অনিরাপদ সড়ক, নিরাপদ হবে কীভাবে?

মোটেই নিরাপদ নয় দেশের সড়ক। রাজধানী ঢাকা-সহ বাংলাদেশে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার দেখলেই অবস্থা স্পষ্ট হয়। ঢাকায় বাস চাপা পড়ে দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে ঘিরে সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নেমেছিলেন। সব বাস-ট্রাক ড্রাইভারের লাইসেন্স থাকতে হবে, এটিই ছিল শিক্ষার্থীদের মূল দাবি। তাদের অবরোধ-আন্দোলনের পর পুলিশ নিরাপদ সড়ক সপ্তাহ পালন করেছে, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তারপরও এখনো অনিরাপদ সড়ক, স্বপ্ন বিবর্ণ হচ্ছে সড়কে। সড়ক নিরাপদ হবে কীভাবে তা নিয়ে ভাবছে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও।জাতিসঙ্ঘের পরিসংখ্যান বলছে পশ্চিমা দুনিয়ার বেশিরভাগ উচ্চ আয়ের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার প্রায় আড়াই গুণ বেশি।

এক নজরে দেখে নিন লুকিয়ে রাখুন

বেশিরভাগ দুর্ঘটনা মহাসড়কে

বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরের রাস্তায় অনেক দুর্ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই কিন্তু ঘটে জাতীয় বা আঞ্চলিক স্তরের হাইওয়ে বা মহাসড়কগুলিতে। ২০১২ সালে বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকার চেয়েও বেশি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছিল কুমিল্লা জেলায়। সেই বছরে সর্বাধিক পথ দুর্ঘটনার ঘটনায় প্রথম ৫টি জেলা ছিল যথাক্রমে কুমিল্লা, ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রাম। এই জেলাগুলোর ভেতর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক গেছে বলেই এই জেলাগুলোতে দুর্ঘটনার হার এত বেশি।

এখনও অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সারা বিশ্ব জুড়ে পথ দুর্ঘটনায় যারা মারা যান তার অর্ধেকই কিন্তু গাড়ির আরোহী নন। এদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই আসলে পায়ে-হাঁটা পথচারী, কিংবা সাইকেল বা মোটরবাইকের আরোহী। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানেও পথ দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে এই পদাতিক বা বাইক-সাইকেল আরোহীর সংখ্যাই অর্ধেক। তাই বিভিন্ন ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ বা ঝুঁকির উপাদানগুলোর মোকাবিলা করে পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমাতে বাংলাদেশে একটি সুসংহত আইন প্রণয়নের ওপরও জোর দিয়েছিল জাতিসঙ্ঘের ওই সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছিল, ‘নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু অগ্রগতি করলেও তাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি’।

সড়ককে নিরাপদ করা

সড়ককে নিরাপদ করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পথচারীরা নিয়ম মেনে রাস্তায় চলাচল করবেন। ড্রাইভাররা নিয়ম মেনে গাড়ি চালাবেন। আমি সেই আশা করি। একই সঙ্গে বাসচালকরা ওভারটেক করলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দিতে হবে। আমি সকলকে বলব, রাস্তা পারাপারের সময় একবার ডানে দেখতে হবে, একবার বামে দেখতে হবে কোনো গাড়ি আছে কি না। যেখানে বাস স্টপিজ, সেখানেই গাড়ি থামাতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি থামানো যাবে না। কেউ না মানলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দিতে হবে। দরকার হলে লাইসেন্স বাতিল করত হবে। আমাদের দেশের মানুষের বদ অভ্যাস আছে। পানি খেয়ে বোতল ছুড়ে মারল, কলা খেয়ে রাস্তায় ফেলে দিল। এসব বন্ধ করতে হবে। বাস ড্রাইভারদের লাইন দিয়ে বাস চালাতে হবে। কোনোভাবে ওভারটেক করলে শাস্তি দিতে হবে। কেউ অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নিতে হবে। ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যাতে বাস, বাসচালককে শনাক্ত করা যায়। প্রত্যেক স্কুল ছুটির সময় ও স্কুল শুরুর সময় একজন করে ট্রাফিক নিয়োজিত থাকবে। স্কুল থেকেও ভলান্টিয়ার নেওয়া হবে, অবশ্যই উঁচু ক্লাসের হবে।’

পুলিশকে যথাযথ দায়িত্ব পালন

সড়ককে নিরাপদ করতে হলে পুলিশকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিতে হবে। লাইসেন্স না থাকা, রুট পারমিট, ফিটনেসের অভাব এসব সমস্যা দূর করতে হবে। মানুষকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্রাফিক এনফোর্সমেন্টের দায়িত্ব মূলত ট্রাফিক বিভাগের হলেও ট্রাফিক সংক্রান্ত আরো অনেক কাজ যেমন, ট্রাফিক এরভায়রনমেন্ট, ট্রাফিক এডুকেশন এবং ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ বেশ কয়েকটি সংস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। এ কারণে ট্রাফিক বিভাগ কতটুকু সফল হবে সেটা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই সংস্থাগুলোর সার্বিক কার্যক্রমের ওপর। ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকটা তদারকি করে সিটি কর্পোরেশন, রোডস এন্ড হাইওয়েজসহ আরো কয়েকটি সংস্থা। ফলে সমন্বয় ও সহযোগিতার দরকার হয়।

ট্রাফিকের অব্যবস্থাপনা দূর করা

বাংলাদেশের ট্রাফিকের অব্যবস্থাপনার পেছনে মূল কারণ- এখানে ডিজিটালাইজড ট্রাফিক সিগনাল নেই। এছাড়া শহরে ডাম্পিং গ্রাউন্ড না থাকাও বড় সমস্যা। আমাদের এখনো ম্যানুয়ালি হাত উঁচিয়ে যানবাহন দাঁড় করিয়ে কাজ করতে হয়। ফিটনেসবিহীন বা রুট পারমিটবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা বা জরিমানা করেও কোন লাভ হয় না। কেননা আইনগতভাবে যদি বলা হয় এই বাসগুলোকে চালানো যাবে না। তাহলে সেই বাসগুলোকে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে রাখতে হবে। যেটা কিনা ঢাকার কোথাও নেই। এজন্য গাড়িগুলোকে আটকে রাখা যায়না। এক্ষেত্রে ডাম্পিং গ্রাউন্ড থাকা অনেক জরুরি।

মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি

ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তারা বিভিন্ন গাড়ির ক্ষেত্রে কড়া আইন প্রয়োাগ করেন আবার অনেককে ছাড় দিয়ে দেন। ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করতে পুলিশকে অনেক প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। এর প্রধান কারণ আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আইন মান্য করার সংস্কৃতি নেই। ট্রাফিক পুলিশরা রোদ-বৃষ্টি-ধুলোবালির মধ্যে অনেক কষ্ট করে কাজ করে। তাদের মানসিক অবস্থাটা অনেকেই বুঝতে চান না। তারা কারো গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র দেখতে চাইলে চালকরা তাদের সহযোগিতা না করে, বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচয় দেন। ঝগড়াঝাঁটি শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তারা পুলিশের বিরুদ্ধেই উল্টো অভিযোগ দেন যে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যান্য দেশে একশ জনের মধ্যে হয়তো দুইজন আইন ভাঙ্গেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এতো কঠিন কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিষয়টা উল্টো। এখানে ৯০ শতাংশ মানুষই আইন মানে না। তাই হাতে গোনা কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে এতোগুলো মানুষকে তদারকি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাধারণ মানুষের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই।

ডিজিটালাইজড ট্রাফিক ব্যবস্থা

ট্রাফিক ব্যবস্থা যদি উন্নত দেশগুলোর মতো ডিজিটালাইজড হতো তাহলে এতো কষ্ট করতে হতো। ট্রাফিক এরফোর্সমেন্টের পুরো কাজ জনে জনে হাত তুলে গাড়ি থামিয়ে করতে হয়। বিষয়টা যদি পুরোপুরি অটোমেশনে থাকতো, তাহলে এতো সময় দেয়া লাগতো না। কেউ যদি সিগনাল লাইট লঙ্ঘন করতো তাহলে অটোমেটিক গাড়ির নাম্বার প্লেট স্ক্যান করে সব তথ্য ওই ব্যক্তিকে এসএমএসে জানিয়ে দেয়া হতো। এতো মানুষের পেছনে দৌঁড়াতে হতো না। তাই অটোমেশনের বিকল্প নেই।

লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

এটাও সত্য- বাংলাদেশের বাস ড্রাইভাররা বেপরোয়া। ঢাকায় গণ-পরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য সহজ নয়। রাজনীতি এবং চাঁদাবাজির কারণে সরকারের এই ধরনের উদ্যোগ অতীতে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে থেকেই নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই খাতে প্রশিক্ষিত ড্রাইভার না থাকা এবং চুক্তি ভিত্তিতে ড্রাইভারের হাতে বাস ছেড়ে দেয়ার জন্যই সড়কে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। এই বিষয় নিয়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নেতা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সরকার কঠোর হতে চাইলেও, বাস-ট্রাকের মালিক ও শ্রমিকরা এ নিয়ে হরতাল শুরু করেন। ভাঙচুর করেন। ফলে সরকার ভয় পেয়ে যায়। সরকারের ভেতরে থাকা পৃষ্ঠপোষকদের জন্যই বাস মালিক এবং ড্রাইভাররা আজ এতটা বেপরোয়া আচরণ করছে।

বিশাল সংখ্যক ড্রাইভার কোনো অনুমতি ছাড়াই গাড়ি নিয়ে পথে নামছেন। এই ব্যবধানের কারণ হতে পারে, বাস-ট্রাকের মতো ভারী গাড়ির লাইসেন্স নিতে মোট ছয় বছর সময় লাগে। ড্রাইভারদের প্রথমে হালকা গাড়ির লাইসেন্স নিতে হয়, তার তিন বছর পর মাঝারি গাড়ির লাইসেন্স নিতে হয়। ভারী গাড়ির লাইসেন্সের জন্য আরো তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়। এরপর যে ড্রাইভার বাস চালাতে চান তাকে পাবলিক সার্ভিস ভেহিকেল অথোরাইজেশন বা পিএসভি নামে ভিন্ন আরেকটি লাইসেন্স নিতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ড্রাইভাররা এতটা সময় অপেক্ষা করতে চান না। তারা হালকা বা মাঝারি গাড়ির লাইসেন্স ব্যবহার করেই বাস চালান। আর মালিকরাও তাদের মুনাফার স্বার্থে এটা মেনে নেন। দক্ষ ড্রাইভার না থাকার কারণেই বাসের হেলপাররাও এক সময় ড্রাইভিং সিটে বসার সাহস দেখায়।

পরিবহন মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন

পরিবহন মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গি এই খাতের একটি বড় সমস্যা। মালিকরা প্রায়শই প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের বাসকে ড্রাইভারের হাতে তুলে দেন। কন্ট্রাক্ট থাকায় বাস ড্রাইভার বেশি সংখ্যক ট্রিপ মারতে চান, কারণ বাস মালিকের চাহিদা পূরণের পর তাকে প্রতিদিন আয়ের টাকা জোগাড় করতে হয়। এর জন্যই তারা রাস্তায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট বলছে, বাস চালকরা ট্রিপ ভিত্তিক গাড়ি চালায়। অর্থাৎ যত বেশি ট্রিপ তত বেশি টাকা। এটা তাদের ওপর মানসিক একটা চাপ তৈরি করে। কারণ, দিন শেষে ঐসব মালিকদের সাথে চুক্তিমত নির্দিষ্ট অংকের টাকা তাকে বুঝিয়ে দিতেই হয়। সেক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসেবটা আসে পরে। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরে ৩০০ রুটে যানবাহন চলাচল করছে। এসব গণ-পরিবহনের সংখ্যা ৫ হাজার, তার মালিকের সংখ্যা ৪ হাজার। এসব মালিকদের মধ্যে আবার ভাগ রয়েছে।

