কথায় বলে-‘পাগলেও নিজের ভালোটা বুঝে’। এখন কেউ যদি অনেক উচ্চ শিক্ষিত হয়েও নিজের ক্ষতি করেন-তাকে কী বলবেন? শিক্ষিত পাগল। সচেতন (!) ব্যক্তি কখনো জেনে বুঝে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে রক্তাক্ত হন? জ্ঞান থাকতে কেউ যেখানে নিজের নিশ্চিত বিপদ হতে পারে সেখানে যান?- মনে হয় না। জীবনের প্রতি মায়া থাকলে কেউ বিষ গ্রহণ করেন না, ভুল করে হলে সেটি ভিন্নকথা। কেউ যদি নিজের টাকা-পয়সা খরচ করে নিজ দেহের জন্য রোগ বয়ে আনেন, দেহকে দুর্বল ও রোগাক্রান্ত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন, অসুস্থ হতে চেষ্টা চালান তাকে আপনি কী সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ বলতে পারেন? -পারেন না।
অথচ পৃথিবীতে সুস্থভাবে বাঁচতে চাওয়ার স্বপ্ন আছে। সুখ-শান্তিতে জীবন কাটানোর আগ্রহ আছে। ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, লাভ-ক্ষতি বুঝার মত বিবেক আছে, সুন্দর-অসুন্দর পার্থক্য করার ক্ষমতা আছে। বিচার-বিবেচনা শক্তি আছে। এমন ব্যক্তি যদি সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় তিলে তিলে নিজেকে, নিজের শরীরকে নিজের জীবনকে ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাকে কী বলা যায়? সে কী বোকার স্বর্গের শিরোমণি নয়? অবশ্যই। জীবন ও জগৎকে ভালোবেসে সুস্থ শরীরে বাঁচতে চাওয়া অথচ জীবন বিধ্বংসী নেশা করা, ধূমপান করা, তিলে তিলে নিজেকে ধ্বংসের আয়োজন আমার কাছে বড়ই অযৌক্তিক ও হাস্যকর মনে হয়।
আমাদের সেই তরুণটি নিজের কাপড় পর্যন্ত ধোয় না, বিছানা ফেলা থেকে মশারী টাঙ্গানো পর্যন্ত আরেক জনে করে দেয় সেই আদরের দুলালটিই যখন বিদেশে যায় পড়াশুনার জন্যে গেলে পার্টটাইম জব করে, আর অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে গেলে তো কথায় নেই। ক্ষুদ্র, নিম্ন ধরনের এমন কোনো কাজ নেই যা বাদ যায় না। নিজদেশের মাটিতে কাজ করতে ভীষণ লজ্জা। কারণ-এখানে তো সবাই পরিচিত। শারীরিক পরিশ্রম করলে কে কী বলবে। বাজারের ব্যাগটি পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসাটাও লজ্জার ব্যাপার। অথচ প্রবাসে গিয়ে কঠিন পরিশ্রম করতেও আপত্তি থাকে না। সেখানে সবাই অপরিচিত তাই লজ্জার কোনো বালাই নেই।
লাজ শরমের মাথা খেয়ে যে কোনো তুচ্ছ কাজ করেও মুখে হাসি লেগেই থাকে। সত্যি কী অদ্ভূত আত্মমর্যাদাবোধ, অদ্ভূত চিন্তা, কী অদ্ভূত লজ্জা। বিএ, এমএ পাশ করা যে তরুণটি চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে থাকে, বাবার কৃষি কাজে সহযোগিতা করলে ইজ্জত সম্মান যায় বলে মনে করে সারাদিন টিভি দেখা, গান শুনা, বন্ধু-বান্ধবের সাথে খোশগল্প ও আড্ডা দেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দায়িত্ব কর্তব্য আছে বলে মনে করে না সেই ছেলেটিই নিজদেশ ছেড়ে পরদেশে গিয়ে কঠিন কাজ কর্ম করতে আপত্তি করে না। এ ধরনের মানসিকতা আমার কাছে বিস্ময়কর লাগে। দেশে কাজ করলে ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয় অথচ অন্যদেশে তুচ্ছ কাজ, ছোটোখাটো কাজ করার মানসিকতা অত্যন্ত সংকীর্ণ রুচিবোধের পরিচয় দেয়।
এমন বাবুগিরি আর ভদ্রতা দেশের উন্নতি, অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা বৈ কিছুই নয়। যে জাতির মধ্যে কাজ করতে লজ্জা থাকবে, পরিশ্রমকে হীন চোখে দেখবে আবার নিজদেশ, দেশের মাটি, মানুষ, যেখানকার আলো-বাতাসের সংস্পর্শে বেড়ে উঠা সেখানে শ্রম ও শক্তি ব্যয় না করে অন্য জাতির উন্নতি-অগ্রগতিতে অংশগ্রহণেই মানসিক তৃপ্তি, নির্বুদ্ধিতার এক উজ্জ্বল নজির। তার মানে প্রবাসী শ্রমিকদেরকে আমি হেয় করছি না, তারা দেশ জাতির কল্যাণে অনেক অবদান রাখছে। আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি দেশে কাজ করতে লজ্জাবোধ করার দৃষ্টিভঙ্গিকে। দূর হউক এই নির্বুদ্ধিতা, সুবুদ্ধি ফিরে আসুক।