ভাষার বিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে, এর বড় অনুঘট মানুষের মুখের ভাষা, কথ্য ভাষা, মানুষের মুখে মুখে বিবর্তিত হতে হতে অভিধান নতুন নতুন শব্দ পায়। ফলে কোনো একটা মান ভাষা আঁকড়ে ধরে ‘ভাষা শাসন ” করা যায় না।
তবে ভাষার ভিত্তি বিকাশ ও জাতীয় দৃঢ়তার কথা চিন্তা করেই আটপৌরে বাংলা ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। কেননা, নাটকের সংলাপ বা বিজ্ঞাপনে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার টেলিভিশনের পর্দায় বড় কোম্পানিগুলোর অর্থায়নে যদি হতেই থাকে তবে বাংলা ভাষার মান তো থাকবেই না, জান নিয়েও টানাটানি শুরু হবে।
অনেকে বলে ‘প্রমিত বাংলা বলে কিছু নেই। প্রমিত বাংলা বলে যা চলছে তা আসলে কলকাতার ভাষা, আমরা স্বাধীন দেশের কথ্য ভাষায় এসব সাহিত্য লিখি বা বিজ্ঞাপন বানাই এই ধরনের অন্ধদেশপ্রেমের অতিমাত্রা ক্ষতিকর।
চলচ্চিত্র নির্মাতারা যুক্তি দেখান যে, চলচ্চিত্রে বা টিভি মিডিয়ায় ভাষার প্রয়োগ কী রকম হবে, সেটা ঠিক করবে চলচ্চিত্রের দর্শন। যে চরিত্র যেভাষায় কথা বলার কথা, যে চরিত্রের জন্য যে পোশাক দরকার, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে তাকে সে ভাষাতেই কথা বলতে দিতে হবে, সেই পোশাকই পরাতে হবে। তারা বলতে চান যে, আসলে ভাষার ব্যবহার পুরোটাই পরিস্থিতি অনুযায়ী ঘটে।
কিন্তু আমরা এটিও বিবেচনায় আনতে চাই যে, আটপৌরে ভাষার ব্যবহার ছাড়াই অনেক নাটক ব্যাপক দর্শকপ্রিয় হয়েছে, জনপ্রিয় হয়েছে। সুতরাং এসব খোড়া যুক্তি দেখিয়ে আঞ্চলিকতাকে সংবাদ উপস্থাপন, নিউজ রিপোটিং অনুষ্ঠানের উপস্থাপনার ক্ষেত্রে যেমনি টেনে আনা চলবে না। তেমনি আমাদের দেশের সন্তানেরা অন্তত একটি ভাষার ধারাকে প্রমিত বাংলা রুপে গ্রহণ করতে শিখাতেই কল্যাণ।
বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক আঞ্চলিক ভাষা থাকার কারণে আমরা নাটকের ডায়ালগে সেগুলো প্রায়ই শুনতে পাচ্ছি, চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে শুদ্ধ বাংলার চর্চাটা আশংকাজনক ভাবে কমে যাচ্ছে। কিশোর বয়সের ছেলে মেয়েরা আজকাল বাংলা সাহিত্য খুবই কম পড়ছে। হিন্দি সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল, ইংরেজি গান ও ছবি, নানা রকম ডিজুস বাংলার ব্যবহার শিশু কিশোরকে প্রমিত বাংলা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
মোবাইল ফোনের পাঠানো মেসেজে ইংরেজি শব্দের নানা রকম ভুল প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ই-মেইল, চ্যাটিং ইত্যাদিতেও শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার খুব কম দেখা যাচ্ছে। চিঠি লেখার চর্চা কমতে কমতে বন্ধের পর্যায়ে। আজকালকার শিশু কিশোররা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতি খুব বেশি ঝুঁকে পড়েছে। এই শক্তিশালী গণমাধ্যমে যদি তারা আটপৌরে ভাষা শুনতে থাকে, তাহলে তাদের ভাষার বিকাশে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে নিঃসন্দেহে। এ ব্যাপারটিও আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে।
আমরা মানি, আঞ্চলিকতা ভাষারই অলংকার পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষার বৈচিত্রতো এসেছেই আঞ্চলিক নানা ভাষার কারণেই। কিন্তু আটপৌরে ভাষার যথেচ্ছা ব্যবহার নানান ক্ষতি বয়ে আনে। অনেকেই চর্চার মাধ্যমে তাদের বাংলাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার পরিবর্তে ভূল ইংরেজিতে কথা বলাকে বেশি সম্মানজনক মনে করে। এটা দুঃখজনক।
বর্তমানে নানা রকমে কম্পিউটার গেমসও ইলেক্ট্রনিক যুগে অবসর বিনোদনের অডিও ভিজ্যুয়ালা মাধ্যম,কাটুন চিত্র এগুলোকেই অনেকে নবীন প্রজন্মই সুবিধাজনক মনে করছেন। ফলে খুদে নাগরিকেরা সঠিক উচ্চারনে শুদ্ধবাংলা বলা বা লেখার শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুদ্ধ উচ্চারণের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সচেতনতার বেশ অভাব বা কিছুটা উদাসীনতাও রয়েছে।
অথচ একটি মানুষ যখন শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলে নিজেকে কোথাও উপস্থাপন করে তখন নিঃসন্দেহে সে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়, এসব দিক মাথায় রেখে পুর্নদৈর্ঘ্য ও ধারাবাহিক নাটক গুলোর মাধ্যমে যদি বিনোদনের পাশাপাশি কিছু মূল্যবোধ ও সঠিক ভাষা শেখানো সম্ভব হয়, তবে তা অত্যন্ত কল্যাণকর হবে বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে আটপৌরে ভাষা ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।
শিল্পীকে শুধু তার অধিকার নয় তার দায়িত্বের ব্যাপারটিকে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। আটপৌরে ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের ফলাফলটা কিরুপ ধারণ করতে পারে সেটির গভীর উপলব্ধি থাকতে হবে। অঢেল বিত্ত বৈভবসম্পন্ন মানুষের ছেলেমেয়েরা একধরনের সাহেবি কালচার, তৈরি করেছে। তাদের ব্যবহৃত আটপৌরে এবং মিশ্র ভাষার প্রভাব এসে পড়েছে আমাদের ভাষায়, এ ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারই দেশপ্রেম প্রদর্শনের পথ একথা সত্য নয়।
তবে হাঁ নাট্যকার তার চরিত্রগুলোর কথোপকথনে স্বতস্ফুর্ততা ও সাবলীলতা আনার উদ্দেশ্যে আমাদের ঘরে বলা দৈনন্দিন জীবনের ভাষাটিকে ব্যবহার করতে পারেন। তবে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। শিল্পীরও অধিকার রয়েছে। তার নিজের সৃষ্টিকে নিজের মতো করে পরিবেশন করার। কিন্তু আমাদের দেশের শিশুরা যাদের প্রমিত বাংলা ভাষা শেখার প্রয়োজন রয়েছে, তারা কোনটিকে মানদন্ড হিসেবে দেখবে।
এসব ব্যাপারকেও পর্যালোচনা ও বিবেচনায় নেই কার্যকর পদক্ষেপ সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে। নাটকের ডায়লগে আমাদের দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহারের ইতিবাচক নৈতিবাচক উভয় দিকটা মাথায় রেখেই কৌশনী ভূমিকা রাখতে হবে। কেননা, সামগ্রিকভাবে এক্ষেত্রে শিল্পী বা শিল্পের সামাজিক দায়ভার কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
সবশেষে এদেশের মানুষ বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। তাদের সুমহান আত্নত্যাগ আজো আমাদের জন্য প্রেরণার। জাতির ইতিহাসে সৃষ্টি করেছে এক গৌরবোজ্জল অধ্যায়। সে দেশের শিশু কিশোরেরা শুদ্ধ উচ্চারণে বলা প্রমিত বাংলার সঙ্গে অশুদ্ধ উচ্চারণকে পার্থক্য করতে শিখুক এটি আমরা চাই।
যাতে বিশ্বায়নের খপ্পরে পড়ে আমাদের জাতির টিকে থাকাটা কঠিন হুমকির মুখে না পরে, সংস্কৃতির এই যুগে টিকে থাকতে আমাদের ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে মিডিয়াকে দ্বিগুণ শক্তিশালীরূপে আবিভূত হতে হবে। সেক্ষেত্রে একটি প্রয়াস হিসেবে টেলিভিশন ও নাটকে আটপৌরে ভাষার ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।