অপরাধপ্রবণতা রোধে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ

আনিসুর রহমান এরশাদ

অপরাধপ্রবণতা রোধে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান যদি মা-বাবাকে ঝগড়া করতে দেখে, মিথ্যা বলতে শুনে, অশ্লীল আচরণ করতে দেখে তবে তারাও নেতিবাচক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিবাদ, মনোমালিন্য ও ঝগড়া-ঝাঁটি দীর্ঘমেয়াদে সন্তানদের ক্ষতি ডেকে আনে। সন্তান যদি কখনো জানে মা-বাবা কারো পরকীয়া সম্পর্ক আছে, সুদ-ঘুষ বা অবৈধ ব্যবসা আছে তবে সে তার যাপিত জীবনের কোনো ব্যাপারে মা-বাবার দেয়া নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে যায়। কারণ সে ছোট হলেও অপরাধী বড়দের কাছ থেকে নীতি কথা শুনতে কিংবা তাদের দেয়া স্বভাব-আচরণ সংক্রান্ত পরামর্শ মানতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। ছোটবেলায় মা-বাবাকে দাদা-দাদীর অযত্ন-অবহেলা করতে দেখেই তরুণ বয়সে নিজের বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখের জীবন যাপনের প্রবণতা তৈরি হয়। এভাবেই ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক মানস গড়ায় পরিবারের ভূমিকা চিরন্তন।

নেতিবাচকতার দিকে প্ররোচিত করা

পরিবারে জ্ঞান-আহরণে নিবেদিত সদস্যের দৈনন্দিন জীবন যেমন অন্যদেরকেও আলোকিত করে, তেমনি ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অসচেতন সদস্যের আচার-আচরণ-চেতনা নেতিবাচকতার দিকে প্ররোচিত করে। যে দাদা ধূমপান করেন কিংবা মাদক গ্রহণ করেন তারপক্ষে নাতিকে নেশাজাত দ্রব্য থেকে বিরত রাখা সম্ভব না। যখন বাবা ছেলের বিয়েতে ছেলের বউয়ের বাড়ি থেকে যৌতুক আনেন, তখন মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় যৌতুক দিতে না চাওয়াকে মেয়েও ভালোভাবে নেন না। খ্রিস্টধর্মে বিলাস, লোভ, আলস্য, হিংসা, ক্রোধ, অহংকার ও কাম লালসাকে মারাত্মক পাপ হিসেবে দেখা হয়।

যা চায় তাই পাওয়া

কেউ যদি এমনভাবে বেড়ে ওঠে যে সে যখন যা চায় তাই পায়, তাহলে তার মানসিকতা এমন হয় যে কেউ প্রেম প্রত্যাখ্যান করলে হয় আত্মহত্যা করে কিংবা এসিড মেরে বা মিথ্যা ভিডিও বানিয়ে বা কুপিয়ে আহত করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। পরিবারে বৈষম্য-বঞ্চনার মধ্যে বেড়ে উঠলে মনের কঠোরতা এমন হয় যে সে যেকোনো নৃশংস কাজ করতে পারে। অর্থাৎ অতি আদর কিংবা অতি শাসন, অতি বিলাসিতা কিংবা অতি দরিদ্র কোনোটিই সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে বিয়ে বিচ্ছেদ, পরকীয়া, বিয়েবহির্ভূত সংসার, আত্মহননের মতো উপসর্গ বাড়ে।

অপরাধের খেসারত

যদি কোনো পরিবারে বড় ধরনের অপরাধী যেমন-চোর, ডাকাত, পকেটমার, ধর্ষক, যৌন ব্যবসায়ী, মাদকাসক্ত, চোরাকারবারি কিংবা খুনি থাকে তবে সেই অপরাধীর অপরাধের খেসারত সামাজিকভাবে অন্যদেরও দিতে হয়; এমনকি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মকেও এর দায়ভার বহন করতে হয়।

