পরিবারবান্ধব হোন, ভালোবাসার মর্যাদা দিন

গৃহ কতটা প্রশস্ত, বড় ও চাকচিক্যময়; তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ গৃহে থাকা মানুষগুলো কতটা সুখী। পরিবার হচ্ছে সঙ্গীতের মতো, কিছু স্বর উঁচু আবার কিছু স্বর নিচু। কিন্তু সবমিলিয়েই একটি চমৎকার সঙ্গীত। পরিবার অতীতের সাথে সংযোগ তৈরি করে এবং ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করে। পরিবারের চেয়ে বেশি খাঁটি ভালোবাসা ও আন্তরিক যত্ন নিতে আর কেউ পারে না। পরিবার প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপহার, সেরা শিল্পকর্ম। পরিবারেই জীবন শুরু হয় এবং যেখানে ভালোবাসা কখনোই নিঃশেষ হয় না। স্বামী-স্ত্রীর মন-মানসিকতা যত উন্নত হবে পারিবারিক স্থিতিশীলতা ততই সুন্দর থাকবে। পরিবারের মৌলিক কাজই হচ্ছে- আর্থিক সমস্যা মিটানো, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন, সন্তানদের দৈহিক ও মানসিক প্রয়োজন মেটানো। দৈহিক চাহিদাগুলো হচ্ছে- খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদি। আর মানসিক চাহিদাগুলো হচ্ছে- স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও নিরাপত্তা প্রদর্শন ইত্যাদি। এসব চাহিদা পূরণে আন্তরিক হোন।

ভালোবাসার মর্যাদা দিন

একজনের কাছে যা তুচ্ছ, তা হয়তো আরেকজনের কাছে সবকিছু, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে ভালোবাসার। হয়তো আমি কাউকে পছন্দ করি না, সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। তার ভালোবাসার মর্যাদা দেয়া আমার দায়িত্ব নয়, কর্তব্যও নয়, সুন্দর মানসিকতার পরিচয়। মানুষ বেঁচে থাকে ভালোবাসায়, মানবসভ্যতা জেগে আছে ভালোবাসায়। ভালোবাসাকে যেন আমরা কখনো তুচ্ছ মনে না করি। ভালোবাসার মর্যাদা দেয়ার জন্য হলেও যেন সব কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও আমরা খুব তুচ্ছ একটা আবদারও  রক্ষা করি। পরিবারে বড়ভাই বা বোনের দায়িত্বই হচ্ছে ছোট ভাই-বোনদের বন্ধু হওয়া, খোঁজখবর নেয়া, সময় ব্যয় করা। যতই ব্যস্ত থাকুন, খোঁজ নিন, খেলুন, মুভি দেখুন, বই পড়ুন এবং আনন্দে কিছু সময় কাটান, তাদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনুন, আরো বলতে উৎসাহ দিন, তারপর সেটা খুব সহজে সমাধান করুন।

একসাথে সময় কাটান

ভাই-বোন বেশি ছোট হলে তার উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা লাগে। ছোট ভাই-বোনের কিছুক্ষণের জন্য দেখাশোনা করলে তাদের কাছে পছন্দের হয়ে উঠবেন। ছোট ভাই-বোনের প্রতি দায়িত্বগুলো আলাদা করে বুঝে নিন, মানিয়ে নিন। আপনি তাদের জন্য কিছু করুন এবং তাদেরকেও আপনার জন্য কিছু করতে দিন, এতে বন্ধন আরো দৃঢ় হবে। শিশুরা বড় কাউকে কিছু উপহার দিতে, বা কোন কাজে নিজের ইচ্ছায় সাহায্য করতে পছন্দ করে। আপনার সাথে আপনার ভাই বোন এর তুলনা করলে তারা হতাশ হয়ে পড়তে পারে। তাদেরকে যত বেশি সম্ভব উৎসাহ দিন, যাতে তারা যেটা ভালো পারে সেটাতে দক্ষতা নষ্ট না হয়। তাদের সামনে উত্তেজিত হবেন না, রাগ দেখাবেন না। একসঙ্গে বসে আনন্দ করুন, গল্প করুন, হাতে হাত ধরে পথ চলুন, খেলনা নিয়ে খেলুন। চিরন্তন ভালোবাসার অন্তরঙ্গ-প্রাণবন্ত হাসি, নিঃস্বার্থ একবুক অনন্ত ভালোবাসার প্রকাশ ঘটান।

খোঁজখবর নিন

মাসে অন্তত একবার পরিবারের সব সদস্যের ভালোভাবে খোঁজখবর নিন। আপনি শহরে কিন্তু পরিবার গ্রামে কিংবা পরিবার দেশে আর আপনি প্রবাসে থাকলে মন চাইলেই তাদের কাছে পাবেন না। তবে  মোবাইলে খোঁজখবর নিতে পারেন, কথা বলতে পারেন, যোগাযোগ করতে পারেন- চাইলে প্রতিদিন। সাধ্যানুযায়ী সরাসরি চেহারা দেখার বা দেখানোর চেষ্টাও করুন; হোক তা সপ্তাহে কিংবা মাসে কিংবা বছরে কিংবা কোনো উৎসবে। ছুটির দিনটি পরিবারের সাথে আনন্দময় করে কাটালে পরবর্তী সপ্তাহে কাজের অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়; সবার মধ্যে সম্পর্ক আরও মধুর হয়। অফিসের ব্যস্ততা ও টেনশন দুটো থেকেই মুক্ত থেকে বাসায় সবার পছন্দমতো রান্না করুন অথবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে একবেলা বাইরে খান। সন্ধ্যায় কোনো আত্মীয়, বন্ধুর বাড়িতে অথবা পছন্দের  কোনো জায়গায় বেড়াতে যান। মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতেও বন্ধুদের চায়ের আমন্ত্রণ করতে পারেন। ছুটির দিনে মান-অভিমান বা মনোমালিন্য করে সময় নষ্ট করবেন না। পরিবারে বয়স্ক কেউ থাকলে ছুটির দিনে সময় দিন, আর বেড়াতে যাওয়ার সময় তাকেও সাথে নিন।

নতুন জীবনে সতর্কতা

বিয়ের পরে নারী ও পুরুষের জীবনের নতুন একটা দিক খুলে যায় ঠিকই তাই বলে পরিবার বিশেষ করে বাবা-মাকে অবহেলা করা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। শ্বশুরবাড়ি আর বাবার বাড়ির পরিবারের সকলকে একসাথে মেইনটেন করা খুব সহজ কাজ নয়। ভাই-বোনকে কখনো নিজেদের থেকে আলাদা করবেন না। ভাই-বোনের সাথে কথা বলুন, আগে নিজেরা যেভাবে গল্প করতেন তেমনই ফোনে বোনের সাথে মাঝে মধ্যে কিংবা বাসাতেই ভাই-ভাবীর সাথে আড্ডা দিন।

মাঝে মধ্যেই হুটহাট করে ভাই-বোনেরা মিলে বাহিরে কোথাও ঘুরে আসুন। ব্যক্তিগত সমস্যা থাকলে একে অপরের সাথে শেয়ার করুন, একসাথে সমাধান করার চেষ্টা করুন, কখনোই নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে দেবেন না। মাঝে মধ্যে কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই বোনের শ্বশুরবাড়ি ঘুরতে চলে যান বা ভাই-ভাবীর জন্য এমন কিছু করুন যাতে তারা খুশি হয়। কোন ছুটির দিনে পরিবারের সকলে একত্র হন, অনেক গল্প করুন বাবা-মা, ভাই-বোনকে সময় দিন। ভাই-বোনেরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে।

অধিকার আদায়ে যত্নশীলতা

পারিবারিক সম্প্রীতি সৃষ্টিকারী স্থিতিশীল বিবাহের জন্য স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেককে পারস্পরিক অধিকার আদায়ে যত্নশীল হতে হবে। পিতার অধিকার সন্তানের সদ্ব্যবহার পাওয়া, সন্তানের অধিকার পিতার কাছ থেকে সুন্দর প্রতিপালন ও উত্তম দীক্ষা লাভ করা। স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকার হলো, ভরণ-পোষণ লাভ করা এবং স্ত্রীর ওপর স্বামীর অধিকার হলো পরিবারের ওপর তার কর্তৃত্বকে সম্মান জানানো। কথা ও কাজে সুন্দর ও কোমল আচরণ করা এবং কঠোরতা ও রূঢ় আচরণ না করা।

পুরুষের কর্তব্য হলো স্ত্রীর সাথে সদাচরণ করা, তার খারাপ আচরণে ধৈর্য় ধারণ করা, নেতিবাচক দিকগুলোর সাথে সাথে ইতিবাচক গুণগুলোও দেখা; স্ত্রীর মধ্যে অপছন্দনীয় কোনো কিছু লক্ষ করলে দ্রুত তাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত না নেওয়া। নারী কর্তৃক পুরুষের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার মানে হলো, ন্যায়সংগত বিষয়ে আনুগত্য করা, যেন দুজনের জীবনতরী নিরাপদে চলতে পারে। পুরুষেরও উচিত পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করা এবং তার চিন্তা-ভাবনায় স্ত্রীকে শরিক করা। নারীর কর্তব্য হলো, ছোটো-বড়ো সবকিছু নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত না হওয়া।

স্বামী-স্ত্রীর উচিত ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণগুলো প্রশ্রয় না দেওয়া। প্রত্যেকের উচিত একে অপরের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা। পুরুষ বিয়ের আগে দুই চক্ষু পরিপূর্ণভাবে খুলে রাখবে এবং বিয়ের পর তার চোখ অর্ধেকটা মুদে রাখবে অর্থাৎ স্ত্রীর ছোটোখাটো দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে চলবে ও ক্ষমা করবে। তুচ্ছ কারণে তালাক দিবে না।

স্থিতিশীল বিবাহ বন্ধন

উত্তম পরিবার মাত্রই স্থিতিশীল বিবাহ বন্ধনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। পারস্পরিক মায়া-মমতা-ভালোবাসা-দয়া-প্রশান্তি সৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক জীবনের স্থিতিশীলতার জন্য বিয়ে একটি মৌলিক উপাদান। বিয়ের মাধ্যমে প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং মনের চাহিদা সংযত হয়। সঠিকভাবে জীবনসঙ্গী নির্বাচন সুখী দাম্পত্য জীবন ও স্থিতিশীল পরিবার গঠনের জন্য সর্বপ্রথম পদক্ষেপ। যে বিয়ে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ, আর্থিক কিংবা অন্য কোনো বাধ্য-বাধকতা ছাড়া স্বাধীনভাবে সম্পন্ন হয়, তাকেই স্থিতিশীল ও সুষ্ঠু বিবাহ বলে। উত্তম সঙ্গী নির্বাচনের মাপকাঠি হবে না শুধুমাত্র সম্পদ ও দৈহিক সৌন্দর্য, অবশ্যই উত্তম চরিত্র-বুদ্ধি-বিবেক ও মনের মিলকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আত্মাসমূহের মাঝে মিল থাকলে পারস্পরিক ভালোবাসা-মহব্বত সৃষ্টি হবে, আর অমিল থাকলে অনৈক্য দেখা দিবে। কথাবার্তা ও আচার-আচরণে একে অপরকে বুঝা যায়। পরস্পরকে ঘনিষ্ঠ, পরিপূরক ও নিজের অংশবিশেষ তখনই মনে হবে যখন অর্থ, মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, বয়স ও সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে নিজের উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী খুঁজে নেওয়া সম্ভব হবে।

কৃতজ্ঞ হোন

ব্যক্তিস্বার্থের দাসদের অন্তর মৃত, বন্ধন ছিন্ন, হৃদয়গুলো বিচ্ছিন্ন, মন বিক্ষিপ্ত-উদভ্রান্ত; তারা আধিপত্য দেখাতে মরিয়া, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভোক্তায় পরিণত। প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা ও মুক্তবাজারের অবাধ চর্চা প্রতিনিয়ত ভোগের জন্য উৎসাহিত করছে। নেতিবাচক কথা ও কর্মের ব্যাপকতর চর্চা এবং ভালো-গঠনমূলক কথা-কাজের কম চর্চা বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্ব পালনের অন্তরায়। মানুষকে সাহায্য করে ধন্যবাদ পাওয়ার অপেক্ষা করবেন না। একটি অনুগ্রহের বদলে আরেকটি উপকার পাবার আশা করবেন না। অপ্রাপ্তি নয়, প্রাপ্তি ভেবে কৃতজ্ঞ হোন।

কারো ব্যাপারে কোনো খারাপ কথা বলা বা রাগের মাথায় কারো দুর্নাম করা পরিহার করুন। একটি ভুল হলে শতটি সঠিক কাজ করুন। কাউকে সাহায্য করতে পারলে সেই আপনাকে  পুণ্য হাসিলের সুযোগ দিয়ে দয়া-করুণা করছে ভেবে কৃতজ্ঞ-তৃপ্ত হোন। প্রত্যেকেরই প্রয়োজন খাবার, আশ্রয়, সুরক্ষা ও জীবিকা; তাই স্রষ্টা অনুগ্রহ করে কোনো উসিলায় এসব দিলে লজ্জায় ফিরিয়ে দেয়া ঠিক না। বিনিময়হীন স্বেচ্ছায় করা কাজেরও অফুরন্ত বিনিময় স্রষ্টা দিতেই পারেন। আপনার জীবনে যত ভালো অভিজ্ঞতা আছে ও আপনি জীবনে যত ভালোবাসা উপভোগ করেছেন সবই ভালোবেসে স্রষ্টার দেয়া উপহার।

অপব্যয় করা, সীমার বাইরে খরচ করা, টাকা-পয়সা নষ্ট করা, বেহিসেবি খরচ করা, প্রয়োজন ছাড়াই অনবরত কিনতে থাকার অভ্যাস থাকলে এসব অধিকার পূরণে ব্যয়ের বোধ জাগ্রত হয় না। চটকদার জিনিসপত্র ও নিছক আনন্দ-বিনোদনের পেছনে বেসামাল পয়সা খরচ করা, অর্থহীন বাজে কাজে ব্যয় করায় সমাজের মূলে শিকড় বিস্তার করতে পারে ভোগবাদী-পুঁজিপতিরা। বিরামহীন ভোগবাদিতা, লাগাতর অতৃপ্তি-অপূর্ণতাবোধের চর্চা ও কেনাকাটাপ্রিয়দের  কেনার জন্য নেশাগ্রস্ততার ফলে মনে অসন্তোষ ও অকৃতজ্ঞতার বীজ বপন হয়; যা লোভী ও অকৃতজ্ঞ বানায়ে ফেলে। সচেতনভাবে কৃতজ্ঞতার চর্চা বাড়ান।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *