! মনের গহীনে যাদের জায়গা আছে! কি যে প্রিয়মুখ! শত স্মৃতি! প্রাণের উচ্ছ্বাস! আবেগ! ভালোবাসা!
এটা সত্য- জানাশোনা বা ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে সব আলেম সমান নয়! যেমনি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেইতো ব্যক্তিভেদে কিছু পার্থক্য থাকেই! এই পার্থক্য খুবই স্বাভাবিক, খুবই মানবিক! ফলে কোরআন-হাদিসের আলোকে নিজেকে বা নিজের পরিবারকে গঠনের পাশাপাশি সমাজ গঠনেও ভূমিকাও সব আলেমের এক ধরনের-মাত্রার নয়! তবে সত্যিকারের সব আলেমের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ- যারা মানুষের মাঝে সঠিক ইলম তুলে ধরেন, পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি ও চিরস্থায়ী জান্নাতের বাসিন্দা হবার প্রস্তুতি নেবার উদ্দেশ্যে উপদেশ দেন। আর নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে তাঁরা সব সময়েই সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী।
আলেমরা নায়েবে রসূল, আম্বিয়াগনের ওয়ারিশ! ফলে যারা কুরআন-হাদীস মেনে জীবন পরিচালনা করে বা করতে চায়- তারা আলেমদের অযথা অপমান করে না। যোগ্য আলেমগণ আল্লাহকে সত্যিকার অর্থে ভয় করে। আল্লাহর ক্ষমতার ব্যাপার জ্ঞান রাখেন। আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে কোনো সন্দেহের মধ্যে নেই। প্রকৃত আলেম হচ্ছেন ইলমের সেসব বাহক যারা ইলম অনুযায়ী আমল করেন। তাদের কথায় অস্পষ্টতা নেই, ভক্ত-শ্রোতাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় মনভোলানো যুক্তি নেই, বিদআত নেই। তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে কারো সাথে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা রাখে না, ভালো মানুষদের সাথে উঠা-বসা করে, আল্লাহ-রাসূল-সাহাবীদের প্রশংসা করে।
ওয়াজ মাহফিলে মানুষ স্বেচ্ছায় আসে এবং আলেমদের বক্তৃতা শুনার জন্য পকেটের টাকা খরচ করেও শান্তিপূর্ণভাবে উপস্থিত থাকে। কোনোরূপ পার্থিব স্বার্থ ছাড়া এমন স্বতঃস্ফূর্ততা, স্বপ্রণোদিতভাবে ব্যাপক অংশগ্রহণ অন্য সেক্টরের বক্তাদের খুব কমজনের ভাগ্যেই ঘটে! উত্তম আচরণ, সচ্চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে উলামায়ে কেরামদের আলোচনার ফলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষিত হয়, অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে থাকে। যারা অসংস্কৃত ও অসৌজন্যমূলক আচরণ-উচ্চারণ করেন তারা মূলত আলেম নন, আলেমের লেবাসধারী মূর্খ!
ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন মুফতীরা কুরআন ও হাদীস গবেষণা করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যে দ্বীনের কোনো বিষয়ে মতামত দেন। সওয়াব পাওয়ার আশায় দুনিয়ায় বিনিময়হীন কষ্টও নিষ্ঠার সাথে করেন। যারা প্রখর স্মৃতিশক্তি ও তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন জ্ঞানী, পরহেজগার, সুন্নতের অনুসারী- তারা দ্বীনের জ্ঞানকে কাজে লাগান। কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি আবেগ বা ভালোবাসার কারণে পক্ষপাতিত্ব করেন না। অথচ বর্তমানে বক্তার আধিক্য ও এই ধরনের আলেমের স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে।
কিছু বড় বড় বুলি আওড়ানো বিভ্রান্তকারী বক্তারা বিভিন্ন মনগড়া মতবাদ, বিদ‘আত ও তাদের ভ্রষ্টতার বিষ ছড়াচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়ায় হৃদয় গলানো বক্তৃতা, গরম গরম ওয়াজ, সস্তা আবেগী লেকচার বা খেয়ালখুশি মতো মনগড়া ব্যখ্যা দিয়ে জনপ্রিয়তা পেলেই কেউ বড় আলেম বা দাঈ হয়ে যায় না। সহীহ আক্বিদাহ ও ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী চলার নীতিতে অটল-অবিচল থাকতে হয়। কিছু মূর্খও- আলেমের লেবাস ধরে, আলেম সেজে ধোঁকা দেন, ফলোয়ার বা একনিষ্ঠ মুরীদ জোটাতে সচেষ্ট থাকেন, বড় পদ-পদবী-ক্ষমতা দখল করে বসে থাকেন, কোনোমতে সার্টিফিকেট নিয়ে নামের পূর্বে মাওলানা-শায়খ যোগ করেন, যেনতেনভাবে মানুষের মগজ ধোলাই করেন! এদের কথা অন্ধভাবে শোনা খুবই মারাত্মক ব্যাপার!
কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও বোধ অর্জনকারী বিচক্ষণ-আল্লাহওয়ালা আলেমদের সাথে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের বা গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মাধ্যমেই পরবর্তী প্রজন্মের আলেম তৈরী হয়; এসব হাক্কানি আলেমদের কাছ থেকে মানুষ উপকৃত হন। যাদের থাকে- ইসলামের মৌলিক উৎস আল-কুরআন ও আস-সুন্নাহ সম্পর্কে স্পষ্ট-বিস্তারিত জ্ঞান, আরবি ভাষায় যথাসাধ্য দক্ষ হওয়া, ইজ্মা সম্পর্কে কম্প্রিহেন্সিভ জ্ঞান, উসূল আল-ফিকহ সম্বন্ধে ভালো জ্ঞান, মাকাসিদ আশ-শারী’আহ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান, মানুষ ও তার যাপিত জীবন সম্পর্কে সচেতন জ্ঞান। তারা আদালাহ-ন্যায়নিষ্ঠ ও তাকওয়া সম্পন্ন হন, সবসময় সত্য ও ন্যায়ের সাথে থাকেন, দুনিয়ার বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করেন না।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক আলেম-ওলামা মূল্যবান ভূমিকা রেখেছেন। বেশিরভাগ আলেম মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ছিলেন। অনেকে জান বাজি রেখে সরাসরি রণাঙ্গনে সক্রিয় ছিলেন, দেশের জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়েছেন, বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য খেতাবপ্রাপ্তও হয়েছেন। অনেকে নীরবে নিভৃতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে যেতে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ প্রতিটি আযাদী আন্দোলনে দাড়ি-টুপিধারী আলেমগণ সমাজের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছেন। সাধারণ মানুষ ও যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করার জন্যে আলেম সমাজের সংগ্রামী অতীতকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা নির্লজ্জতা ছাড়া কিছুই নয়!