সাধারণত বাঙালি ব্যবসায়ী হতে চায় না, চাকরিজীবী হতে চায়। ঝুঁকি নিতে চায় না। সহজে জীবনকে চালিয়ে নেয়ার রাস্তা খুঁজে। যখন চাকরি করার সুযোগ থাকে না তখন উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করে। সবার ক্ষেত্রে না হলেও অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এই ধরণের প্রবণতা দেখা যায়।
সামাজিক অবস্থা এমন যে, পারিবারিক ব্যবসায়িক পরিবেশ না থাকলে খুব কমজনই ব্যবসায়ী হবার মানসিকতা ধারণ করেন। কর্পোরেট জগতে বা চাকরির বাজারে জায়গা খুঁজে নিতে সক্ষম করে তোলতেই সিলেবাসগুলোকে সাজানো হয়।
সিলেবাসই এমন কেউ ব্যবসায়ী হতে উদ্বুদ্ধ হয় না, সৃষ্টিশীলতা বা সৃজনশীলতার সুযোগও থাকে না, সুকুমার বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার আবহও থাকে না। ফলে ঝুঁকি নিতে যে সাহসিকতার প্রয়োজন হয় তা থাকে না। ব্যবসার জন্য কারবারি বা জুয়াড়ি মানসিকতা নয়, দরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ।
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেই বাঙালি উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে অক্ষম। পরিমিত মাত্রার ঝুঁকি গ্রহণসাপেক্ষে উদ্যোগ গ্রহণেও তাদের আপত্তি! পরিবারকেন্দ্রিক পরিবেশ থেকে আসা কারবারে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বাধ্য হয়।
নতুন আইডিয়ার জন্য মনোবৈকল্য থেকে মুক্ত হতে হয়। গোলামির মনোবৈকল্য ব্যবসার মতো স্বাধীন পেশার স্বপ্ন দেখার অন্তরায়। উদ্যােগ বাড়াতে হলে উদ্ভাবনী করে তুলতে হবে। সমালোচনার ঝড় না তুলে আলোচনায় আসতে হবে।
যারা নিজেরাই নিজেদের পাত্তা দেয় না, তাদের বিদেশিরা পাত্তা দেবে কেন! চরিত্রেই যদি থাকে মিথ্যা বলা, ভীরুতা, মামলাবাজি, প্রবঞ্চনা! বাজে বৈশিষ্ট্যের চরিত্রে মানুষ আস্থা রাখবে কেন! চারিত্রিক দুর্বলতা যে সবার এমন নয়, তবে অধিকাংশের।
যারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, রীতিমত পরিহাস করে, স্বীকৃতি না দিয়ে নানা সমালোচনা-ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, পীড়ন-শোষণ-নির্যাতন চালায়; সামান্য লোভে একটু স্বার্থেই তাদেরও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখা যায়। এরা মূল্যবান অর্জন কম দামে বিসর্জন দেয়। লজ্জার ব্যাপারকেও গৌরবের মনে করে।
ভোগবাদী ও অলসরা শাসিত হতেই পছন্দ করে। চরিত্রে নিহিত ফাঁকিবাজি, ধান্ধাবাজি; সম্মানজনক জীবিকা নিশ্চিত করে না। বাঙালি নিরুপায় হলে হাড় ভাঙা খাটুনি খাটবে, কল্পনাবিলাসী হবে, জীবিকার্জনে ভিক্ষা বা চৌর্যবৃত্তি বেছে নেবে অথচ স্বাবলম্বী হতে পরিশ্রম করবে না।
কাঙালপনা, ধূর্ত বুদ্ধি, অতিলোভ ও অতি উচ্ছ্বাসের কারণে যৌথ কাজে সফলতা আসে না। নিঃসঙ্গ সুযোগসন্ধানী চরিত্র তাকে দাম্ভিক-অহংকারী বানিয়েছে। নিজের মতো করে ধর্ম পালন করে, তর্ক করে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য, যুক্তি দেয় নিজেকে সেরা প্রমাণের জন্য।
এটা ঠিক সবাই চাটুকার নয়, সব চরিত্রই তোষামুদে ভরপুর নয়। তবে অনেকেই চাতুর্যতার আশ্রয় নেয়, চরম সুবিধাবাদী ও শুধুই সুযোগসন্ধানী! স্বার্থের প্রয়োজনে তোয়াজ করে, একটু লাভের আশায় তদ্বির করে! দেখা যায় আত্মসম্মানবোধের অভাব, মিথ্যের আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা, কপটতা, বিবেকহীনতা, ভাঁড়ামি ও ভণ্ডামি।
অথচ বড় উদ্যোক্তা হতে বড় মন লাগে। খুব ছোট মন বড় স্বপ্ন দেখতে পারে না, বড় চিন্তা করতে পারে না। ভীষণ রকমের বাচালতা আছে, অপ্রয়োজনেও কথা বলার প্রবণতা আছে, প্রচুর ভুল শব্দ ব্যবহারের অভ্যাস আছে, এক কথার মাধ্যমে অন্য কথা বুঝাতে চাওয়ার চেষ্টা আছে।
অহমিকা আছে, নিজেকে বড়ো ভাবার ব্যাধি আছে, মানসিক দৈন্যতা আছে, সংকীর্ণতা আছে, কূপমণ্ডুকতা আছে। পরোপকার করলে খোটা দেয়, উদারতা দেখায় প্রশংসা পেতে, আন্তরিকতা দেখায় মহত্ত্ব বুঝাতে, বিনয়ী হয় হৃদয় কাড়তে। পরিশ্রমী না হয়ে উচ্চাভিলাষী হয়, মনুষ্যত্বের প্রসার না ঘটায়ে তেল আদান-প্রদানে নিয়োজিত হয়।