একজনের অপরাধে আরেকজনের তিক্ত অভিজ্ঞতা পরিবারের নিরপরাধী সদস্যের মাঝেও হীনমন্যতা  তৈরি করে। বাবা যদি অফিসের জিনিস বাসায় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তা সংগ্রহের জন্য সন্তানকে টাকা দেন কিংবা সহায়তা করেন, চাকরির জন্য ঘুষের টাকার যোগান দেন; তাহলে সেই সন্তান কখনোই বাবাকে সৎ ভাববে না। একসময় সন্তান বাবাকে তার উপার্জিত অর্থের আমানতদারও ভাববে না। এই যে উন্নত নৈতিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা- এটা পরিবার থেকে না শিখলে পরবর্তীতে  শেখা অত সহজ নয়।

অপরাধীকে প্রশ্রয়

সমাজে পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা মর্যাদাকর অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে একজনের পাপের কারণে। যেমন পরিবারের কোনো সদস্য যদি অপহরণের সাথে যুক্ত থাকে তবে অন্যদেরও প্রতিনিয়ত কটুকথা শুনতে হবে। এই যে জঙ্গিরা মারা যাচ্ছে বা জীবিত ধরা পড়ছে এতে তাদের পরিবারের মানহানি ঘটছে। এসব পরিবারের কারো সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে শুরু করে যেকোনো যৌথ উদ্যোগে যুক্ত হতে ইচ্ছুক হবে না সমাজের অন্য মানুষ। তাই পরিবার যদি মান ইজ্জতের ভয়ে অপরাধীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তবে দীর্ঘমেয়াদে তা ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে।

তাই পরিবারের কোনো সদস্য যদি ইভটিজিং থেকে শুরু করে সংগঠিত কোনো অপরাধীচক্রের সাথে জড়িত হয় তবে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করা আর যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না আসে তাহলে আইনের কাছে সোপর্দ করা উচিৎ। চাচার পকেট থেকে না জানিয়ে অর্থ সরানো, অন্যের গাছের ফল না বলে খাওয়া কিংবা কুড়িয়ে পাওয়া দামি কোনো জিনিস বাসায় আনা- এসব জেনেও যদি অভিভাবকরা লঘু অপরাধ ভেবে শক্তভাবে শাসন না করেন অথবা না বুঝান; তবে সময়ের ব্যবধানে বড় হয়ে পুকুর চুরি করতেও সে দ্বিধা করবে না।

অপরাধের বিস্তার

পরিবারের অধিকাংশের চিন্তায়-মননে এবং আদত-অভ্যাসে যদি পুণ্যতা-পবিত্র অনুভূতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা পরিলক্ষিত হয় তবে সেই পরিবারে অপরাধের বিস্তার হয় না। পারিবারিক পরিবেশ ও পরিবেষ্টনীর প্রভাব, ভালো-মন্দের পার্থক্যবোধ এবং নৈতিকবোধের আনুকূল্য, দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা ও প্রস্তুতির ওপর অপরাধ প্রবণতা থাকা বা  না থাকা নির্ভরশীল।

মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণাবলির মধ্যে নীতিবাদিতা ও মানসিক আবেগ এমন কার্যকারণ, যা একজন থেকে আরেকজনের মাঝে সংক্রমিত হয়। মনের ইচ্ছা-বাসনা ও আবেগ-উচ্ছ্বাসের পারস্পরিক সংযোজন ইতিবাচক হলে সেই পরিবার হয় অপরাধবোধ দূরীকরণের শক্তিশালী কেন্দ্র। মুরুব্বিরা যদি কাজের ছেলে-মেয়ে কিংবা পিয়ন-দারোয়ানদের তুই-তুকারি করেন কিংবা শারীরিকভাবে আঘাত করেন, আর এই দৃশ্য দেখে ছোটরাও সমবয়সী কাউকে  মারতে কিংবা গরিব মানুষকে ঘৃণা করতে শিখবে।

নৈতিকতার সঙ্কট

ব্যভিচার তথা অবৈধ যৌন সম্পর্কে বংশগত পবিত্রতা বিনষ্ট হয়; নোংরামি, পংকিলতা, নগ্নতা, নির্লজ্জতা, অশ্লøীলতা, পারস্পরিক হিংসা-দ্বেষ, শত্রুতা, নরহত্যা ও রক্তপাত ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়। পারিবারিক ও বংশীয় একত্ব ও ঐতিহ্য চূর্ণ হয়ে বংশের ধারা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। আত্মীয়তা এবং তার মান-সম্ভ্রম ক্ষুণ্ন ও বিলীন হয়।

যে সমাজে ব্যভিচার সমর্থন পায়, তা অনিবার্যভাবে উন্নত মানবীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যমান থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। ব্যক্তিদের মধ্যে স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবেশ জেগে ওঠলে সামাজিক উন্নতি ও বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই পারিবারিক পরিবেষ্টনীকে পবিত্র ও সুশৃঙ্খল রাখার জন্যে পরিবারের প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে পূর্ণমাত্রায় আন্তরিক ও সদাতৎপর হতে হবে, যাতে কারো মাঝে নৈতিক-মানবিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি না হয়।

এক্ষেত্রে সভ্যতা, শালীনতা, সুষ্ঠুতা ও আদব-কায়দা সংরক্ষণের প্রবণতা সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। যাতে পরিবারের কাউকে বিব্রত, দিশেহারা, অসহায়, নিরুপায় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে না হয়; নৈরাশ্য ও হতাশা, দুঃখ ও দুশ্চিন্তা, আত্মহত্যা করার ইচ্ছা বৃদ্ধি না পায়। পরিবারের প্রবীণেরা নবীনের মনের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, নতুন জীবনে প্রেরণা ও শক্তিমত্তা জাগাতে পারে। যা তাদের মনে এনে দেয় গভীর প্রশান্তি, স্থিতি ও চিরসতেজতা।

ধ্বংসের স্লো-পয়জনিং

পরিবারে সুস্থ বিনোদন নিশ্চিত করতে পারলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমবে। সহজাত মনোবৃত্তির কারণেই অপরাধবিষয়ক নাটক ও সিনেমা দেখে খারাপ হয় দর্শকরা। তাই পরিবারের সদস্যদেরকে সুস্থ বিনোদনে আগ্রহী করতে হবে।

রাজধানীর জুরাইনের আলমবাগে দুই সন্তান পাবন ও পায়েলকে নিয়ে ২০১০ সালে আত্মহত্যা করে মা রিতা। দেয়ালের লেখাগুলোর মধ্যেই সে বলে যায় ‘ডুবসাঁতার’ নামে একটি ভারতীয় সিনেমা দেখে আত্মহত্যায় আগ্রহী হয় রিতা।

২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুরের স্বামী হাসান সাঈদের কারাবন্দি অবস্থায় আত্মহত্যার ধরনের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় হলিউডের ‘লাইফ অফ ডেবিড গেল’ সিনেমার।

২০১৪ সালে চাঞ্চল্যকর বাচ্চু হত্যাকাণ্ডের আসামি ফাহরিনা মিষ্টি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়- ভারতীয় সিনেমায় হত্যা করার ধরন দেখে বাচ্চুকে হত্যার কৌশল শিখেছিল সে।

এমনই এক ভারতীয় সিনেমা দেখে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও গৃহিণী মাকে হত্যা করেছিল ঐশী। পাখি ড্রেস না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে অনেক মেয়ে। এককথায় অসুস্থ বিনোদন আমাদের পারিবারিক বন্ধন ছিন্নের ব্যবস্থা করছে, সামাজিক চরিত্র বিনষ্টের আয়োজন করছে, জাতীয় সংস্কৃতির আমূল বিকৃতি করছে, রীতি-নীতি ধ্বংসের স্লো-পয়জনিং শুরু করেছে।

অপরাধমুক্ত মন

পরিবারের সদস্যদের বই পড়ায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে, পারিবারিক লাইব্রেরি গড়ে তুলতে হবে। বই পড়ে জ্ঞানে আলোকিত ভুবনে বিচরণ করলে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা পাবে। বই পড়ে জ্ঞান অন্বেষণ ও সাংস্কতিক কর্মকাণ্ডের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সত্য ও সুন্দরের বার্তা, জাগ্রত হয় মমত্ববোধ, সৃষ্টি হয় সম্প্রীতির ভাবনা। বই মানুষের মধ্যে দয়া, বিনয় ও সৃজনশীলতার বিকাশে সাহায্য করে। পরিবারের সদস্যদের অবসর সময়কে কাজে লাগাতে পারলে এবং আলোকিত মন গড়তে পারলে অপরাধমুক্ত মানুষ তৈরি করা সম্ভব হবে।

অনাদরে অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে এ দেশের মানুষের নিজস্ব ভাব-ভাষা, দেশীয় সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বিনষ্ট হচ্ছে পারিবারিক শান্তি, বাড়ছে পারিবারিক অপরাধ ও নানা ধরনের বিরোধ। বস্তুবাদিতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, আর নগ্নতার হাজারোপাঠ তুলে না ধরে যদি প্রতিটি পরিবার হয় দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার উর্বর ক্ষেত্র তবে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে, পারিবারিক শান্তি ও সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।

অপরাধীদের সংশোধানাগার

অমানুষদের সংশোধানাগার হতে হবে পরিবার। না হলে জনসংখ্যা বাড়লেও মানুষ কমতেই থাকবে। আবার বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নামে বা স্বাধীনতা ঘোষণার অপরাধে যুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন ও অবরোধের কারণে মানুষ মারা, বাস্তুচ্যুত হওয়া, দুর্ভিক্ষ ও রোগব্যাধি বৃদ্ধি, নিঃস্ব হওয়ায় রক্ত নিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ী ও ক্ষমতালোভীরা জিতলেও হেরে যাচ্ছে মানবতা। মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, পরিবেশ দূষণসহ পৃথিবীর যত অরাজকতা সবই করছে মানুষ।

প্রতিটি অপরাধীই দিন শেষে পরিবারে ফিরে আসে। প্রতিটি পরিবার যদি হয় মানুষরূপী অমানুষদের সংশোধানাগার তবেই শান্তি। যত নীতিকথা বলি তার চর্চা পরিবার থেকেই শুরু হতে হবে। পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করতে হবে। সমঝোতা, সম্প্রীতি ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবারের ভিত মজবুত রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার সুসংহত রাখা, শান্তি বিনষ্ট না করা,স্বতন্ত্র ও সম্মিলিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সচেতনতা জরুরি।

পরিবর্তনের সেরা কেন্দ্র

মাদক প্রতিরোধে শরীর ও সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে, সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একজন মাদকাসক্তের কারণে একটি পরিবার কী অবর্ণনীয় আর্থিক ও সামাজিক সংকটের মুখে পড়ে তার ক্ষতির দিক সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রতিটি পরিবার হোক এমন যেখানে থাকবে না অপবিত্রতা ও অশীøলতা; বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ছোটদের প্রতি স্নেহ যেখানকার অনন্য বৈশিষ্ট্য হবে।

আধুনিকতা দোহাই দিয়ে জলাঞ্জলি দিবে না লজ্জাবোধ-স্বাতন্ত্র্যবোধ-আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার চেতনা। আগামী দিনের প্রজন্মের কাছে একটি সুন্দর, সভ্য ও উন্নত এবং সর্বোপরি একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিয়ে যেতে চাইলে পরিবার গঠন ও সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি পরিবার হবে অপরাধীর জন্য সংশোধনাগার এবং অপরাধ প্রবণদের জন্য পরিবর্তনের সেরা কেন্দ্র।

আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই আত্ম-উন্নয়ন

আত্মশুদ্ধির আরবি প্রতিশব্দ ‘তাযকিয়ায়ে নফস। ‘তাযকিয়ায়ে নফস’ বলতে আত্মার পরিশুদ্ধতা ও আত্মার পবিত্রতা উন্নতি, প্রবৃদ্ধি, পূর্ণতা লাভ, ত্রুটিহীনতা ও যোগ্য হওয়া প্রভৃতি বুঝায়।মানুষের অন্তর যদি কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে, তবে সারা শরীরের কার্যকলাপও সঠিক থাকবে। পক্ষান্তরে অন্তর যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তবে শরীরের সব ব্যবস্থাপনাও বিনষ্ট হবে। তাই সবার আগে আত্মাকে ঠিক করা দরকার। আত্মার ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে তার স্বচ্ছতা ও মলিনতা। মনুষ্যত্ববোধ ও সুবুদ্ধির মানুষই প্রকৃত মানুষ। মনুষ্যত্ব ও বিবেকের অভাবে মানুষ হয় পশু ও অধম। তাই মানবাত্মার পরিশুদ্ধির উৎকর্ষে মনুষ্যত্বের জাগৃতি বেশি হওয়া দরকার। আত্মশুদ্ধি আত্ম-উন্নয়নেরও পূর্বশর্ত। কথায় আছে, ‘মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো মানুষ হওয়া।’

মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে যেমন রয়েছে আত্মবিশ্বাস, সৌজন্যতা, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, বদান্যতা, সুষ্ঠুবিবেক, তীক্ষè বুদ্ধি, উন্নতকৌশল, দূরদর্শিতা, আত্মসম্মানবোধ, সাহসিকতা আর ন্যায়পরায়ণতা; ঠিক তেমনি রয়েছে অহংকার, লোভ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ভীরুতা, কাপুরুষতা প্রভৃতি। ব্যক্তিকে সভ্য, আধুনিক, প্রগতিশীল, সংস্কৃতিবান, মানবীয় গুণসমৃদ্ধ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, চিন্তাশীল, সামাজিক ও যথার্থ জ্ঞানী করে গড়ে তোলার জন্য আত্মশুদ্ধি ও আত্ম-উন্নয়নের বিকল্প নেই। মানুষকে মানুষ হতে হলে মানবীয় গুণাবলি অর্জন করতে হয় এবং নিরন্তর সাধনা বলে একে ধরে রাখতে হয়। ব্যক্তিকে নিজের মধ্যকার সম্ভাবনাগুলোকে খুঁজে বের করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থির করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মন্নোয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ধীরে ধীরে নিজকে প্রস্তুত করতে হয়।

নিষ্কলুষ আত্মাই উত্তম

একটি নিষ্কলুষ আত্মা অনেক ধনসম্পদ ও মনি-মানিক্যের চাইতে উত্তম। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ ভুলত্রুটি- হীনমন্যতা ত্যাগ করে, নিজের চরিত্রকে সংশোধনে শুদ্ধ পথে নিয়ে যায়, খারাপ অভ্যাস দূর করে, অন্তর গড়ার সাধনা করে, পাপাচার-কলুষতা থেকে নিজের আত্মাকে মুক্ত থাকে, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সঠিক নিয়মে নিজের সব ভুল-ত্রুটি শুধরায়, অবাঞ্ছিত-গর্হিত-অনাকাক্সিক্ষত কাজ থেকে দূরে থাকে, নির্ভুল পদ্ধতিতে কামনা-বাসনাগুলোকে পদদলিত করে, বাস্তব কর্মপন্থার আলোকে প্রয়োজনে কঠোর পরিশ্রম করে এবং শুদ্ধচারী কৃতজ্ঞ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে।  আত্মশুদ্ধি করলে নিজেকে ভালো ও অন্যকে খারাপ ভাববে না, কেউ খারাপ বললেও তাতে রাগ হবে না, অপরকে দোষারোপ করবে না বরং কেউ দোষ ধরে দিলে দোষ সংশোধন করে নিতে পারায় আরো খুশি হবে। আত্মশুদ্ধি করেই মানুষ পূত পবিত্র হন।

আত্মা বিশুদ্ধতো আমলও বিশুদ্ধ

মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধির উপরই নির্ভর করে তার বহ্যিক আচার-আচরণ।  আত্মা বিশুদ্ধ না হলে মানুষের আমলও বিশুদ্ধ হতে পারে না। আত্মার সুর ছড়ায় আত্মার সাহচর্যে।  তাই আত্মার উন্নয়নে বিশুদ্ধ আত্মার সান্নিধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে।  মানুষের মনুষ্যত্ব নির্ণীত হয় চরিত্র দিয়ে। আর চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে তার আত্মা। কাজেই জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে আত্মার শুদ্ধতার ওপর। আত্মা ছাড়া মানবজীবন অচল। পরিশুদ্ধ আত্মা অপরের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, সবার কল্যাণ কামনা করে, মানব প্রেমের জয়গান গায় এবং মানুষের দুঃখে ব্যথিত হয়। কলুষিত আত্মা পৃথিবীতে অনিষ্টের কারণ। অন্যায়-অপকর্মের মাধ্যমে ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে পৃথিবীর ধ্বংস ডেকে আনে।

কলুষতা মুক্ত আত্মা

মানবতার কল্যাণে দান করা, মৃত্যুকে স্মরণ করা আত্মাকে নির্মোহ, নির্মল ও পরিপাটি রাখার উপায়। আত্মার সুর ছড়ায় আত্মার সাহচর্যে। তাই আত্মার উন্নয়নে বিশুদ্ধ আত্মার সান্নিধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। আত্মার সংশোধন এবং কলুষতা থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করতে হবে। নিষিদ্ধ ও বেহুদা চিন্তা-কথা-কাজ পরিহার, চোখ-জিহ্বা-লজ্জাস্থানের হিফাজত, বেশি কাঁদা, কম হাসা, কম কথা বলা, কম খাওয়া, কম ঘুমানো-এর মাধ্যমে আত্মা পরিশুদ্ধ হবে। পোশাক হতে হবে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন-শালীন, আয়-রোজগার-ব্যয় হতে হবে হালাল পথে অর্জিত। জ্ঞান হতে হবে-সব ধরনের কুসংস্কার ও বিভ্রান্তিমুক্ত। আমল হতে হবে খাঁটি; লোকদেখানো ও সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনে হবে না। চরিত্র হতে হবে উত্তম।  হারাম ও সন্দেহযুক্ত পন্থা সর্বদা বর্জন করতে হবে।

আত্মশুদ্ধি আনে সফলতা

আত্মশুদ্ধি জীবন ও কর্মে আনবে শুদ্ধতা ও সফলতা। তাইতো বুদ্ধিমান নিজের আত্মাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে, নিজের দোষ দেখতে পায়, নিজেকে অন্যের চেয়ে ভালো ও মর্যাদাবান ভাবে না, অভ্যন্তরীণ দোষসমূহ থেকে আত্মাকে পবিত্র করে, অন্তরের ব্যাধি রাগ-হিংসা-মোহ-দূর হয়, নিজের ভিতর থেকে অহংকার দূর করার মানসিকতা তৈরি করে, ক্রোধে ফেটে পড়ে না, সৎগুণাবলি দ্বারা আত্মাকে সুসজ্জিত করে, প্রয়োজনীয় একাগ্রতা ও ইচ্ছাশক্তি রাখে, হালাল খাবার খায়, যেনা ও ব্যভিচার থেকে বিরত থাকে, ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়, তওবা করে, খারাপ কাজ বাদ দিয়ে সুন্দর পথে আসে ও সুদ-ঘুষ দেয়া-নেয়া থেকে বিরত থাকে। নির্বোধ আত্মার চাহিদা অনুসরণ করে, লোভ গ্রাস করে, কাজে প্রদর্শনেচ্ছা ও অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, মিথ্যা-অপবাদ-ঝগড়া-গিবত-চোগলখুরি-কুৎসা রটায়, অভিযোগ করে, অন্যের দোষ খুঁজে, প্রতারণা করে এবং পাপ-অশ্লীল কাজে নিয়োজিত থাকে।

 

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *