নিরবচ্ছিন্নভাবে মনোযোগ দিয়ে সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু সময় কাটানো কোয়ালিটি টাইম। অনেক মা-বাবা বলেন, ‘আমি তো চাকরি করি না, সারা দিন তো শিশুকে নিয়েই আছি।’ মনোযোগে বিভক্তি নিয়ে সারা দিনে দেওয়া সময় ও কোয়ালিটি টাইমের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোয়ালিটি টাইম খুব স্বল্প সময়ের হলেও মানুষের মনোযোগের চাহিদার অনেকখানি পূরণ করতে পারে, যা কি না সারা দিন স্বাভাবিক সময় দিলেও পূরণ হতে চায় না। কেননা সারা দিন আমরা নানা কাজ করি এবং সেই সঙ্গে পরিবার বা সন্তানদের নিয়েও ব্যস্ত থাকি। অর্থাৎ কোয়ালিটি টাইমে শতভাগ মনোযোগ শুধু পরিবার বা সন্তানদের দিতে হয়।
গুরুত্ব
স্বামী-স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে থাকলে তখন সময়টা কেবল তাদের জন্যই বরাদ্দ রাখা দরকার। এতে সন্তানদের কখনো এটা মনে হবে না যে মায়ের বা বাবার কাছ থেকে তাদের যে সময়টা পাওয়ার কথা তাতে মা-বাবার অফিসিয়াল কাজ ভাগ বসাচ্ছে। কখনোই পেশাগত কাজ করতে করতে তাদের সময় দেয়া ঠিক না বরং তাদের সঙ্গে যখন থাকবেন তখন কেবল তাদের সঙ্গেই থাকবেন। এতে তারাও বুঝতে পারে যে তাদের মা-বাবার জন্যও তারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এতে মা-বাবার প্রতি সন্তানদের এক ধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়।
শিশুদের মনোযোগের চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ না হওয়ার কারণে নানা রকম আচরণগত সমস্যা হয়। কোয়ালিটি টাইম দিলে শিশুদের মধ্যে মা-বাবার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কোনো নেতিবাচক আচরণ করার প্রবণতা কমে যায়। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের বন্ধন অনেক দৃঢ় হয় এবং সেই সঙ্গে শিশুদের রাগ-জেদ-অন্যায় আবদার ইত্যাদির পরিমাণও অনেক সময় বেশ কমে যায়।
কর্মজীবী নারী
কর্মজীবী মা-বাবা ও একক পরিবারের শিশুদের যথাযথ বিকাশের জন্য কোয়ালিটি টাইম খুব প্রয়োজনীয়-অত্যাবশ্যকীয়। কর্মজীবী স্ত্রীও যদি স্বামীকে কোয়ালিটি টাইম দেন তবে দুজনের সম্পর্কটা আরো গভীর হয় ও মতের মিল বাড়ে। একজনের প্রতি আরেকজনের ভালোবাসার আস্থা দৃঢ় হয়। স্বামী ও সন্তানদের সময় দেওয়ার সময় অন্য কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন। টিভি দেখা, ল্যাপটপ বা মোবাইলে কোনো কাজ করা বা অফিসের কোনো কাজ যেন আপনার সময়টাকে নষ্ট না করে। সন্তানদের পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধবের খোঁজ নেবেন। সন্তান কিশোর বয়সী হলে বেশি বেশি উপদেশ না দিয়ে তাদের কথার ওপর মনোযোগী হন, তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। এমন একটি আবহ তৈরি করবেন, যেন সে নির্ভয়ে ও বিশ্বাসের সঙ্গে মনের কথা বলে। শিশুদের সঙ্গে তাদের মতো করেই কিছুক্ষণ খেলুন কিংবা মজার মজার গল্প বলুন। শিশুটি অনেক কিছু বোঝে। সামান্যতম মনোযোগের বণ্টন-বিভক্তিও তার চোখ এড়ায় না। তাই তার প্রতি শতভাগ মনোযোগ নিশ্চিত করুন। সারা সপ্তাহ যতই কাজ করুন, ছুটির দিনটি পরিবারের জন্য রাখুন। আগেই সবাই মিলে পরিকল্পনা করুন দিনটিকে সুন্দর করে কাটানোর।
কিভাবে?
আমাদের জীবনের সবটুকু সময়ই দখল করে নিয়েছে কাজ-সংসার-বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ততা। সব কাজ ঠিক রাখতে গিয়ে বঞ্চিত করছি আসলে নিজেকে ও প্রিয়জন সেই সঙ্গীকে, যে হয়তো আপনার কাজ আর পরিশ্রমের কথা ভেবে ছুটির দিনে এককাপ চাও চাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় ব্যস্ততার কারণে কেউ যাতে বঞ্চিত না হয় সেজন্য আমাদের জানতে হবে কিভাবে আমরা কোয়ালিটি সময় কাটাবো। প্রতিটি ছুটির দিনে আমরা ঘরের সব কাজ করতে লেগে যাই, সঙ্গে থাকে আত্মীয় আপ্যায়নের রান্নার চাপ। আর বাচ্চা থাকলে তাদের নিয়ে অনেক মা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। বাবা হয়তো সারাক্ষণ টিভি দেখেই কাটিয়ে দেন ছুটির দিন। এভাবে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো উপভোগ করা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হই।
কোয়ালিটি টাইম যে অনেক সময় নিয়ে দিতে হয়-তা নয়। ১৫ থেকে ৩০ মিনিট সময় শিশুর মনোযোগের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণে দারুণ কার্যকর। ফলে তাকে মনোযোগ পাওয়ার জন্য নেতিবাচক আচরণ করতে হয় না। সারা দিনে যেকোনো সময়ই আপনি কোয়ালিটি টাইম দিতে পারেন। তবে প্রতিদিন একটি সময় নির্দিষ্ট করা থাকলে শিশুর মধ্যেও একটি প্রস্তুতি থাকে। তার আবেগ প্রকাশে সহযোগিতা করতে হবে। সে না চাওয়া পর্যন্ত কোনো উপদেশমূলক বা তত্ত্বকথা বলা যাবে না। মোবাইল ও টিভি চালু রাখলে আমাদের মনোযোগ স্বল্প সময়ের জন্য হলেও অন্যদিকে চলে যায়। এ কারণে শিশুর প্রতি শতভাগ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না।
সম্পূর্ণ মনোযোগ শিশুকে দেওয়ার জন্য মোবাইল, টিভি, চুলা-সব কিছু বন্ধ করে নিশ্চিন্ত মনে শিশুর সঙ্গে কাটান। যদি মোবাইল বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তবে সেটি দূরে নিঃশব্দ করে রাখুন। শিশুর বয়স অনুযায়ী তার মতো করে আচরণ করুন অর্থাৎ শিশু যেভাবে খেলছে, আপনিও সেভাবে খেলুন। সে বসে থাকলে আপনিও এমনভাবে বসুন যেন চোখের যোগাযোগটি আনুভূমিক হয়। সে ভুল খেললে আপনিও ভুল খেলুন। তাকে সংশোধন করতে যাবেন না। সারা দিনে তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় বড়দের ইচ্ছা অনুযায়ী শিশুটিকে পরিচালনা করা হয়। কিন্তু এ সময়ে সে-ই বস। সে যেভাবে চাইবে সময়টি সেভাবেই দিতে হবে; সেভাবেই আচরণ করতে হবে। সে খেলতে, আঁকতে, কোনো কিছু তৈরি করতে, গল্প পড়তে বা শুনতে চাইতে পারে বা পরিবারের সবাই মিলে মজা করতে চাইতে পারে। খুব বিপজ্জনক না হলে শিশু যা করতে চায় তা করতে দিন এবং নিজেও অংশ নিন।
দাম্পত্য জীবনে
দাম্পত্য জীবনে কোয়ালিটি টাইম বা গুণগত সময়ের খুব প্রয়োজন। তাহলে অনেক ব্যস্ততার মধ্যে পুরোনো সেই দিনের মতো এখনো ভালোবাসার রেশ থাকে সম্পর্কে। ১০ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকার চেয়ে এক ঘণ্টার গুণগত সময় অনেক বেশি কার্যকর। ব্যস্ততার মধ্যেও কাজের বাইরে একান্তে দুজন দুজনের জন্য খানিকটা সময় রাখতেই পারেন। অফিস থেকে ফেরার পথে স্বামী-স্ত্রী কোনো কফি শপে গিয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে কিছু মুহূর্ত কাটাতে পারেন। তখন সংসারের হালচাল, সন্তানের ভবিষ্যৎ কিংবা অফিসের সমস্যাগুলো ছাপিয়ে নিজেদের জন্য একটু সময় দিন। গুণগত সময় মানেই পরিবারের জন্য একান্ত কিছু সময়, যে সময়টুকুতে সব ধরনের সমস্যা দূরে সরিয়ে শুধু ভালোবাসার আবেশে থাকবেন দুজন। তখন পরস্পরের প্রতি অভিযোগগুলো তুলবেন না। তাহলে দাম্পত্য জীবনের অনেক সমস্যা মাথা চাড়া দেবে না।
সংসারের জন্যই কাজ করছেন, স্বামী-সন্তানের দেখভাল করেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন; তারপরও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি কিংবা দাম্পত্যে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ কিংবা ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি ঘটে কোয়ালিটি টাইম না দেয়ায়। তাই হাজারো কাজের মধ্যে একটি দিন বেছে নিয়ে ভাববেন এই দিন তোমার-আমার। সেই দিনে স্বামী-স্ত্রী বাইরে ঘুরতে যেতে পারেন। সন্ধ্যার চা বা রাতের খাবার একসাথে করতে পারেন, অল্প আয়োজনে ঘুরতে পারেন, আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করতে পারেন, ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন, একসাথে বাড়িতে বসে ভালো নাটক-সিনেমা দেখতে পারেন কিংবা বন্ধুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে পারেন। এই সময়টুকু না দিলে পারিবারিক বন্ধন মজবুত থাকে না। শুধু স্ত্রী একাই কোয়ালিটি টাইম নিয়ে ভাববেন তা নয়, পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে স্বামীকেও।
কেউ কেউ ভাবেন, দামি উপহার কিংবা কেনাকাটার টাকা দিয়ে দিলেই দায়িত্ব শেষ; বরং স্ত্রীকে হঠাৎ তার প্রিয় কোনো ফুল, বই বা ছোট্ট কিছু দিয়ে অবাক করে দিতে পারেন। ব্যস্ততার মধ্যেও যে তাকে মনে রেখেছেন, এতেই স্ত্রী খুশি হবেন। প্রাধান্য দিতে হবে সঙ্গীর ছোট ছোট পছন্দকে। খুব সূক্ষ্ম ভালোলাগাকে গুরুত্ব দিলে দাম্পত্য জীবন সুখকর হয়ে উঠবে। পারস্পরিক ভুল বোঝাঝুঝি বড় আকার ধারণ করে না, যদি সঙ্গীকে সব সময় বুঝিয়ে দেয়া যায় আপনার জীবনে তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। পর্যাপ্ত সময় না দিলে তিনি একাকিত্ববোধে ভুগতে পারেন। পরিস্থিতি এমন হওয়ার আগেই দিনের একটি সময় সঙ্গীর জন্য বরাদ্দ রাখুন।