সব চাকরিপ্রার্থীরই মাথার মধ্যে থাকে চাকরিতে একটা সুন্দর পরিবেশ পাবো, সম্মানজনক কাজ পাবো, ভালো বেতন পাবো। যোগদানের পর অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়- নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বাড়তি সময় কাজ করতে হয়, বেতন ঠিকমতো হয় না, সরকারি ছুটির দিনেও কাজ করিয়ে নেয়া হয়। যেখানে ইনক্রিমেন্ট ঠিকমতো হয় না, বোনাস ঠিকমতো হয় না, প্রমোশন ঠিকমতো হয় না; সেখানেও বেসরকারি চাকরিজীবীদের সবসময় সচল থাকতে হয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু কিছু চাকরিতে বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করিয়ে নেয়া হয়। তারা সকালে কাজে যাওয়ার সময় বাচ্চা ঘুমায়, রাতে এসেও দেখে বাচ্চা ঘুমায়। অনেকেরতো চোখে ঘুমই যেন থাকতে নেই! সারারাতও কল আসতে থাকে! নাইট শিফট ছাড়াও গভীর রাত পর্যন্ত কাজ চলে। কিছু কিছু চাকরিজীবীদের ঈদের দিনও অফিসে থাকতে হয়। কাজের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চটুকু দেয়ার পরও কর্তৃপক্ষের কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুললে তা তাদের ভালোলাগে না।
অধিকাংশ বেসরকারি চাকরিতে টাকা পাওয়া যাবে, কিছু ক্ষেত্রে সম্মানও পাওয়া যাবে কিন্তু নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না। নিজের বস নিজে হওয়া যাবে না। নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজে করা যাবে না। আয় হবে সীমিত। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করে ভালোলাগার অনুভূতিও পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা অনেক চাকরিতে সৃষ্টিশীল চিন্তা, সমস্যা সমাধান করা ও যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানোর মতো প্রশিক্ষণের সুযোগ মিলবে না! উচ্চশিক্ষা ছুটি বা মাতৃত্বকালীন প্রয়োজনীয় ছুটি দিবে না।
চাকরিজীবীদের মধ্যে বেতন বাড়া সবচেয়ে বেশি আনন্দের ব্যাপার। যথাযথ কাজ করার পরেও বা অতিরিক্ত পরিশ্রমের পরেও চাহিদা মতো বেতন না বাড়াটাও বিরক্তির। অনেকে চাকরির পাশাপাশি অন্য কোনো সাইট ব্যবসায় জড়িত হন; তবে এক্ষেত্রে নিজে সময় দিতে না পারায় অন্যদের সহযোগিতা নেয়ার প্রয়োজন পড়ে।
এক শ্রেণির চাটুকার চাকরিজীবী আছে। যারা উর্ধ্বতনদের প্রশংসা করেন, অধঃস্তনদের সমালোচনা করেন, দুর্বলতার সুযোগ নেন এবং সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে রুপ পাল্টান। দালালরা সাহসী নন তবে মানসিকভাবে সংকীর্ণ ও গরিব। কখনো কখনো উঁচু গলায় কথা বলে, অন্যদের অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না, অযাচিত হস্তক্ষেপ করে, যুক্তিতে কখনো পরাজিত হয় না, চক্রান্ত করতে পারে, মিথ্য বলাকে চাতুর্য ও উৎকর্ষ মনে করে, এক কথা বারবার বলে, নতুনত্ব এড়িয়ে চলে, অন্যের মতামতকে সম্মান করে না।
মালিকদের সাথে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন এমন চাকরিজীবীদের অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। নিজেকে বেশি ক্ষমতাশালী হিসেবে তুলে ধরতে অন্যদের সাথে অভদ্র আচরণ করেন, সুবিধা আদায়ে অভিনব ফন্দিফিকির করেন, আগন্তুক এলে করুণা করতে চান, যতটা কর্মব্যস্ত তার চেয়ে বেশি ব্যস্ততার ভান করেন, অন্যকে ছোট করতে নানা বাহানা করেন, নিজে বড় হবার চেষ্টায় ছল করেন, সুবিধা আদায়ে অনুনয়-বিনয় করেন, অচেনা মানুষকে নিজের থেকে ছোটো মনে করেন, সুব্যবহার না করে অন্যকে অপমান করেন।
অনেক চাকরিজীবী আছেন যারা অন্যকে সৎ হতে বলেন; তবে নিজে অসৎ উপার্জন ছাড়েন না। চরিত্রহীন বা দুশ্চরিত্র বলতে শুধু পর নর-নারীতে আসক্ত বুঝেন; ঘুষ খাওয়া, সুদ খাওয়া, পরনিন্দা বা গীবত করা, কপটতা, মিথ্যাচার, খুন করাকে চরিত্রহীনের লক্ষণ ভাবেন না। এরা মালিকের কোনো ত্রুটি দেখে না, সমস্ত অন্যায়কে মেনে নেয়। যা মুখে বলে বা প্রকাশ করে, তা করে না। পিছনে নিন্দা করলেও মুখোমুখি হলে শক্তিমানকে তোষামোদ করে।
খুব সামান্য আয়ের অনেক চাকরিজীবী দরিদ্র হলেও অর্থ অপচয় করে, অপব্যয় করে; সময় নষ্ট করে। সিগারেট খেয়ে, জর্দাসহ পান খেয়ে শরীরের ক্ষতি করে। চা স্টলে গল্প করে সময় অপচয় করে। সময়বোধ এমন পাঁচটা বললে বোঝায় ছ’টা-সাতটা। কাউকে সময় দিলে ব্যস্ততার কারণে কথা ঠিক রাখতে পারে না, আর দু-এক ঘণ্টার হের-ফের করাকে অস্বাভাবিক মনেই করে না।
মাঝারি মানের চাকরিজীবীদের অনেকে বড় চিন্তা এবং বড় কাজ করতে সক্ষম দেখাতে সচেষ্ট থাকেন। তারা যতটা না উদ্ভাবক, তার চেয়ে বেশি উদ্ভাবনগুলো ঋণ করে নিজের বলে চালিয়ে দেয়ায় পারঙ্গম। ঘৃণা পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করেন, ভুলকেও ঠিক মনে করেন। অনেক কিছুই ঋণ করেন ধার করেন, কিন্তু স্বীকার করেন না। সম্মান- মর্যাদা পাওয়ার উপযুক্তকেও অবহেলা করেন, মরে গেলে লাশে ও কবরে ফুল দিয়ে উপেক্ষা করার মনোপীড়া কমান। ক্ষমতাবানদের চারপাশে ঘুরঘুর করেন, ক্ষমতাহীনদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন।
উঁচুস্তরের অনেক চাকরিজীবীদের মধ্যে অর্থলিপ্সা প্রবল। দলাদলি আছে, বিশ্বাসঘাতকতা আছে, পরশ্রীকাতরতা আছে। দুর্বলতা আছে, ভীরুতা আছে। মনস্তত্ত্বে ঘৃণা, আক্রোশ, হিংসা, জিঘাংসার মতো তীব্র নেতিবাচক প্রবণতা প্রবলভাবে সক্রিয় থাকলে উত্তম-অধম বলে ভেদাভেদ থাকে না! পরের ত্রুটি নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা দেখালেও আত্মসমালোচনায় নজর থাকে না, নিজে কাজে ফাঁকি দিয়েও অন্যকে দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিবেদিত হবার পরামর্শ দেন।
ক্ষমতাবানদের সাথে যোগসাজশ বেশি এমন অনেক চাকরিজীবী দলাদলিতে লিপ্ত, ঈর্ষাকাতর, ক্ষুদ্রতায় জীর্ণ। এরা সবাইকে একসাথে নিয়ে পথ চলতে পারে না, সহকর্মীকেও বিশ্বাস করতে পারে না, অন্যের নেতৃত্ব মন থেকে স্বীকার করতে পারে না এবং যৌথ উদ্যোগ সফল-সার্থকভাবে এগিয়ে নিতে পারে না। এদের অযোগ্যতা ও অক্ষমতা আছে, তবে অনুশোচনা-অনুতাপ নেই। নিন্দাবাদ করে, চালাকি করে, ফাঁকি দেয়, দাসের মতো নিয়ম মানে, অন্যকে বিশ্বাস করে না, তর্কে জিততে জোর করে।
অন্যের চেয়ে আমার শক্তি বেশি-এই বোধই অনেক চাকরিজীবীকে অহংকারী করে। এরা শক্তির দম্ভ প্রকাশ করে, আত্মশাসন করে না। ভুল চর্চা আর ভ্রান্ত আচরণও আত্ম-অহমিকার কারণে সঠিক বলে প্রমাণ করে। দুর্বলের জন্য এদের হৃদয়ে কোনো মমতা নেই; সবলের জন্য এরা খুব উদার। অপচয়িত মেধা, কলুষিত হৃদয়, দুর্বৃত্তদেরও অনেক সময় প্রশ্রয় দেয়। আত্মসাৎ করা ঠেকাতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন হৃদয় পরিবর্তন। হৃদয়-উৎসারিত ভালো ব্যবহারই আনতে পারে মানসিক প্রশান্তি।
প্রথম প্রথম চাকরি পাবার পর সাধারণত খুব কম জনেরই রয়ে সয়ে চলার বোধজ্ঞান থাকে। প্রিয়জনদের উপহার দেয়া, এতদিনের নানা অপূরণীয় শখ পূরণ করা, কম প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় খরচ করা, ভালোলাগার কাজ ও মানুষের পেছনে ব্যায় বাড়িয়ে দেয়ায় সঞ্চয় হয় না; ভবিষ্যত হয় একদম ফকফকে সাদা।
এদেরকে সঞ্চয়ের কথা বললে তাকে কৃপণ-বখিল-অতিহিসাবীর মতো নানা নেতিবাচক বিশেষণে বিশেষায়িত করতে থাকে! এই ঘোরটা সম্পূর্ণ কাটে কারো বিয়ের সময় আবার কারো বিয়ের পর! কখনো চাকরিচ্যুত হলে বা কারো অসুস্থতায় ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তারা সঞ্চয়ের প্রয়োজন অনুভব করে। তবে তখন অনেক বেলা কেটে যায়!
রুগ্ন চাকরিজীবী সমাজকে সুচিকিৎসা দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান দিতে এগিয়ে আসতে পারে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা। তবে চাকরিজীবী, চাকরিপ্রার্থী, চাকরিদাতা- সবারই মন-মানসিকতা-দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা থেকে নেতিবাচকতাকে বিদায় দিতে না পারলে এবং ইতিবাচকতায় পরিবর্তন করতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সেজন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, আন্তরিক উদ্যোগ ও সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।