বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানাহরণে ছুটে এসেছে অনেকে। নানা এলাকা থেকে এসেছে। আচার আচরণে পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। শিক্ষা মৌলিক অধিকার। আর উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুব কম সংখ্যকই আসার সুযোগ পায়। ‘বিশ্ব’ শব্দ জুড়ে দেয়ার মানেটা কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম বিশ্ব উপযোগী, এখানে পড়াশুনা করে যারা বের হয় তারা বিশ্বমানের ব্যক্তিত্ব; চিন্তায়, জ্ঞানে আচরণে বিশ্বমানের দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টির কারখানা এটা নাকি?
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যুগোপযোগী জ্ঞানাহরণ করে বিশ্বব্যাপি কর্মপরিসরকে বিস্তৃত করার মাধ্যমেই এ নামকরণকে অর্থপূর্ণ ও সার্থক করে তোলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষাদানে কিংবা শিক্ষা নেবেন বিশ্বব্যাপী কিছু করার উপযুক্ত দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা তাদের থাকবে। কিন্তু বাস্তবে কী তাই? মোটেই না। নিজ ও নিজ পরিবারের বাইরে কিছু দায়িত্ব পালনের চিন্তা করে কয়জনে? বিশ্বমানবতার জন্য বৃহৎ পরিসরে কিছু করার চিন্তা, প্রচেষ্টা ও প্রয়াস তো দূরের কথা নিজের সমাজ, দেশ, জাতির জন্যও কিছু করার আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না।
স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতা মানসিকতার দ্বারা দেশের কল্যাণ হয় না। যে নিজের আত্মমর্যাদা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে না তার কাছে তার পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতি কিইবা আশা করতে পারে? নিজেকে আত্মপরিচয় উপলব্ধি করে স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব গঠন করতে না পারলে সেটা দুঃখজনক বৈকি?
শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের অবৈধ প্রেমের আকর্ষণ নীচু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ তো বিস্মিত হবার মত। যেই ছেলেটি বাবা মায়ের অতি আদরের সন্তান, সহজ-সরল যে ছেলেটি মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে নয়নের জলে বুক ভাসায়, শিক্ষকদের সবচেয়ে প্রিয় মেধাবী ছাত্র, যার সুসভ্য ও সুন্দর আচার-আচরণ আর আকর্ষণীয় ব্যবহারে মুগ্ধ সবাই সেই হৃদয়ের টুকরো , নয়নমণি, সবার ভালবাসার মধ্যমণি ছেলেটি স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই দুরন্ত হয়ে ওঠে।
মেয়েদের চেহারার দিকে যে তাকাতে পারত না, কথা বলতে গেলে গলা শুকিয়ে যেত, লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যেত, মাথা নীচু হয়ে পড়ত সেই লজ্জাশীল ছেলেটি প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় হাত ধরে প্রিয়সীকে নিয়ে হাঁটে, রিক্সায় গাড়ীতে পাশাপাশি বসে সুখ-স্বপ্ন দেখে, গাছের নিচে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে, লাইব্রেরীর কোণে বসে প্রেম-রসালো কথা বলে, চিমটি কাটে, অট্টহাসি হাসে, চুমো খায়। সুন্দরী বান্ধবীর সাথে আপত্তিকর এসব দৃশ্য দেখতে উৎসুক অনেক দৃষ্টি যখন তাদের দিকে নিবিষ্ট হয় তখন তারা আরো বেশি উৎসাহের সাথে, উদ্দীপনার সাথে, নব প্রেরণা নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়, হারিয়ে যায় গভীর থেকে আরো গভীরে।
যে ছেলেটি মুরব্বি দেখলে সালাম দিত, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করত সেই ছেলেটি সবার সামনে সিগারেট টানে, সালাম দেয়ার প্রথাটি মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলে। হুজুর , মাওলানাদের ভক্তি শ্রদ্ধা দূরের কথা সম্মান করে সালাম দেয়াও হয়ে উঠে না এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধে নানা কটু কথা বলাটা মুখরোচক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অথচ, সেহরী খাইতে না উঠালে সেই ছেলেটি কান্নাকাটি করত, মসজিদ পানে নিষেধ সত্ত্বেও বাবার পিছুপিছু ছুটে যেত, পাজামা-পাঞ্জাবি টুপির জন্য বায়না ধরত, আতর মেখে জুম্মায় যেত, গরীব-দুঃখীদের দান করে আনন্দ পেত, সেই ছেলেটি এখন তরুণ বয়সে মসজিদে যেতে লজ্জাবোধ করে, রোযাদারের সামনে ধূমপান করে। বিবেক বাঁধা দেয়া তো দূরের কথা এটাকেই আধুনিকতা মনে করে।
যেই ছেলেটি পোশাকে একটু ময়লা লাগলেই মায়ের কাছে পরিষ্কার করে দেয়ার দাবি জানিয়ে কান্নাকাটি করত, সুগন্ধি সাবান ছাড়া গোসল করত না, পারফিউম ব্যবহার ছাড়া স্কুলে যেত না সেই ছেলেটি এখন দুর্গন্ধকে প্রিয় করে নিয়েছে। মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল খায়, ধূমপান করে। মুখে বিশ্রী গন্ধ, নেই ঝকমকে দাঁত, আম্মুর গালে যে ঠোঁট দুটি চুম্বন পরশ এঁকে দিত সেই ঠোঁট দুটি এখন খুব বিশ্রী দেখায়। পূর্বের মত রং আর নেই। বড়ই অদ্ভূত এ পরিবর্তন। বাবা মা যাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখত, অনেক বড় হবে, শিক্ষিত হবে, বুকটা ভরে উঠবে। এইতো চাওয়া।
আনন্দে পড়াশুনা শেষ করে ছেলে যখন অর্থ রোজগার করবে নিজেদের পছন্দমত পুত্রবধু ঘরে আনার দারুণ এক সুখ স্বপ্ন। কিছু আশায় গুড়েবালি। ছেলেটি বলে-মা আমি অমুককে ভালবাসি, ওকেই আমি বিয়ে করব। এমনটি কেন হয়?যে ছেলেটিকে বাবা মা বাজারে পাঠাতেও কষ্টানুভব করত, অতটুকু কষ্টও দিত না, নিজেরা পরিশ্রম করত, অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা, মারামারিসহ অনেক কঠিন কাজ। বাবা মা বুঝে না তাদের সহজ সরল খোকা কেন এমন হল। এমন পরিবর্তন কিভাবে হল।
বাবা-মা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখে নি। এখানকার পরিস্থিতি জানে না। মা তাই তো জায় বসে নামাজান্তে খোকার জন্য দু’আ করে। কারো কুদৃষ্টি লেগেছে কি-না, ভূত জীনের আছড় পড়েছে কি-না এসব ভেবে কবিরাজী চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। অথচ মা যখন জায়নামাজে বসে কুরআন তেলাওয়াত করে, দু’আ করে চোখের পানি ফেলে ঠিক সে সময়ে খোকা হয়তো বান্ধবীর সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে কিংবা তাদের আড্ডায়, মদের আসরে সময় কাটাচ্ছে। সত্যি বড়ই নির্মম কঠিন এই বাস্তবতা।