সড়ক পরিবহন আইন

বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন আইনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে- ১. প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সে পেতে হলে অষ্টম শ্রেণি পাস করতে হবে। ২. কন্ডাক্টর বা চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে, লেখা ও পড়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। ৩. গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। ৪. গাড়ি চালানোর সময় কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড। ৪. চালকদের পয়েন্ট কাটার বিধান রাখা হয়েছে। একজন চালক প্রতিবার আইন অমান্য করলে তার পয়েন্ট বিয়োগ হবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হবে।

৫. ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কেউ এই অপরাধ করলে, তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে। ৬. গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হত্যা করলে ৩০২ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। হত্যা না হলে, ক্ষেত্রে ৩০৪ ধারা প্রযোজ্য হবে। সেক্ষেত্রে শাস্তি যাবজ্জীবন। ৭. বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণে কিংবা প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোর কারণে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪ এর (বি) অনুযায়ী ৩ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হবে। বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং এতে দুর্ঘটনা না ঘটলেও ২ বছরের কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা। ৮. নতুন আইনে সড়কে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো বা রেস করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানারও বিধান রাখা হয়েছে।

৯. আইনে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকার জরিমানা হতে পারে এবং এক্ষেত্রে পরোয়ানা ছাড়াই চালককে গ্রেপ্তারও করা যাবে। ১০. লাইসেন্স-বিহীন গাড়ি চালানোসহ নানা অপরাধে এই আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও, দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু বা ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলে তার বিচার ফৌজদারি আইনেই হবে। ১১. সড়কের ফুটপাতের উপর দিয়ে কোনো ধরনের মোটরযান চালাচল করতে পারবে না। যদি করে, তবে তিন মাসের কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে।

১২. চালকের সহকারীর লাইসেন্স লাগবে। কন্ডাক্টারের লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। ১৩. জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করলে শাস্তি সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানা। ১৪. ফিটনেস না থাকা মোটরযান চালালে শাস্তি সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা। এ শাস্তি পাবে মূলত গাড়ির মালিক। ১৫. গাড়ি ওজন সীমা অতিক্রম করলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানা। এখানে মালিক ও ড্রাইভার দুই গ্রুপকেই যুক্ত করা হয়েছে, তারা দায়ী হবে।

 সড়কের শৃঙ্খলা ফিরাতে পরিকল্পনা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এ আইনে সড়কের শৃঙ্খলা ফিরবে না। গণ-পরিবহনে কোনো আইন দরকার নাই। এটা একটা পরিকল্পনা। বিজ্ঞান বলে পরিকল্পনাটা এমন হতে হবে যাতে সেটি হয় স্ব-নিয়ন্ত্রিত এবং বেশিরভাগই মানতে বাধ্য হবে। এবং বাকি কেউ যদি অপরচুনিস্ট (সুযোগ সন্ধানী) হয়, তাহলে আইন দিয়ে তাকে শাসন করতে হবে। পরিকল্পনাতেই আসল গলদ রয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য আইন প্রণয়নের চেয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদল বেশি প্রয়োজন।

বাংলাদেশে বর্তমান সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা ‘বিশৃঙ্খল এবং উচ্ছৃঙ্খল’ অবস্থায় রয়েছে। গণ-পরিবহন নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করে শুধু আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমস্যার কোনো সমাধান হবে। গণ-পরিবহনের সিস্টেমটা এতো বেশি অপরিকল্পিত যে এখানে হান্ড্রেট পার্সেন্ট যদি ভুল থাকে, তাহলে আপনি শাসন করে কতটুকু উন্নতি করতে পারবেন? সমগ্র ঢাকার বাসগুলোকে যদি একটি কোম্পানির আওতায় আনা যায় তাহলে চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব বন্ধ হবে। পরীক্ষামূলকভাবে এ পদ্ধতি গুলশান এবং হাতিরঝিল এলাকায় সফল হয়েছে। এ ব্যবস্থা ঢাকা শহরে যেদিন থেকে চালু হবে ঠিক তার পরদিনই শহরের রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এজন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।

বাসচালকদের মানসিক অসুস্থতা

অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের শিক্ষক কাজী মো.সাইফুন নেওয়াজ বলছিলেন, দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন একজন বাসচালকের ওপর কতটা চাপ থাকে। গাড়িতে ওঠার আগে দেখা যায় তার পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেই, ১৪/১৫ ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালিয়েছে সে আগের দিন। আবার মালিক বলে দিচ্ছে ‘জমার’ এত টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ, গাড়ি স্টার্ট করার আগেই সে একটা প্রেশারের মধ্যে পড়ে যায়। এরপর একটানা গাড়ি চালানোর ফলে তারমধ্যে ‘ফেটিগ’ বা ক্লান্তি চলে আসে, ফলে তারমধ্যে স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয় মানসিক অসুস্থতা। চালকদের মাদকাসক্তিও বড় রকমের সমস্যা। অনেকে সকাল বেলা নেশা করে গাড়ি চালানো শুরু করে। কোন নিয়ম-কানুন জানে না, শুধু প্রতিযোগিতা।

কাউকে ছাড় দেবে না, ভদ্রতা নেই। কেউ যদি ইমার্জেন্সি লাইট দেয় তাহলেও তাকে সাইড দেয় না। এরা হেল্পার থেকে ড্রাইভার হচ্ছে। বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে টাকা দিয়ে। ওদের মনমানসিকতাই নেই কারণ ওরা যে পরিবেশে থাকে সব ড্রাইভার, হেলপারদের সাথে। ঢাকায় পরিবহন মালিকদের সংগঠন বলেছিল, ঢাকা শহরের পরিবহন শ্রমিকদের প্রায় ৫০% মাদক সেবন করে। এর মধ্যে বেশিরভাগই আবার ইয়াবা খাচ্ছে। এই তথ্যের সাথে একমত হয়েছে অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটও। এটাও তাদের মানসিক বিকাশে চরম বাধাগ্রস্ত করছে। অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট বলছে, ‘যখন রাস্তায় গাড়ি কোনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে আসে – তখন নেশার কারণে কয়েক মুহূর্তের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকে না এসব চালকদের। এর পরিণতি অবধারিত দুর্ঘটনা।’

পাবলিকের অসতর্কতা

পাবলিকেরও একটু সতর্ক থাকতে হবে। প্রত্যেকটা সিগন্যাল ছেড়ে দিলেই দেখা যায়, মানুষ এলোপাথাড়ি দৌড় দিচ্ছে, এটা কিন্তু উচিত না। কারণ সিগনাল ছাড়ার পর একটা গাড়ি টান দিলেই ২০/৩০ মাইল গতি উঠে যায়। ঐ মুহূর্তে ব্রেক করলেও অন্য গাড়ি বা পথচারীর সাথে লেগে যাচ্ছে, অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাচ্ছে। যারা ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিসহ অন্য যানবাহন চালান তারাও রাস্তায় পাল্লা দিয়ে চালান এবং দুর্ঘটনা ঘটে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলছেন, ‘চালকদের মানসিক বিকাশে আর্থ-সামাজিক অবস্থা একটা বড় কারণ। এটা যে একটা সম্মানজনক পেশা – সেটাই আমরা আমাদের দেশে সামাজিকভাবে তৈরি করতে পারিনি। তার অধিকার, তার জীবনবোধ, তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত হলেই কিন্তু একজন ব্যক্তির পেশাগত জীবনে সুস্থতা তৈরি করে। কিন্তু এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতি একজন পরিবহন শ্রমিকের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা এবং অস্বাভাবিকতা তৈরি করতে পারে। একজন পরিবহন শ্রমিক- সব সময় তটস্থ থাকে তার সামাজিক পরিচয় নিয়ে, হীনমন্যতায় থাকে তার আর্থিক অনিশ্চয়তা নিয়ে। এই যদি হয় তার সামাজিক এবং মনজাগতিক অবস্থা, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক কারণ সে সব সময় একটা অস্থিরতার মধ্যে থাকে।’

বাংলাদেশ গণ-পরিবহণের চালক হিসেবে প্রশিক্ষণের প্রচলিত ব্যবস্থা হল ‘ওস্তাদের’ কাছ থেকে শেখা। অর্থাৎ ড্রাইভারের কাছ থেকে হেল্পাররা শেখে এবং এক সময় বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালায়। সেখানে একজন চালক হিসেবে তার শারীরিক সুস্থতা এবং যে গুটিকয়েক বিষয় দেখা হয় – যেটা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। এক্ষেত্রে একজন চালক মানসিকভাবে স্বাভাবিক কিনা, রাস্তার গাড়ি চালানোর সাধারণ নিয়ম-কানুন বা সহনশীলতা এবং অন্যের জরুরি প্রয়োাজনকে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রবণতা সম্পর্কে আদৌ কোন জ্ঞান আছে কিনা – সেটা পরীক্ষা করা হয় না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ এর রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক শেখ মো. মাহবুবে রাব্বানী বলেন, ‘যারা এই পেশায় আসছে তাদের রুটটা ভালো না। তাদের পড়াশোনা নেই আবার থাকে বস্তিতে। তাই তাদের কাছ থেকে সেই আচরণ আশা করা যায় না। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় তাদের মানসিক বিকাশ সম্ভব না। বিদেশে যে প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স দেয়া হয় বাংলাদেশে সেটা হয় না।’

আসলে রাস্তায় যানবাহন যদি সতর্ক অবস্থায় চলাচল করে, সবাই যদি ট্রাফিক আইন মেনে চলে, ট্রাফিক পুলিশ যদি মোটরবাইক ও গাড়ির কাগজপত্র সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, পথচারীরা যদি জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারসহ ট্রাফিক নিয়মের ব্যাপারে সচেতন থাকে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার না হন, বৈধ কাগজপত্র না থাকলে বা চালকের লাইসেন্স না থাকলে যদি মোটর বাইক-সিএনজি-অটোরিক্সা থেকে শুরু করে সরকারি স্টাফবাস চালাতে দেয়া না হয় তবে দুর্ঘটনা কমে আসবে।

রাস্তায় দেখছি পুলিশ বাইকগুলোকে দাঁড় করিয়ে কাগজপত্র দেখছে। এই জন্য কিছুটা নিয়ম হয়তো কেউ কেউ মানছেন। তবে বাসগুলো ওই আগের মতো রাস্তার মাঝখান থেকেই লোক তুলছে। ইচ্ছামতো চলছে। যে সব গাড়ির লাইসেন্স, ফিটনেস, ইনস্যুরেন্স, রুট পারমিট বা চালকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই, মোটরসাইকেলে তিনজন ও হেলমেট ছাড়া যারা সড়কে নামেন, বা কোন আইন লঙ্ঘন করছেন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনানুযায়ি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করছি। তবে সবাইকে হাতে ধরে ধরে আইন শেখানো সম্ভব না। এক্ষেত্রে নাগরিকদেরও সেটা মেনে চলার মানসিকতা থাকতে হবে।

চালকদের জন্য মাসিক নির্দিষ্ট আয়ের ব্যবস্থা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহর যেহেতু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে সেজন্য এখানকার রাস্তার নেটওয়ার্কও পরিকল্পিত নয়। ঢাকা শহরে উত্তর-দক্ষিণ মুখী সড়ক বেশি থাকলে পূর্ব-পশ্চিমমুখী সড়ক কম। সড়ক নেটওয়ার্ক ভালো না থাকায় ট্রাফিক সিগন্যালও কার্যকরী হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই একই রাস্তায় বিভিন্ন আকারের যানবাহন চলে না। কিন্তু ঢাকা শহরের রাস্তায় ছোট-বড় নানা ধরনের যানবাহন একসাথে চলাচল করে। এ কারণে ঢাকা শহরে লেন মেনে গাড়ি চালানো সম্ভব হয় না।

পরিবহন ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চাইলে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকা শহরে ২৭৯টি বাস রুট রয়েছে। ঢাকার মতো ছোট একটি শহরে এতো বাস রুট থাকার প্রয়োজন নেই। পুরো শহরকে বাস চলাচলের জন্য চার থেকে পাঁচটি রুটে ভাগ করে প্রতিটি রুটের জন্য একটি করে বাস কোম্পানি গঠন করা যেতে পারে। বর্তমানে যারা মালিক আছেন, তারাই এসব কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার হবেন। এরপর আনুপাতিক হারে মালিকদের মধ্যে মুনাফা বণ্টন করা যেতে পারে। বাস চালকদের জন্য মাসিক নির্দিষ্ট আয়ের ব্যবস্থা থাকবে। তখন চালকের মধ্যে বেপরোয়া ভাব আসবে না। তখন সড়কের শৃঙ্খলা কিছুটা সম্ভব হবে।’

সড়কে কিছু শৃঙ্খলা ফেরানো

ভারতের মুম্বাই শহরের উদাহরণ দিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, মুম্বাই শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব ঢাকার মতোই। কিন্তু সেখানে মাত্র ৩৬০০ বাস প্রতিদিন ৪৮ লক্ষ যাত্রী পরিবহন করে। অন্যদিকে ঢাকায় রয়েছে ৬ হাজার বাস। এগুলো প্রতিদিন ৩০ লক্ষ যাত্রী পরিবহন করছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি বাস ৫০০ যাত্রী পরিবহন করছে। কোম্পানি গঠনের পদ্ধতি অনুসরণ করলে ৬ হাজার বাস দিয়ে আরো বেশি যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে এবং তখন সড়কে কিছু শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
বাংলাদেশের সরকারি রেকর্ডে সড়কে যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনার উল্লেখ করা হয়, বাস্তব সংখ্যাটা তার চেয়ে অনেক বেশি। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার তাগিদ দিয়ে বহুবছর ধরে প্রচারণা চালাচ্ছেন ইলিয়াস কাঞ্চনসহ অনেকেই। কাঞ্চনের মতে- ‘নানাবিধ কারণে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অদক্ষ চালক, চালকদের লাইসেন্স না থাকা ও লাইসেন্স তৈরির প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি। গণপরিবহনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব। ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ, বাস্তবায়নে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা।’

দুর্ঘটনার পর আইনি সহায়তা নেয়া

বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মোজাম্মেল হক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মাত্র ২০% তাদের দুর্ঘটনার পর আইনি সহায়তা নিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর মোবাইল কোর্টের কার্যক্রমও বৃদ্ধি করা দরকার। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা প্রবল। পথচারীদের আইন না মানার প্রধান কারণ সময় বাঁচানোর চেষ্টা এবং অলসতা। নিয়ম মেনে একটু বেশি হেঁটে গিয়ে কিছুটা বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে রাজী হন না অধিকাংশ পথচারীই। যারা ট্রাফিক আইন ভাঙে তাদের অনুসরণ করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকলেও নিয়ম মেনে চলা মানুষদের খুব কম সংখ্যক লোকই অনুসরণ করে।

 সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব দূর করা

নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ ড: আদিল মোহাম্মদ খান বলছেন, ‘কোনো ধরনের সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি হচ্ছে বলে অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজই শতভাগ কাজে লাগানো কঠিন। কোথায় ফুটওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস দরকার সেটি যদি একটা পরিকল্পনা করা যেতো। ফুটওভার ব্রিজ এডহক ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। সেজন্য দেখা যায় এগুলো ইন্টারসেকশন থেকে অনেকটা দুরে করা হয়। আবার উচ্চতার কারণেও অনেকে উঠতে চান না – যেটি ডিজাইনের বিষয়। শুধু ঢাকা নয়- নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের অন্য ঘনবসতিপূর্ণসহ শহরগুলোতে আন্ডারপাস ও ফুটওভারব্রীজ নির্মাণের ক্ষেত্রে এখন থেকেই সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া দরকার। তা না হলে হুট করে যেমন নির্মাণের প্রবণতা থাকবে তেমনি আবার ভেঙ্গে ফেলারও দরকার হবে – যেমন মেট্রো রেলে নির্মাণের কারণে হুমকিতে পড়তে পারে ঢাকার বেশ কিছু ফুটওভারব্রীজ ও ফুটপাথ।’

ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশন এবং সড়ক জনপথ বিভাগের আওতায় ফুটওভার ব্রিজ আছে প্রায় একশ। আর আন্ডারপাস আছে তিনটি। কিন্তু এগুলো খুব একটা ব্যবহার হতে দেখা যায় না। মুল সড়কেও আবার সিগন্যাল ও রোড সাইন নেই। তাই প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। একদিকে ফুটওভারব্রীজ কিংবা আন্ডারপাস ব্যবহারে আগ্রহ কম। অন্যদিকে ওভারব্রিজে ‘উল্টাপাল্টা লোকজন’ থাকে বলে নারী ও শিশুরা নিরাপদ বোধ করে না। ফুটওভারব্রিজে বখাটেদের হাতে নারীদের হেনস্থা হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায় প্রতিনিয়ত। সন্ধ্যার পর লোকজন না থাকলে উঠতে ভয় পান। ওখানে হকাররা শুয়ে থাকে, মাদকসেবীরা থাকে। অনেক সময় ছিনতাই হয়। অনেক ওভারব্রিজে লাইট থাকে না। আবার যেখানে ফুটওভারব্রীজ দরকার সেখানে হয়তো সেটি নেই। অনেকটা দুরে হওয়ার কারণে তারা ফুটওভারব্রীজ ব্যবহার না করে অনেক সময় হেঁটেই রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করেন।

ফুটওভারব্রীজগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেছেন, ‘ফুটওভারব্রীজগুলোর শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পথচারীদের আরো বেশি সচেতন হওয়া দরকার। দু’ একটি ক্ষেত্রে এমন হয় যে পথচারীরা কোনো ওভারব্রিজ কম ব্যবহার করেন। হয়তো মনে হয় – সেগুলো ওখানে না হলেও হতো। কিন্তু পথচারীরাও নিরাপদে রাস্তা পার হওয়ার জন্য একটু এগিয়ে এসে এগুলো ব্যবহার করতে পারেন। আমরা তাদের সচেতন করারই কাজ করছি।’

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের করণীয়

দূরপাল্লার যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কিছু করণীয় রয়েছে। এক্ষেত্রে গাড়ি চালকদের প্রতি পরামর্শ হচ্ছে- ১. গাড়ি চালানোর সময় গতিসীমা মেনে চলুন। ২. ঘনঘন লেন পরিবর্তন করা থেকে বিরত থাকুন। ৩. অযথা ওভারটেকিং করা থেকে বিরত থাকুন এবং সতর্কতার সাথে ওভারটেকিং করুন। ৪. স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের লোগোসহ স্থানীয় স্টিকার ব্যতীত আলগা/অস্থায়ী যে কোনো ধরনের স্টিকার ব্যবহার হতে বিরত থাকুন। ৫. দূর্ঘটনা প্রতিরোধে গাড়ির যন্ত্রাংশ চেক করে নিন। ৬. উল্টো পথে যে কোনো যান চালানো থেকে বিরত থাকুন। ৭. গাড়ি চলাচলের নির্ধারিত পথে গাড়ি পার্ক করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না।

৮. ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করবেন না। ৯. ক্লান্ত/অসুস্থ/মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো হতে বিরত থাকুন। ১০. সর্বদা বাম লেন চালু রাখুন। ১১. ইন্টারসেকশনে এবং রাস্তায় যাত্রী উঠানো/নামানো হতে বিরত থাকুন। ১২. ট্রাফিক আইন ও সিগন্যাল জানুন এবং মেনে চলুন। ১৩. বাস-বে/নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করবেন না। ১৪. গাড়ি থামানোর ক্ষেত্রে সর্বদা রাস্তার বাম ঘেঁষে থামাবেন। ১৫. ডানে/বামে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইন্ডিকেটর ব্যবহার করুন। ১৬. গাড়ি চালানোর পূর্বে গাড়ির সমস্ত কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে নিন এবং হালনাগাদ কাগজপত্র সাথে রাখুন। ১৭. অযথা হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকুন। ১৮. সিটবেল্ট বেঁধে গাড়ি চালান। মোটরসাইকেলে চালক এবং আরোহী উভয়েই হেলমেট ব্যবহার করুন।

 

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *