পরামর্শের সাতকাহন ও মুই কি হনুরে ভাব!

অযোগ্যরা বড় ভাব নেয় নিজের দুর্বলতা ঢেকে রাখার জন্যেই! যেন ছাল নাই এমন কঙ্কালসার কুত্তার বাঘা নাম! অনুপযুক্ত কারো কারো অবস্থা হয় এমন যে, খালি কলসি বাজে বেশি! বলেন বেশি করেন কম! নিজে কম বুঝে অন্যকে বেশি বুঝাতে চাওয়ার মতো বিড়ম্বনা আর নেই!

সুইয়ের ছিদ্র দিয়ে উট ঢুকা যেমন সম্ভব নয় তেমনি থার্ড ক্লাস লোক দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস কাজ করানো সম্ভব নয়। যেখানে ছিদ্রান্বেষণকারীদের জয়জয়কার; সেখানে চালুনি বলে সুঁইকে, তোর পাছায় কেন ছিদ্র! আসলে চালুনি যখন বলে সুচ, তোর কেন এত বড় ফুটো; তখন সুচ কিইবা বলবে!

বিদ্বেষে ভুগা ব্যক্তি বিদ্যাবুদ্ধি ও পাণ্ডিত্য থাকলেও ঐক্যে ভাঙন ধরায় এবং নিজে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। চোরের মায়ের যেখানে বড় গলা, সেখানে ছুঁচের বিচার করে চালুনি। এক শিয়ালে হুক্কা হুয়া ডাক দিলে অনেক শিয়ালে সাড়া দেয়; শেয়ালের রাজ্যে শেয়ালই সেরা! যেখানে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে চালানো যায়, সেখানেও কিছু সাফল্য কাকতালীয়ভাবে আসে! তখন ঝড়ে বক মরে আর ফকিরের কেরামতি বাড়ে!

তেলবাজদের আসল রূপ প্রকাশ পায় একটু দেরীতে! কাকের মাংস কাকে খায় না, ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। অথচ তেলবাজদের স্বার্থপরতা এমন যে, তারা মানুষ হয়েও অন্য মানুষের ক্ষতি করতে পিছপা হয় না। এদের আস্ফালন বেশি! নিয়ন্ত্রণে আগ্রহ বেশি! সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ায় বিশ্বাসী। শিকারী বিড়ালকে গোঁফে চেনা গেলেও এদেরকে চেনা যায় না; কারণ এরা বিড়াল হয়েও বাঘের ভাব নেয়।

অন্যকে ভুল পরামর্শ দেয়ার চেয়ে পরামর্শ না দেয়া ভালো। অনেকেই অন্যকে সুচিন্তিত ও সঠিক পরামর্শ দিয়ে তৃপ্তিবোধ করেন। মানুষ আইনী পরামর্শের জন্য আইনজীবীর কাছে যান, স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শের জন্য চিকিৎসকের কাছে যান। মানুষ যার পরামর্শকে গুরুত্ব দেন তার পরামর্শ নিতে খরচ করার বা ত্যাগ করার মানসিকতাও পোষণ করেন!

যে যে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ; সেই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার মতামত-পরামর্শ যে কেউ নিতেই পারেন। কিন্তু জরুরি পরামর্শ, ভালো পরামর্শ, গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ কিংবা প্রয়োজনীয় পরামর্শের কথা বলে যে যে ব্যাপারে কথা বলার যোগ্যতাই রাখেন না; সে সেই ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দেয়ার তাগিদ অনুভব করেন। পরামর্শের গুরুত্ব অনেক, তবে পরামর্শ যথাযথ পদ্ধতিতে হতে হবে।

কখনো চা চক্রে বসে অনেকে সরকারকেও পরামর্শ প্রদান করেন, বাইডেন-পুতিন-শি জিনপিংকেও তুলোধুনো করেন, কখনো খেলার মাঠেই নামেননি সেও মেসি-রোনালদো-সাকিবের ভুল ধরেন; অথচ তার পরিবারের লোকজনও তার পরামর্শ মানে না। পরামর্শ দেয়ার আগে যিনি পরামর্শ দিচ্ছেন তারও ভাবা দরকার এই পরামর্শ দেয়াটা কী শোভনীয় বা মানানসই কি-না!

ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেটের কল্যাণে মিডিয়া লিটারেসি না থাকায় অনেকে বিশেষভাবে অজ্ঞদের বিশেষজ্ঞ মনে করে তাদের পরামর্শ মেনে বিপদে পড়ছেন! অর্থহীন পরামর্শে সময় বেশি ব্যয় করা মানে, কাজের জন্য মূল্যবান সময় কমে যাওয়া!

নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য মানার চেয়ে অন্যের কাছে পান্ডিত্য জাহির করার অভিপ্রায়ে অযাচিত পরামর্শ দেয়া সার্বিক ক্ষতি বয়ে আনে। প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত পরামর্শ, লাইভ ফোন পরামর্শ, কারিগরী সহায়তা পরামর্শ, পরিবারের জন্য পরামর্শ, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরামর্শ, আইন বিষয়ক পরামর্শ; পরামর্শের শেষ নেই। যে যে ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছেন; সেও সে ব্যাপারে অন্যকে সফল-সার্থক করতে পরামর্শ দেন।

সরাসরি পরামর্শ কিংবা অনলাইনে পরামর্শ- যেটিই হোক দেখতে হবে, পরামর্শ গঠনমূলক বা উপদেশমূলক কি-না! পরামর্শের ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা দরকার- কোন ব্যাপারে কে পরামর্শ দিচ্ছেন? যিনি পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি আদৌ সেই পরামর্শ দেয়ার উপযুক্ত কি-না? কি পরামর্শ দিচ্ছেন? সে পরামর্শ মানার ভবিষ্যত ফলাফল কী হতে পারে?

মাছ চাষের পরামর্শ যিনি জীবনে কখনো মাছ চাষ করেননি তিনিও প্রায়োগিক-ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়া দিতেই পারেন। যে কেউ স্বাধীনভাবে পরামর্শ দিতেই পারেন, মতামত জানাতেই পারেন; তাই বলে সব পরামর্শ সমান গুরুত্ব পায় না । যারা না চাইলেও পরামর্শ দেন, পরামর্শ দিতে দিতে বিরক্তির উদ্রেক করেন; তারা আসলে কী বিবেচনা করেন? সতর্কতা নেই, পর্যবেক্ষণ নেই, তাত্ত্বিক জ্ঞান নেই, চর্চা নেই; অথচ পরামর্শ দিচ্ছেন।

এই যে ডিমান্ডের চেয়ে পরামর্শের বেশি সাপ্লাই; এর পেছনে রয়েছে কাণ্ডজ্ঞানের অভাব ও সীমাহীম মূর্খতা। নিজে না জেনে-বুঝে অন্যকে গাইড করা বিপদজনক প্রবণতা, নিজের কাজে ভুল-ত্রুটির মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে অন্যকে শোধরানো-সংশোধনের প্রচেষ্টা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যক্তিগত আচরণ বা সিদ্ধান্ত ভুল হলে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু নির্বোধ সেই ভুলকে মূল্যবান অভিজ্ঞতা মনে করে অন্যের উপর চাপালে ক্ষতির মাত্রা বাড়তে থাকে।

পরামর্শ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরামর্শদাতা ব্যক্তির অবস্থানের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়। কিছু কিছু পরামর্শদাতা ভালোবেসে উপকার করতে গিয়ে ক্ষতি করেন বা ভুল বিবেচনা শিখিয়ে বিপদে ফেলেন। যখন পরামর্শ গ্রহীতা নিজে পরামর্শের ফলাফল পেয়ে পরামর্শদাতাকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে শুরু করেন; ততদিনে সময় অনেক বয়ে যায়, ক্ষতিও অনেক হয়ে যায়, ক্ষতি আর পুষিয়ে নেয়া যায় না।

পরামর্শ দেয়াটা যেমন কল্যাণকর, তেমনি পরামর্শ না দেয়াটাও অনেক ক্ষেত্রে কল্যাণকর। অন্যকে সুন্দর সুন্দর পরামর্শ দেয়ার আগে নিজের চর্চা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আর বাছ-বিছার না করে পরামর্শ গ্রহণের পরিণতিও ভালো হয় না।

পরামর্শ হতে হবে যুক্তিসম্মত ও সুস্পষ্ট। পরামর্শদাতার থাকতে হবে সুবিবেচনা ও বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতা। উপদেশ দিয়ে বড় হওয়া কিংবা উপদেশ গ্রহণ করে উপকৃত হওয়া- দুইক্ষেত্রেই চিন্তা-ভাবনা করা জরুরি। কোনটি কুপরামর্শ, কোনটি কুমন্ত্রণা, কোনটি মন্দ পরামর্শ, কোনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত- তা বুঝতে হবে।

অহিতকর কার্য করার জন্য শলা বা যুক্তি বা অনিষ্টকর উপদেশকে পার্থক্য করতে পারতে হবে। পরামর্শ কখনো পরোক্ষভাবে হতে পারে, কখনো প্রত্যক্ষভাবে হতে পারে। হতেই পারে পরামর্শ ভাল; হতেই পারে পরামর্শ সহায়ক! পরামর্শ করতেই পারেন, তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনাকে কাজে লাগাতে হবে।

About আনিসুর রহমান এরশাদ

শিকড় সন্ধানী লেখক। কৃতজ্ঞচিত্ত। কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। ভেতরের তাগিদ থেকে লেখেন। রক্ত গরম করতে নয়, মাথা ঠাণ্ডা ও হৃদয় নরম করতে লেখেন। লেখালেখি ও সম্পাদনার আগ্রহ থেকেই বিভিন্ন সময়ে পাক্ষিক-মাসিক-ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন, সাময়িকী, সংকলন, আঞ্চলিক পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ ও জাতীয় দৈনিকের সাথে সম্পর্ক। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা, গবেষণা, লেখালেখি ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। পড়েছেন মিডিয়া ও জার্নালিজমেও। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা গ্রামে।

View all posts by আনিসুর রহমান এরশাদ →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *