যোগ্যতাসম্পন্ন ও সৎ প্রজন্ম ভবিষ্যতে গড়ার কাজ শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবার হলো প্রজন্ম গড়ার সূতিকাগার আর পিতা-মাতারা হলেন তার কারিগর। প্যারেন্টিংয়ে সুদক্ষ পিতা-মাতা সন্তানদের জীবনকে পরিবার-দেশ-জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে গড়তে পারে। প্রত্যেক পিতা-মাতাই চায়- সন্তান সেরা হোক, সুখী ও ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ হোক, গর্বের কারণ হোক। এজন্য সন্তানের সাথে শান্তিপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি, সঠিকভাবে গড়ে তোলা ও লালন পালনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করতে হয়। জন্মের আগেই প্যারেন্টিং সম্পর্কিত জ্ঞান ও কলাকৌশল ভালোভাবে জানলে সন্তানরা জীবনে সফল হতে পারে এবং পিতা-মাতার জন্য গর্বের কারণ হতে পারে। সন্তানের কল্যাণে পজেটিভ প্যারেন্টিং এর এত বেশি গুরুত্বের কারণেই প্যারেন্টিংকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছেন অনেক সচেতন সমাজকর্মীরা।
প্যারেন্টিং একটি বিজ্ঞান-শিল্প-আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা
প্যারেন্টিং ততক্ষণ বেশ সহজই মনে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এর গুরুত্ব ও কিভাবে সেটা করতে হয় তা উপলব্ধি করতে না পারি। এ উপলব্ধি আসার মুহূর্ত থেকেই এটি কঠিন মনে হতে থাকে। প্রতিটি বিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজন হয় পদ্ধতি, কাঠামো, কৌশল এবং অনুমানের। একটি শিল্পের জন্য প্রজ্ঞা, কৌশল, অন্তর্দৃষ্টি, প্রেম এবং কমনসেন্স প্রয়োজন। শিশু লালন পালন একটি বিজ্ঞান, একটি শিল্প, এবং একটি আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা। প্যারেন্টিংয়ে ভুল করা যাবে না।
প্যারেন্টিং একটি যথাসময়োচিত কাজ
প্যারেন্টিং একটি যথাসময়োচিত কাজ। প্যারেন্টিং এমন বিষয় নয় যে আমরা এটা শিখে নিয়ে তারপর শুরু করি বরং এটা শুরু হওয়ার পর করতে করতে শিখি। উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে: প্যারেন্টিং হলো জন্ম থেকে একজন শিশুকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা ও নির্দেশনা দিয়ে একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। প্যারেন্টিং বলতে কেবলমাত্র সন্তান জন্মদান বা তার সাথে রক্তের সম্পর্কই নয়, বরং তাকে লালন-পালন করাটাও বুঝায়।
সন্তান লালন-পালনে অনেক ভুল
চিলির নোবেল বিজয়ী নারী কবি জি. মিস্ত্রাল বলেন, ‘আমরা সন্তান লালন-পালনে অনেক ভুল করে থাকি। সবচেয়ে বড় ভুল হলো সঠিক সময়ে সন্তানদের প্রয়োজনকে পূরণ না করা, তাদেরকে উপেক্ষা-অবহেলা করা, তাদের জীবনের প্রবাহের চাহিদাকে সময়মত গুরুত্ব না দেয়া। জীবনের অনেক কাজ পরে করলেও চলে, কিন্তু সন্তানদের বিকাশের চাহিদাকে অপেক্ষমাণ রাখা যায় না। যখন তার হাড় শক্ত হচ্ছে, তার শারীরিক আকৃতি গঠিত হচ্ছে, তার মন গঠন-প্রকৃতি লাভ করছে তখন আমরা এই প্রক্রিয়াকে বলতে পারি না- আজ এগুলো থাক, আজ আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, কাল এগুলো করা যাবে। এসবের জন্য আজকের দরকারি কাজগুলো আজই সারতে হবে।’
সঠিক প্যারেন্টিংয়ের জন্য দরকার প্রস্তুতি
সঠিক প্যারেন্টিং জাতিগঠনের মূলসূত্র, পরিবারের মূল প্রাণশক্তি বা চালিকাশক্তি। প্যারেন্টিং পরিবারকে যথাযথভাবে কার্যকর বা সক্রিয় রাখে এবং সমাজ মানস গঠনের মূল জায়গাটিতে অবস্থান করে। সন্তান প্রতিপালন একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ হলেও এটা সবচাইতে উপভোগ্য, উদ্দীপনাময় ও সর্বোপরি আনন্দদায়ক এক অভিজ্ঞতা- যার স্বাদ আমরা সবাই পেতে চাই। সমাজ মানসের যথার্থ পরিগঠন, উন্নয়ন ও বিকাশে পরিবার যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে; তেমনি এর দীনতা, বিকৃতি, ভাঙন ও বিপর্যয়ও মূলত পরিবার থেকেই শুরু হয়। বাবা-মায়ের ভুলে সন্তানের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দক্ষতার সাথে প্যারেন্টিং করতে না পারায় পরিবারের বড় ক্ষতি হয়ে যায়। ঐশীর হাতে তার জন্মদাতা বাবা-মা একসাথে খুন হয়েছে। ক্রমবর্ধমান মাদক, অশ্লীলতা ও সহিংসতার ছোবলে তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে সমাজ মানসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসুস্থতা, অস্থিরতা ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে তা রোধ করা না গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
বয়স বিবেচনায় যত্ন বদলান
বাবা-মাকে জানতে হবে শিশু ০-৬ মাসে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল হয় এবং আদরের সাথে আরামে খেতে, স্পর্শ পেতে চায়, ঘুমোতে চায়। এইস্তরে শিশুর প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ না হলে, আনন্দে কাটাতে না পারলে, সবাই তাকে ভালোভাবে গ্রহণ না করলে এরা বড় হয়েও যা অনুভব করে তা প্রকাশ করতে পারে না বা নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকে না। ৬-১৮ মাসে শিশু সক্রিয় হওয়া শিখে। দাঁড়ায়, হাঁটে, স্পর্শ করে, অনুভব করে, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার করে, আপনজনকে চিনতে ও বিশ্বাস করতে শিখে। ১৮ মাস-৩ বছরে শিশুর চিন্তাশক্তি প্রখর হয়। এই স্তরে যে শিশু বাবা-মায়ের সাপোর্ট ও উৎসাহ না পেয়ে ভীষণ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে বড় হয়, সে বড় হয়েও যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।
৩-৬ বছরে শিশু নিজের সম্পর্কে ও অপরকে জানতে আগ্রহী হয়, বেশি প্রশ্ন করতে শেখে, সামাাজিকতা বৃদ্ধি পায়, স্বপ্ন দেখতে শিখে। এসময় প্রশ্নের উত্তর না পেলে তারা কল্পনাপ্রবণ, অজানা ভয় কিংবা অহংকারী হয়। ৫-১২ বছরে শিশুর কোনো কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে, কোনো কাজে দক্ষতা অর্জন করে, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা হয়, নিজের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। ১৩-১৮ বছরে শিশু দায়িত্ব নিতে শিখে, ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে, লিঙ্গের পার্থক্যের অভিজ্ঞতা অর্জন করে ও শারীরিক পরিবর্তন অনুভব করে। ১৮-পরবর্তীতে সন্তান প্ল্যান অনুযায়ী এগোতে চায়, সামনে এগিয়ে যায়, সংসারে অবদান রাখতে চায়। আপনি নায়ক তৈরি করছেন না, সন্তান লালন-পালন করছেন। সন্তানদেরকে সন্তান হিসেবে বড় করুন, তারা নিজেরাই নায়কে পরিণত হবে; অন্তত আপনার কাছে।
নিজেরা দুর্নীতি মুক্ত থাকুন
বাবা-মাকে মানসিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে হয়, মজবুত ও সুস্থির আবেগ দেখাতে হয়; কারণ তাদেরকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখলে শিশুর জগৎ অস্থিতিশীল হয়ে পরে। মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দিলেও নষ্ট হয়ে যাবার ঝুঁকি বাড়ে। বিবাহ বিচ্ছেদ করলেও সন্তানদের কোনো একপক্ষ নিতে বাধ্য করবেন না; কারণ উভয়ের প্রতিই অপরিমেয় অনুরাগ থাকায় একজনের পক্ষ নিয়ে অন্যকে সরিয়ে দেয়া তাদের জন্য কষ্টকর। অনেক বাবা-মা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বৈধ-অবৈধ বাছ-বিচার না করে ছেলেমেয়েদের প্রতি অত্যধিক ভালোবাসার কারণে অর্থ উপার্জনের নেশায় পাগল থাকে, এমনভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে যা তার বা তার পরিবারের লোকেরা খেয়ে শেষ করতে পারবে না; অত্যধিক সম্পদের লোভ ও প্রাচুর্য তাকে ভোগবাদ, দুর্নীতি ও চরিত্রহীনতার দিকে টেনে নেয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে, যাদের জন্য সে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে সেই সন্তান-সন্ত্বতি ও আপনজনরা কিন্তু দুর্নীতিবাজ পিতা-মাতা বা আত্মীয়কে কখনো মন থেকে সম্মান করতে পারে না বরং মনে মনে ঘৃণা করে। সমাজ ও মানুষের ঘৃণাই হচ্ছে এসব লোকের ভাগ্যলিপি।
অপরাধে জড়াতে দেবেন না
সন্তান যাতে মাদকাসক্ত না হয়, যৌনবাহিত রোগ, ক্রাইম বা বিষণ্নতার মতো কঠিন সমস্যার মুখোমুখি না হয় সেটি নিশ্চিত করতে যথাযথ প্যারেন্টিং দরকার। এখনতো ছেলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য পিতার হাতে হাতকড়া লাগানো হচ্ছে, পিতাকে জেল খেটে পুলিশের বেতের আঘাত সহ্য করতে হচ্ছে। সন্তানের হাতে পিতা-মাতাকে খুন হতে হচ্ছে। মেয়ের অনৈতিক প্রেমের দরুন পিতা-মাতাকে জীবন দিতে হচ্ছে! পরকীয়ার কারণে সাজানো গুছানো সুখের সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। স্বার্থপরতার কারণে ছেলে-মেয়েরা উচ্চ ডিগ্রিধারী ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে বা আশ্রয় কেন্দ্রে বা সরকারের বয়স্ককালীন ভাতা নিয়ে দুমুঠো ভাতের যোগান দিতে হচ্ছে। ফলে প্রত্যেক পিতা-মাতাই সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন, ব্যস্ত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। অথচ সন্তান লালন-পালনে সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিকল্পনা থাকলে, তাত্ত্বিক ও বাস্তব জ্ঞান থাকলে, পর্যাপ্ত সময় ও শ্রম দিয়ে চেষ্টা করলে এবং সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যপদ্ধতি থাকলে হয়তো এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না।
পরিকল্পিতভাবে সময় দিন
ভালো প্যারেন্টিং এর গুরুত্ব ও প্রভাব অনেক বেশি; চ্যালেঞ্জিং এই কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি ও অখণ্ড মনোযোগের দরকার হয়। শিশুদের গল্প বলার ক্ষেত্রে সময়জ্ঞানটা জরুরি। তাদের শিক্ষণীয় কিছু বলার ক্ষেত্রে তা বয়সোপযোগী কিনা তা মাথায় রাখতে হবে। এমন গল্প বলা যাবে না, যা তাদেরকে ভয়-কাপুরুষতা-কপটতা শিখায়। অপরাধ ও অপরাধীকে ঘৃণা করতে শেখালে ভালোবেসে ভুল শুধরানোর পরিবর্তে ঘৃণা করতে শেখে; নিজেদের অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং অহংকারী ও দাম্ভিক হয়ে ওঠে। ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্কও হৃদয় ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তন করে। সন্তানদের সবকিছু দিলেই হবে না, সময় দিতে হবে।
পরিবর্তিত বাস্তবতা বুঝুন
প্যারেন্টিং শব্দের সাথেই পরিচিত ছিলেন না তাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্য থেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বড় আমলা কী হননি? অবশ্যই হয়েছেন। কিন্তু সেই সময়ে হাতে হাতে স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও মোবাইল ছিল না। পর্নোগ্রাফি ছিল না। পরকীয়া বা প্রেমের যোগাযোগ সহজ ছিল না। ডিশ-টিভি সহজলভ্য ছিল না। ফলে বই পড়া, ডাক টিকিট সংগ্রহ করা, ফুলের বাগান করা, ফলের গাছ লাগানো, মাছ ধরা, কবুতর ও টিয়া পাখি পালন ছিল ছোটদের শখ। এখন যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ায় জীবন ও জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে যতটা না ছেলেমেয়েরা সচেতন হতে পারছে; তারচেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী হচ্ছে রঙিন কল্পনা ও আবেগের জগতের প্রতি। টিনএজার সন্তানের সাথে প্রতিদিন একান্তে কিছু সময় কাটান। অভিভাবকের পাশাপাশি বন্ধু হন। তার উপর আস্থা দেখান। নীতিগত বিষয়ে কঠোর থাকুন। তার কাজে আগ্রহ দেখান। সীমাবদ্ধতার রেখা টানুন। কিছু বিদ্রোহ স্বাভাবিক, মেনে নিন। নিজের ভুল স্বীকার করে, শুধরাতে শিখান। পারিবারিক বন্ধনকে অগ্রাধিকার দিন। তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করুন।
দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে তুলুন
সন্তানকে দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে কার্যকরী যোগাযোগ। বাবা-মাকে জানতে হবে- কখন ও কিভাবে সন্তানের সাথে কথা বলতে হয়, কিভাবে ধৈর্য ধরে সন্তানের কথা শুনতে হয় এবং সন্তানকে বুঝার চেষ্টা করতে হয়। সন্তানের ভিতরের সম্ভাবনার বিকাশ চাপ প্রয়োগ করে হবে না। গৃহ আবাসিক হোটেল আর রেস্তোরাঁ নয়,গৃহকে সৃজনশীল প্লাটফর্ম বানান। সন্তানকে খাবার, কাপড়, খেলনা, টাকা-পয়সা দিলেই তার প্রয়োজন পূরণ হয় না; তাদের পেছনে বাবা-মার সময় বিনিয়োগ করতে হবে। ইতিহাস, সংস্কৃতি জানাতে হবে ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। তার লেখাপড়ার দেখাশুনা করুন, রেজাল্টের খোঁজ খবর রাখুন, মাঝে মাঝে স্কুলে যান, সাথে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়ান এবং উপহার দিন। তার শারীরিক, মানসিক, আবেগিক ও সামাজিক প্রয়োজন পূরণ করুন। মা-বাবার উচিত সন্তানের পাশাপাশি নিজেদের যত্নটাও নিশ্চিত করা; সন্তানকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে গুরুত্ব দিয়ে আত্মবিসর্জন দেয়া নয়।
ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করুন
ভালোবাসাপূর্ণ একটা উষ্ণ পরিবেশে শিশুরা পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে। কাজের লোক, স্কুল শিক্ষিকা, আত্মীয়, নিকটজন, টেলিভিশন বা কম্পিউটার গেমের ওপর প্যারেন্টিং এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পুরোপুরি ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়; এতে শিশুর চরিত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একটি সভ্যতার বিকাশ বা ধ্বংসের বীজ নিহিত থাকে প্যারেন্টিং পদ্ধতির অভ্যন্তরে। অবাধ্য হলেই কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা কিংবা যেমনটা চায় তেমনটা করার অনুমতি দেয়া কোনোটাই ঠিক না। সন্তানদেরকে নিয়ম-নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া, নিয়ম-শৃঙ্খলার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা, আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত করা উচিত।
আধিপত্য বিস্তারের জন্য আধিপত্যসুলভ ও কড়া শাসনমূলক আচরণ করা সন্তানকে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গড়তে দেয় না; বিশ্বাস ও ভালোবাসা বিবর্জিত ভয়নির্ভর ফাঁপা সম্মান তৈরি হয়। তাই তাদের সাথে তাদের লেভেল অনুযায়ী কথা বলুন, তাদের প্রতি স্নেহশীল হোন, কথা বলার সময় আলতো করে তাদের মাথায় হাত রাখুন, ভালোবাসাপূর্ণ স্পর্শ দিন; যাতে তারা আপনার সাথে শক্ত বন্ধন অনুভব করে সহজে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। শিশুদের ওপর রেগে গিয়ে নির্দয়ভাবে আক্রমণ করলে শিশুটি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে লুকানোর চেষ্টা করে, আক্রমণের দুঃস্বপ্ন প্রতিদিন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। বাবা-মা নিন্দা করলে হীনমন্যতা ও অযোগ্যতার অনুভূতি তৈরি করে।
আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলুন
সন্তানকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলতে হবে ও বাবা-মায়ের সাহায্য ছাড়াই চলার শিক্ষা দিতে হবে। পরিবারেই মর্যাদা, সাহস, আত্মশৃঙ্খলা, ভালোবাসা, সমবেদনা, পারস্পরিক নির্ভরতা ও দায়িত্ববোধ শেখাতে হবে। বাচ্চাদেরকে গুণগত যথার্থ সময় দেয়ার মানে শুধু তাদের কাছাকাছি থাকা নয় বরং তাদের সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা। বিবাহ বিচ্ছেদ, একক বাবা বা মা ও কর্মজীবী মায়েদের সংখ্যা বাড়ার ফলে অনেক সন্তান চাইল্ড হোমে বা কাজের বুয়ার কাছে বেড়ে উঠছে। অথচ একটি জাতিকে বদলাতে চাইলে ঘরগুলোকে আগে বদলাতে হবে, পরিবারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। মুসলিম পরিবারে নবজাতকের কানে আজান দেয়া, ভালো অর্থবোধক নামকরণ করা ও আকিকার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। বাবা-মা উভয়কেই তাদের সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখতে হয়, সন্তানদের স্বার্থে নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দেয়ারও প্রয়োজন হয়; কারণ সন্তানই জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।
তাইতো কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘পরিবারের দিকে খেয়াল দাও, দেখবে সমাজ আপনা থেকেই ঠিক হয়ে গেছে’।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট বলেন, ‘আমি এ দুটির যেকোনো একটি দায়িত্ব নিতে সক্ষম, হয় আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেব অথবা এলিসের পিতার দায়িত্ব পালন করব। দুটি একসঙ্গে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
ব্রিটিশ অফিসার ওয়াভেল (১৮৮৩-১৯৫০) বলেছিলেন, ‘লক্ষ লক্ষ লোকের জন্য আমার একটি নির্দেশই যথেষ্ট, কিন্তু আমি আমার তিন কন্যাকে কিছুতেই সময়মত নাস্তার টেবিলে আনতে পারি না।’
ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখান
নতুন প্রজন্মকে ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখান। সন্তানদের তৈরি করুন ভালো মানুষ হিসেবে, চেনান সঠিক পথ। ছেলে-মেয়ে যাতে তাদের পূর্ণ প্রতিভায়, মমতায় ও সকলের ভালোবাসায় গুণী ও আলোকিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সন্তান কী চায় সেটা খুঁজে বের করে ওকে সেই কাজে সহায়তা করুন। একজন সুপুত্র বা একজন সুকন্যা যেমন চক্ষু শীতলকারী হতে পারে তেমনি একজন খারাপ সন্তানের বাজে স্বভাবে বাবা-মার জীবন থেকে শান্তি বিদায় নিতে পারে। উত্তম আচরণের মাধ্যমে সন্তানদেরকে ধরণীর আসল রূপ চেনান, যাতে তারা মর্যাদাজনক জীবন গড়তে পারে। মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে- পরীক্ষায় বেশি মার্কস পাওয়া মানেই বেশি বুদ্ধিমান বা মেধাবী নয়, পরীক্ষায় সফলতা মানেই জীবনে সফলতা নয় আর ভালো ডিগ্রিই ভালো চাকরির গ্যারান্টি নয়।
শিশুকে শিশুর মতো করে বাঁচার পরিবেশ দিন, জীবনকে উপভোগ করার সুযোগ দিন। শুধু জাহান্নাম বা নরকের ভয় দেখালে শিশুরা আতঙ্কগ্রস্ত ও ভিতু হিসেবে বেড়ে উঠে, তাদের মধ্যে নেতিবাচক মানসিকতা জন্মায়, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয় এবং ধর্মের প্রতি নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। তাই শিশুদেরকে স্রষ্টার ভালোবাসা-দয়া-সমবেদনার কথা জানাতে হবে, স্বর্গ বা জান্নাতের সৌন্দর্যের কথাও বলতে হবে এবং ভালো কাজে পুরস্কারের কথাও বুঝাতে হবে। নিরাপত্তার অনুভূতি, ভালোবাসা, দয়া, মমতা, ক্ষমাশীলতা, ধৈর্যশীলতা, কোমলতা, মহত্ত্ববোধ, উদারতা ও সহানুভূতি ধীরে ধীরে শিশুদের মনে প্রবেশ করাতে হবে। শিশুরা ভুল করলে রাগ না করে বুঝাতে হবে এবং ভুলের জন্য অনুশোচনা ও খারাপ কাজ থেকে সংযত হবার শক্তি তৈরির স্বার্থেই যতক্ষণ না শিশু ক্ষমা চাইবে ততক্ষণ দৃঢ় থাকতে হবে; ক্ষমা চাইলে ভালোবাসতে হবে।
পক্ষপাতমূলক আচরণ নয়
সন্তানের সুন্দর ও অর্থপূর্ণ নাম রাখা, নৈতিক আচরণ শিখানো এবং কথা ও আচরণে সঙ্গতি রাখা প্রয়োজন। সন্তানকে অশুভ ও কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে হবে; নোংরা ও খারাপ মন, কু-ভাষী, পাপাচারী ধূর্ত দৃষ্টি শিশুর সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক ইন্দ্রিয়ের ক্ষতিসাধন করতে পারে। তাছাড়া বাবা-মা পক্ষপাতমূলক আচরণ করলে সন্তানদের মনে ঈর্ষার অনুভূতি জাগে; সমান চোখে দেখা, আচরণে সমতা বিধান, একজনকে আরেকজনের উপর প্রাধান্য না দেয়া উচিত। বাবা-মা সন্তানদের একজনকে অগ্রাধিকার দিলে হিংসা বিদ্বেষের উত্থান ঘটে, তাদের প্রতি সন্তানদের শ্রদ্ধা-সম্মান কমে যায় ও ভাই-বোনদের পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। শিশুদের মাঝে আস্থাবোধ সৃষ্টি করা, তাদের জ্ঞাতব্য বিষয়ে নির্দেশ দেয়া, অদরকারি বিষয় না জানানো, শুধু প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অবহিত করা উচিত।
কথায়-কাজে মিল রাখুন
বাচ্চারা অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে বাবা-মায়ের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। সন্তানদের সঠিক পথে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য বাবা-মা সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন বাবা-মা সন্তানের সাথে যা বলেন, সেটা নিজেরা করেন। বাবা-মা কোনো বিষয় সন্তানকে শতবার বলার পরও সন্তান শুনবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চিত থাকতে পারেন। কিন্তু বাবা-মা যদি একবার তাদের কথামতো কাজ না করেন, তাহলে সেটাই সন্তান দেখিয়ে দেবে। সন্তানরা বাবা-মার সমস্ত কাজই খেয়াল করে, এমনকি যখন বাবা-মা এটা চিন্তাও করে না যে, তারা সেটা লক্ষ্য করছে। তাই নিজেরা জীবনে অনুসরণ না করে সন্তানদের তা অনুসরণ করতে বলা ঠিক না।
ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে সন্তানদের সততা ও নম্রতা সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। বাবা-মা ভুল স্বীকার করলে ও ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চাইলে সন্তানরা ভুল গোপন করা শিখবে না। বাবা-মা সন্তানদের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং বাবা-মাকেই তারা সবসময় দেখে। বাবা-মা হলো একটা খোলা বইয়ের মতো, যেখান থেকে সবসময় সন্তানরা শিক্ষা নেয়। তাই পিতা-মাতাদের সতর্ক ও দায়িত্ববান হওয়া প্রয়োজন।
সন্তান যদি শোনে বাবা মাকে বলছেন, ‘তাকে বলো আমি ঘরে নেই’ কারণ আপনি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে চান না, তা হলে আপনার সেই সন্তান সত্যবাদী হবে এমনটা আশাও করতে পারেন না। শুধু হিতোপদেশ নয়, সন্তানদের সাথে কথায় ও কাজের মিলের মাধ্যমে সত্যকে প্রত্যক্ষ করে তুলতে হবে। কথায়-কাজে মিল যদি না থাকে তাহলে সন্তানদের সঠিক পথে চালানোর নৈতিক শক্তি প্যারেন্টরা হারিয়ে ফেলবে।
অন্যের ঋণ স্বীকার করা শিখান
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অপরাধপ্রবণ নয়, স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ ন্যায়ের ওপরই থাকতে চায় কিন্তু পারিপার্শ্বিকতাই তাকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। মাদকের ছোবল, পর্ন, সন্ত্রাস থেকে সন্তানকে বাঁচাতে হলে রোল মডেল হতে হবে পিতা-মাতাকেই। শুধু ক্যারিয়ার গঠন, শুধু অর্থ উপার্জন, উদরপূর্তি ও বৈষয়িক প্রতিপত্তি অর্জনকে শিক্ষার লক্ষ্য না বানিয়ে দেহ, মন ও আত্মার উন্নতির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হতে হবে। শি জিনপিংকে তার বাবা৯৬ বলেছিলেন, ‘কৃতজ্ঞতা এবং ঋণ স্বীকার করা মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তুমি জীবনে যদি অন্যের জন্য ভাব, অন্যকে দাও, জীবনও তোমার কথা ভাববে, তোমাকে আরো বহুগুণে ফিরিয়ে দেবে।’
সঠিক চিন্তা করতে শিখান
শিশুদের বেড়ে উঠতে উঠতে আমরা শেখাই কিভাবে দাঁড়াতে হয়, হাঁটতে হয়; আর একটু বড় হলে শেখাই কিভাবে বর্ণমালা লিখতে হয়, বাক্যগঠন করতে হয়, রচনা লিখতে হয়; আরেকটু বড় হলে আর্ট বা সংগীত বা ক্রীড়া শিক্ষাকেন্দ্রে শিখতে পাঠাই কিন্তু আদর্শ মানুষ হতে হলে কিভাবে সঠিক চিন্তা করতে হয় তা শেখাই না। অথচ সঠিকভাবে চিন্তা করতে শেখানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে পজিটিভ চিন্তা করতে হয়, কিভাবে ভালো চিন্তা করতে হয়, কিভাবে কল্যাণকামী হওয়া যায়, সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়, অন্যের ভালোতে ভালোলাগা, অন্যের কল্যাণে খুশি হওয়ার বিষয় ছোটবেলায় শেখাতে পারলে তারা শুধু বড় হয়ে উঠবে না মানুষ হয়েও উঠবে। হ্যারি এস. ট্রুম্যান৯৭ বলেন, ‘সন্তানকে উপদেশ দেবার সেরা উপায়টা আমি খুঁজে পেয়েছি। সেটা হচ্ছে, সন্তান কী চায় সেটা আগে খুঁজে বের করুন, তারপর ওকে সেই কাজ করার উপদেশ দিন।’
ভালো কাজের স্বীকৃতি ও সমর্থন দিন
সন্তান প্রশংসাযোগ্য কিছু করলে প্রশংসা করুন, স্বীকৃতি দিন। শিশুর অনুভূতিকে সম্মান দেখানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যখন সে অস্বস্তি অনুভব করবে, তখন তাকে জোর করা যাবে না। তার ভেতরকে জাগাতে হবে, স্বেচ্ছায় কাজের ফলাফল সুন্দর হয়। সবসময় ইতিবাচক বার্তা দিন। শিশুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে, আনন্দের সাথে ও স্বেচ্ছায় খেলে; যা মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়ায়। পড়াশুনায় মনোযোগী করতে- সহজ বিষয় দিয়ে পড়া শুরু করান, পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটানোর বিষয়গুলো দূরে রাখুন, সফলতাকে কল্পনা করানো শেখান।
শিশুরা হলো বিস্ময়কর, তাদের স্বীকৃতি দিন। শিশুরা হলো মূল্যবান, তাদের মূল্য দিন। শিশুরা হলো বিশ্বাসযোগ্য, তাদের বিশ্বাস করুন। শিশুরা হলো উৎসুক, তাদের উৎসাহ দিন। শিশুরা হলো কর্মচঞ্চল, তাদের পরিচালনা করুন। শিশুরা হলো উদ্ভাবক, তাদের সমর্থন দিন। শিশুরা হলো নিরপরাধ, তাদের সাথে আনন্দ করুন। শিশুরা হলো স্বতঃস্ফূর্ত, তাদের উপভোগ করুন। শিশুরা হলো আনন্দপূর্ণ, তাদের মূল্যায়ন করুন। শিশুরা হলো কর্মদক্ষতা সম্পন্ন, তাদের উন্নয়নে এগিয়ে নিন। শিশুরা হলো দয়ালু, তাদের থেকে শিখুন। শিশুরা হলো অনন্য, তাদের সত্যতা সমর্থন করুন। শিশুরা হলো মনোরম, তাদের সযত্নে লালন করুন। শিশুরা হলো আকাক্সক্ষা সম্পন্ন, তাদের প্রতি মনোযোগী হোন। শিশুরা হলো উন্নত চরিত্রের, তাদের শ্রদ্ধা করুন। শিশুরা হলো হাস্যোজ্জ্বল, তাদের সাথে হাসি-তামাশা করুন। শিশুরা হলো খোলা মনের, তাদের শিক্ষা দিন।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ুন ও শিখুন
সন্তানের মানসিক বিকাশে মা-বাবার করণীয় হচ্ছে- সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। কখনোই ভয় বা আঘাত দিয়ে সন্তানকে শেখানোর চেষ্টা না করা। সন্তানকে আলাপ আলোচনায় উৎসাহিত করা। সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা। সন্তানের ভালো কাজগুলোর প্রশংসা করা। সন্তানকে কোনো কিছুতে অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে ধৈর্য ধারণ করা। সন্তান কী বলতে চায়, নিয়মিত সময় নিয়ে তা শুনা। সন্তানকে শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় উৎসাহিত করা। সন্তানের বাধা নিষেধের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া। যেকোনো সমস্যা সমাধানে সন্তানকে সহায়তা করা।
সন্তানের প্রতি আপনার ভালোবাসা তাকেও বুঝতে দেয়া। বুদ্ধিমত্তার নানা ধরণের ব্যবহারে উৎসাহিত করা। বিভিন্ন ধরণের উপসর্গ ও লক্ষণের ব্যাপারে সচেতন থাকা। সন্তানের আবেগ অনুভূতির প্রতি গুরুত্ব দেয়া। সন্তানের আচার-আচরণে পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য রাখা। সন্তানের পাশে থেকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া। সন্তানের মানসিক বিকাশের প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে কোনো সংকোচবোধ না করা। শিশুদের কাছ থেকেও পিতা-মাতারা শেখে থাকে। তাইতো পিটার ডি ব্রাইস৯৮ বলেন, ‘বিবাহের তাৎপর্য এই নয় যে, এর মাধ্যমে মানবশিশুর জন্ম হয় বরং শিশু লালন-পালন প্রক্রিয়ার ম্যধ দিয়ে প্রাপ্তবয়স্করা পরিপূর্ণতা লাভ করে।’
দূরত্ব তৈরি করবেন না
ছেলেমেয়েদের সাথে পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের দূরত্ব তৈরি হওয়া মানেই সন্তানদের বিপদে ফেলা। সন্তানের মনের কাছাকাছি থাকতে চাইলে তার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে, ঝোঁক-প্রবণতা সম্পর্কে জানতে হবে, সঠিক সময়ে সঠিক উপায়ে যথাযথ পরামর্শ দিতে হবে। সন্তান যাতে বুঝে মা-বাবা তার সর্বোত্তম বন্ধু, প্রকৃত বন্ধু, নিঃস্বার্থ বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষী ও অভিভাবক। ছোট বয়স থেকেই সন্তানের সাথে সময় কাটাতে হবে, সব কথা শোনতে হবে। মাঝে মাঝে গল্প ছলে নিজের মূল্যবোধ, পারিবারিক নিয়মনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় জানিয়ে দিতে হবে।
কেবল টাকা খরচ করে দামি-দামি খেলনা কিনে দেয়ার মাঝে সার্থকতা নেই। সন্তানের জীবনকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে, কল্যাণে, জ্ঞানে, বোধে, শিক্ষায় ও রুচিতে মানবিক দীনতা থেকে উত্তরণে তাকে পথের ঠিকানা করে দেয়ার মাঝেই প্রকৃত কল্যাণ নিহিত। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মা৯৯ বলেন, ‘বিনয়ী হতে হবে। অর্থবিত্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যাবে না। যত ওপরে উঠব ততই নিচে নামার ঝুঁকি বাড়বে। আমি আর আমার সন্তান সব সময় আগামীকালের জন্য চিন্তা করি।’
স্নেহের আতিশয্যে অভদ্র বানাবেন না
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা বলেছেন, ‘মায়েরা ভাবুন, আপনার সন্তানেরা ক্ষতিকর খাবার খেলে কেন আপনি চুপচাপ বসে দেখবেন। বাস্তবতা হলো, কেউ এটা করছে কারণ আপনাদের সন্তানদের নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই আমাদের চাহিদা হওয়া উচিত আমাদের শিশুদের দিকে যাতে সবাই নজর দেয়। হোল গ্রেইন বা পূর্ণ খাদ্যশস্য খেলে শিশুরা আরো স্থূল হয়ে পড়বে। তাই আমাদের সন্তানদের নিয়ে খেলবেন না।
স্নেহের আতিশয্যে আজ যে শিশুকে আদব-কায়দা ছাড়া বড় করছি সেই শিশুটিই আগামীকাল কোনো একটি পেশার হাল ধরবে। আর তার জন্যই হয়তো ঐ পেশাটি হবে অনেকের কাছে ঘৃণিত। তাহলে সমালোচনায় মুখর আমি নিজেই এ কি জিনিস বিনিয়োগ করছি জাতির জন্য? পৃথিবী জয় করে ফেলছি, কত জনের কত সমালোচনা করছি, কত জনের পেশাকে খাটো করছি। অথচ নিজের সন্তানকে ভদ্রতা, আন্তরিকতা, সামাজিকতা এবং আচার-নিষ্ঠা শিখাতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত স্নেহের কারণে নিজেই অন্ধ হয়ে বসে আছি। এভাবেই নিজের অজান্তে স্নেহের আতিশয্যে আদব-কায়দা ছাড়া একেকজন শিক্ষিত অভদ্র মানুষ তৈরি করছি নিজের ঘরেই।’
সব সময় ইতিবাচক থাকুন
নিজের সন্তানকে খাটো করে তুলনা দিবেন না, তার কোনো গুণকেই উপেক্ষা করবেন না। শুধু খুঁত দেখলে শিশুর মনে মারাত্মক চাপ পড়ে, তাই প্রশংসা করুন। অতিরিক্ত উপদেশ দিয়ে সন্তানের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কমাবেন না, ভালো শ্রোতা হোন, ভুল হলে ‘সরি’ বলুন। টিনএজে পারিবারিকভাবে বিশেষ সময় দিন, খোঁজ রাখুন সে কাদের সঙ্গে মিশছে। ওর ফ্রেন্ড সার্কেলের গেট-টুগেদার বাড়িতেই করুন, আপনারাও তার বন্ধু হোন, বন্ধুদের সঙ্গে কিছুটা সময় দিন। মূল্যবোধে, দেশাত্মবোধে, পারিবারিক বন্ধনে, মানবতাবোধে, শিক্ষার আলোকে আলোকিত করুন সন্তানকে।
বেশি বেশি বইপড়া, সৃজনশীল কাজ করতে তাকে অভ্যস্ত করান। গুণী ব্যক্তিদের আদর্শ ও বই তুলে ধরুন তাদের সামনে। কোয়ালিটি টাইম দিন, ভালো-মন্দ বুঝান, মনের কাছাকাছি থাকুন। এ পি জে আব্দুল কালামের এই কথাটি ভুলে যাবেন না- ‘যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর মনের মানুষের জাতি হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এ ক্ষেত্রে তিনজন সামাজিক সদস্য পার্থক্য এনে দিতে পারে। তারা হলেন বাবা, মা ও শিক্ষক।’ প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বলেন, ‘বাবা-মায়ের সাথে কাটানো সুন্দর মূহূর্তগুলো ভুলব না কখনো।’ এবি ডি ভিলিয়ার্স বলেন, ‘আমার জীবনে মা-বাবার প্রভাব সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।’
এই ধরনের সুন্দর অনুভূতি ও স্বপ্ন জাগানোর জন্য প্যারেন্টিং হবে ইতিবাচক। ইতিবাচক প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে শারীরিক আঘাত গ্রহণযোগ্য নয়, বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োজন। শিশুরা অবশ্যই ভুল থেকেও সঠিকটা শিখে থাকে। বাবা-মা চান সন্তানরা ভালো আচরণকারী হবে, নিজেদের ও অন্যদের সম্মান করবে, অন্যের প্রতি দয়াশীল হবে, বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলায় দক্ষ হবে, প্রয়োজনীয় কাজে মনোযোগী হতে ও মনোনিবেশ করতে পারবে, সুখ-দুঃখ-চিন্তা শেয়ার করতে পারবে, ভুলে স্থির না থেকে ফিরে আসতে পারবে, কিভাবে জয়ী হতে হয় ও কিভাবে হেরে যেতে হয় তা শিখবে। কিন্তু শিশুরা প্রায়ই প্রত্যাশানুযায়ী আচরণ করেন না। এতে বাবা-মা রাগান্বিত হন, হতাশ হয়ে যান বা হাল ছেড়ে দেন। সাধারণত চিৎকার করে, কান্না করে, আঘাত করে, যা বলে তা করে না, খেলনা-ভেঙ্গে ফেলে, বই-কাগজ-টাকা ছিঁড়ে ফেলে, জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়, কথা শুনে না বা মনোযোগ দেয় না।
শিশুরা সীমা ভাঙ্গতে চায়, বিধি-নিষেধ শুনতে চায় না, বাবা-মার নির্দেশনা মানে আবার কখনো মানে না। এসবের মাধ্যমেই তারা বুঝতে শিখে কোনটি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি গ্রহণযোগ্য নয়। শিশুরা বাবা-মাকে বিরক্ত করতে বা রাগান্বিত করতে এমনি অসদাচরণ করে না। তাদের আচরণের পেছনেও নানা উদ্দেশ্য থাকে। হতে পারে- তারা স্কুলের কোনো ঘটনায় মন খারাপ করে আছে বা উদ্বিগ্ন, ভাইবোনের কোনো ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত, তারা চাচ্ছে তাদের বাবা-মা তাদের কথা শুনবে অথবা তারা বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটাতে চাচ্ছে। সাধারণত মনোযোগ পাওয়ার জন্যও বাচ্চারা খারাপ আচরণ করে থাকতে পারে।
বাবা-মাকে বাসায় কাজের চাপ বা ব্যস্ততা কমানোর পথ খুঁজে বের করা প্রয়োজন যাতে তারা ইতিবাচক প্যারেন্টিংয়ের মাধ্যমে বাচ্চাদের আচরণ পরিবর্তন করতে পারেন। যাতে সন্তানদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় এবং দৈনন্দিন জীবনকে আরো ভালোভাবে পরিচালনায় সহযোগিতা করতে পারেন। প্রতিটি শিশুই স্বতন্ত্র। আপনি আপনার সন্তানকে জানুন। জানুন কী তাকে রাগান্বিত করে যা পরবর্তীতে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটা থেকে রক্ষা করবে। ইতিবাচক ভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করুন।
বাচ্চাদেরকে বলুন তারা কী কী করবে বলে আপনি চান কিন্তু বলবেন না তারা কী কী করবে না। বাবা-মার চাওয়ার আলোকে বড় শিশুর আচরণ নিশ্চিত করতে বা খারাপ পরিস্থতি এড়াতে কণ্ঠস্বর বা ভয়েস পরিবর্তন খুবই শক্তিশালী হতে পারে। বাবা-মা যদি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে কথা বলে বা প্রতিক্রিয়া জানায় তবে শিশুরা অবাক হয়। শিশু তার শেখা নতুন ভাষা বলতে চায় এবং অন্যকে শুনাতে চায়। শিশুর পাশে বসলে, মনোযোগ দিয়ে কথা শুনলে, তাকে কথা বলতে উৎসাহিত করলে, তারা কথা বলবে; এর মাধ্যমে মুখের জড়তা কেটে যাবে এবং যোগাযোগ দক্ষতা বেড়ে যাবে।
নেতিবাচকতা এড়িয়ে চলুন
‘শিশুকে- ভুল শেখাবেন না, সঠিক শেখাবেন। লোভ দেখাবেন না, পুরস্কার দেবেন। নিরুৎসাহিত করবেন না, উৎসাহিত করবেন। বকুনি দেবেন না, উপদেশ দেবেন। বেয়াদব বলবেন না, আদব শেখাবেন। নিঃসঙ্গ রাখবেন না, সৎসঙ্গ দেবেন। ভয় দেখাবেন না, সাহস দেবেন। লজ্জা দেবেন না, শিখিয়ে দেবেন। দমক দেবেন না, বুঝতে দেবেন। মিথ্যা বলবেন না, সত্য বলবেন। গালি দেবেন না, স্নেহ করবেন। নিন্দা করবেন না, ভালোবাসবেন। অবহেলা করবেন না, গুরুত্ব দেবেন।’
সন্তানের প্রশংসা করুন, এতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। শুধু দোষ খুঁজবেন না কিংবা সবসময় বেশি দোষ ধরবেন না। তাকে মেধাবী বলুন, এতে তার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করবে। তুমি পার না বা পারবে না- এরকম না বলে বলুন- তুমি পার এবং পারবে। কখনো জোর দিয়ে বলবেন না- পরীক্ষায় প্রথম হতেই হবে। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিবেন না বরং তার প্রতি পজেটিভ থাকুন। কারোর সাথে কখনো তুলনা করবেন না। অন্যদের প্রশংসা কখনো সন্তানের সামনে করবেন না, এতে সে হীনমন্যতায় ভুগতে পারে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং চলার সুযোগ দিন।
পরের কল্যাণে কাজ করতে শিখান
নিজের ও পরিবারের প্রতি দায়িত্বের বাইরে সাধারণ মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ শেখাতে হবে। অনেক বাবা-মা আনুষ্ঠানিকতা পালন করলেই সন্তানের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, আত্মতুষ্টি লাভ করেন, দায়িত্ব সম্পন্ন হয়ে গেছে মনে করেন। এতে শিশুদের চিন্তা-চেতনা সংকীর্ণ হয়ে যায়, একধরনের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় এবং সামাজিক দায়-দায়িত্ব-পরোপকারের প্রতি অনীহা ও জনকল্যাণে অংশগ্রহণের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়। অথচ শিশুদেরকে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, গরিবের প্রতি দয়া করা, পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। অন্যের প্রয়োজনের প্রতি সমবেদনা ও উদ্বেগ সৃষ্টি মূল্যবান গুণ। অল্পবয়সেই কচি মনে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ত্যাগের ভেতরে মানসিক প্রশান্তি বা আনন্দলাভ করা শেখাতে হবে। সন্তান লালন-পালন সবসময় আনন্দের হয় না, ভালো মা-বাবারও খারাপ সন্তান হয়, সব সন্তানই বাবা-মায়ের ত্যাগের সঠিক মূল্যায়ন করে না; তাই প্যারেন্টিং স্বভাবজাত হলেও এজন্য আলাদা চর্চার প্রয়োজন আছে।
সমালোচনার পরিবেশ নয়
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন: ‘যে শিশু স্নেহের মধ্যে বড় হয়, সে ভালোবাসতে শিখে। যে শিশু উৎসাহ পেয়ে বড় হয়, সে আত্মবিশ্বাসী হয়। যে শিশু সত্যের মধ্যে বড় হয়, সে সুবিচার করতে শিখে। যে শিশু প্রশংসার মধ্যে বড় হয়, সে অন্যদের গুণ ধারণ করতে শিখে। যে শিশু ভাগ করে খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়, সে সুবিবেচক হয়। যে শিশু ধৈর্যের মধ্যে বড় হয়, সে সহনশীল হয়। যে শিশু সুখী পরিবেশে বড় হয়, সে ভালোবাসা ও সৌন্দর্য শিখে। যে শিশু উপহাস নিয়ে বাঁচে, সে ভীরু হয়ে বড় হয়। যে শিশু সমালোচনার মধ্যে বড় হয়, সে শুধু নিন্দা করতে শিখে। যে শিশু সন্দেহের মধ্যে বড় হয়, সে প্রতারণা করতে শিখে। যে শিশু বিরোধিতার মধ্যে বড় হয়, সে শত্রুতা করতে শিখে।’১০৫ এসব বিষয়ও খেয়াল রাখতে হবে।
দায়িত্ব সচেতন করে গড়ে তুলুন
সন্তানের সাথে বসে পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে যা জানেন তথা পারিবারিক ইতিহাস আলোচনা করতে হবে, সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, নিজে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া নয় গুরুত্ব সহকারে দায়িত্ব পালনই যে নেতৃত্ব এ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে ও বাড়ির পরিবেশকে সুন্দর করা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। সন্তানকে শেখাতে হবে- গাছ লাগানো ও পরিচর্যা, আবর্জনা কোথায় ফেলতে হয়, প্রয়োজনে কিভাবে ফোন করতে হয়, বিপদে কিভাবে সাহায্য পেতে হয়, ধার নেয়া জিনিস কীভাবে ফেরত দিতে হয়, অন্যকে ধন্যবাদ জানানো, অন্যকে কষ্ট না দেয়া, নিজের জিনিস পত্রের যত্ন ও পরিচর্যা, নিজের কাপড়-চোপড় নিজেই পরিষ্কার করা ও ভাঁজ করা, সঠিকভাবে কথা বলা, শেয়ার ও কেয়ার, বড়দের শ্রদ্ধা করা, শিশুদের সাথে মেশা, বিপদে স্রষ্টার সাহায্য কামনা করা, কোনো কিছু কেনার পূর্বে মূল্য যাচাই করা, সংযমী হওয়া, বই পড়া, কোথাও সময়মত যাওয়া এবং দেরি হলে ফোনে জানায়ে দেয়া ইত্যাদি।
মধ্যমপন্থা অবলম্বন করুন
রাগান্বিত অবস্থায়ও সন্তানের সাথে ধীর শান্তভাবে কথা বলবেন। বাবা-মা বাচ্চারা কাঁদলে জিজ্ঞেস করবে কেন সে কাঁদছে, বাচ্চাদের সকল চাওয়া আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও পূরণ করবে না, ভুল সমালোচনা করবে না, কেউ কারো দুর্নাম-মারামারি-ঝগড়া করবে না এবং বাচ্চাদের রুমে টেলিভিশন বা কম্পিউটার রাখবে না।
সন্তানের প্রতি হযরত লোকমান (আ.) এর উপদেশ বাণী: ‘বৎস্য! আল্লাহর সান্নিধ্য অবলম্বন করবে। প্রত্যেক কাজে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে। বিপদে বন্ধুর পরীক্ষা নেবে। নিজের মান-মর্যাদা বজায় রেখে কথা বলবে। নিজের গোপনীয়তা কারও কাছে প্রকাশ করবে না। অন্যকে উপদেশ দেয়ার আগে নিজে আমল করার চেষ্টা করবে। পিতা-মাতাকে সর্বাধিক সম্মান করবে। শিষ্যকে সর্বাধিক মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখবে। কথা বলার সময় মুখ আয়ত্তের মধ্যে রাখবে। সুযোগ বুঝে কথা বলবে এবং প্রয়োজনীয়টুকু বলার জন্যই মুখ খুলবে। বন্ধুদের ভালো-মন্দের উভয়টাই পরীক্ষা করবে।
কাউকে জনসমক্ষে লজ্জা দিবে না। মেহমানের সামনে কারো প্রতি রাগান্বিত হবে না। অহংকার করবে না। যথাসম্ভব ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকবে। উপযুক্ত শিক্ষিত না হয়ে অন্যকে শিখাতে যেয়ো না। বিচক্ষণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে বন্ধুত্ব করবে। মূর্খের সাথে বন্ধুত্ব করিও না। প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার লোকজনের মর্যাদা জেনে-বুঝে সে হিসেবেই তাদের সঙ্গে আচরণ-ব্যবহার করবে। বুদ্ধিমতী নয় এমন নারীদের ওপর ভরসা করবে না। যা জান না সে বিষয়ে কাউকে পথ দেখাতে যাবে না।
দানশীলতার অভ্যাস গড়ে তোল। ব্যয়ের ক্ষেত্রে আয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। ‘কম আহার’, ‘কম নিদ্রা’ ও ‘কম কথা’ বলার অভ্যাস করবে। বড়দের সামনে কথা দীর্ঘায়িত করবে না। নিরপরাধ ও নির্দোষকে অপরাধী ও দোষী সাব্যস্ত করবে না। নিজের সম্পদ গোপন রাখবে, তা বন্ধু ও শত্রু কারও কাছে প্রকাশ করবে না। বুদ্ধিমান ও কল্যণকামী লোকজনের সঙ্গে পরামর্শ করবে। বোকা লোকজন থেকে দূরে থাকবে। কোনো বিপদগ্রস্তকে নিরাশ করবে না। বড়দের সামনে আগে আগে চলবে না। স্বীয় অধিকারের প্রতি সচেতন থাকবে। ভালোকাজে পুনঃপুনঃ অংশগ্রহণ করবে। নিজের কথা প্রমাণ করে দিবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী দায়িত্ব প্রদান করবে। অন্যের ধন সম্পদের প্রতি লক্ষ্য করবে না। নীতিহীনদের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা আশা করবে না। আজকের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রাখবে না। তোমার প্রতি যারা আশা রাখে তাদের নিরাশ করো না। অতীতের তিক্ততা মনে রেখো না। আপনজনদের কাছ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না। অহংকার করবে না।
মানুষের সামনে দাঁত খেলাল করবে না। মানুষের সামনে মুখে বা নাকে আঙ্গুল প্রবেশ করবে না। জামার আস্তিন দ্বারা নাক পরিষ্কার করবে না। শব্দ করে থুতু ফেলবে না। হাই তোলার সময় মুখে হাত রাখবে। চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করবে না। এক কথা বারবার বলবে না। অন্যের সামনে নিজের প্রশংসা করবে না। কথা বলার সময় হাত নাড়াচাড়া করবে না। অন্যের কথার মধ্যে বাধা দিয়ে কথা বলবে না। আপনজনদের শত্রুর সাথে উঠাবসা করবে না। ঠাট্টা বিদ্রƒপ থকে বিরত থাকবে। কারো মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করবে না। নিজের খানা অন্যের দস্তরখানায় নিয়ে যাবে না। কোনো কাজেই তাড়াহুড়ো করবে না। রাগান্বিত অবস্থায়ও ধীর শান্তভাবে কথা বলবে। সূর্য উদয়ের পূর্বেই শয্যা ত্যাগ করবে। এদিক সেদিক উঁকি মেরে দেখবে না।’
সার্থক জীবনকে গুরুত্ব দিন
পূর্ণ প্রতিভায়, মমতায় ও ভালোবাসায় সন্তানকে গুণী ও জ্ঞানী করে গড়ে তোলতে ত্যাগ স্বীকার করুন। সফলতার চেয়ে সার্থক জীবনকে গুরুত্ব দিন। বেশি আহার করবে না, অন্ধভাবে কাউকে ভালোবাসবে না, অন্যের অধঃপতনে আনন্দ প্রকাশ করবে না, সন্দেহপ্রবণ মনের হবে না, বেশি কথা বলবে না। অন্যকে ভয় না দেখিয়ে হৃদয় জয় করবে, যেটি সঠিক বলে মনে হয় সেটি করবে, দুশ্চিন্তা না করে পরিকল্পনা করবে, যা হারাবে তার জন্য আফসোস না করে বদলে যাওয়াটাকে মেনে নেবে, নিজে সততা চর্চা করবে তবে অন্যদের নিকট থেকে সব সময় এই চর্চা আশা করে কষ্ট বাড়াবে না, অন্যকে বিরক্ত করবে না, কাউকে ঠকাবে না। নিজের কাজকে স্যালুট করবে, পরের ক্ষতি করবে না, বকা না দিয়ে ক্ষমা করবে, অভিযোগ না রেখে ধৈর্যধারণ করবে, লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতে থাকবে, প্রতিটি দিনকে অর্থবহ করে তোলতে সচেষ্ট থাকবে, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে জেনে নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখবে এবং সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে মর্যাদা দিতে শিখবে।
মানুষকে সম্মান করতে শিখান
পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হলে ও দেশি সংস্কৃতির চর্চা বাড়ালে আগামী প্রজন্মকে সন্ত্রাসবাদের কালো থাবা থেকে বাঁচানো যাবে। সন্তানকে দেশপ্রেম ও মানবতার শিক্ষা পরিবার থেকেই দিতে হবে। সাধারণত মা-বাবার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থাকলে সন্তান বিপথগামী হয় না। তাই ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বড়রা যা করে, শিশুরা তা অনুকরণ করে। মা-বাবার মধ্যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ক্ষমাশীলতা, সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা না থাকলে শিশুদের মধ্যে তা গড়ে ওঠে না। এজন্য সন্তানকে সময় দিতে হবে, উদারতা শিখাতে হবে। সকল ধর্মের-শ্রেণির মানুষকে সম্মান করতে শিখাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও বাস্তব জীবনে সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে লক্ষ্য রাখুন। পরিবারের ভালোবাসা, যত্ন ও পিতামাতার সাথে সন্তানের বন্ধুত্ব অপরাধপ্রবণতা রোধ করে। পিতামাতাকে সন্তানের মন খারাপ বা হতাশার কারণগুলো বুঝতে শেখা দরকার।
মাতা-পিতার মধ্যে থাকবে ঐকমত্য
মাতা-পিতার মধ্যে সবসময় পারস্পরিক ঐকমত্য ভদ্র ও সুসন্তান গড়ে তোলায় সহায়ক। দুজনই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মা কখনো বাবার সম্পূর্ণ বিকল্প হতে পারে না আর বাবাও পারে না মায়ের বিকল্প হতে। মাশরাফি বিন মর্তুজা১০৭ বলেছেন, ‘একজন খেলোয়াড়ের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটির নাম হচ্ছে তার পরিবার। পরিবার আপনার ক্যারিয়ারকে অনেক বড় করে দিতে পারে আবার ছোটও করে দিতে পারে। আগে বাবা-মায়েরা সন্তানদের অনেক সময় দিতেন। এখন সবাই এত ব্যস্ত যে সম্পর্কের সুতাগুলো আলগা হয়ে যাচ্ছে।
সন্তানেরা একা একা বড় হচ্ছে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য বাবা-মায়েরাই বাচ্চাদের হাতে মোবাইল-ট্যাব তুলে দিচ্ছেন। আস্তে আস্তে ওরা সেটাতেই আসক্ত হয়ে যায়। ডিজিটাল স্ক্রিনে আবদ্ধ হয়ে যায় জীবন। পরিবার ও সমাজের বন্ধন দৃঢ় না করলে এর সমাধান নেই। আমরা সন্তানদের কী দিতে পারছি? আমরা সবাই ব্যস্ত। আমাদের অনেক কাজ। কিন্তু সন্তান মানুষ না হলে সবই বৃথা। তরুণ প্রজন্মকে দোষারোপ না করে আগে আমাদের বড়দের সচেতন হতে হবে। নেতিবাচক চিন্তা না করে ভালোটাকে উৎসাহ দিতে হবে। ভুল শুধরে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাবা-মা এবং পরিবারের দায়িত্ব সবার আগে।’
সন্তানকে যেভাবে দেখতে চান সেভাবে চলুন
সন্তানের ওপর তার পরিবারের প্রভাব সর্বদাই লক্ষ্য করা যায়। যে সব পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক নেই, পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের সাথে অশোভন আচরণ হয়, অবৈধ পথে অর্থ রোজগার করা হয়, সমাজের প্রতি যারা কোন দায়িত্ব পালন করে না, যাদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে তাদের পরিবারের সন্তানরা বড় হয়ে তাদের সাথেও অমানবিক আচরণ করবে, সমাজের প্রতি সেই সন্তানদের থাকবে না কোন দায়বদ্ধতা এবং তারা দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে।
সন্তানকে ভবিষ্যতে যেভাবে দেখতে চান, সেভাবে এখন চলুন। নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের ও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশলী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলুন। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জনে সক্ষম করে গড়ে তুলুন। সুশৃঙ্খল সমাজ ও সুষ্ঠু পরিবেশ গঠন এবং সুনাগরিকরূপে প্রতিষ্ঠিত হবার মতো যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলুন। নৈতিকতাবোধ তৈরি করুন।
ভালো উপদেশ দিন
‘জুতা সেলাই বা রং করতে চাইলে মেরামতকারীর দোকানের সামনে পা বাড়িয়ে দিওনা, বরং জুতাটা খুলে নিজে একবার মুছে দিও। কখনো কাউকে কামলা, কাজের লোক বা বুয়া বলে ডেকো না। মনে রেখো তারাও কারো না কারো ভাই, বোন, মা, বাবা। তাদেরকে সম্মান দিয়ে ডেকো। বয়স, শিক্ষা, পদ বা পদবির দিক দিয়ে কেউ ছোট হলেও কখনো কাউকে ছোট করে দেখো না। নইলে তুমি ছোট হয়ে যাবে। পড়াশুনা করে জীবনে উন্নতি করো, কিন্তু কারো ঘাড়ে পা দিয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করো না। কাউকে সাহায্য করে পিছনে ফিরে চেয়ো না, সে লজ্জা পেতে পারে। সব সময় পাওয়ার চেয়ে দেয়ার চেষ্টা করো বেশি।
মনে রেখো, প্রদানকারীর হাত সর্বদা উপরেই থাকে। এমন কিছু করো না যার জন্য তোমার এবং তোমার পরিবারের উপর আঙুল ওঠে। ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছো, তাই দায়িত্ব এড়িয়ে যেও না। তোমার কী আছে তোমার গায়ে লেখা নেই। কিন্তু তোমার ব্যবহারে দেখা যাবে তোমার পরিবার কোথায় আছে। কখনো মার কথা শুনে বউকে এবং বউয়ের কথা শুনে মাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিও না। কাউকে ফেলতে পারবে না। কারো বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে গেলে বাসায় দুমুঠো ভাত খেয়ে যেও। অন্যের পাতিলের ভাতের আশায় থেকো না। কারো বাসার খাবার নিয়ে সমালোচনা করো না।
কেউ খাবার ইচ্ছে করে স্বাদহীন করার চেষ্টা করে না। বড় হবার জন্য নয়, মানুষ হবার জন্য চেষ্টা করো। শ্বশুর কিংবা শাশুড়িকে এতটা সম্মান দিও, যতটুকু সম্মান তোমার বাবা-মাকে দাও এবং তাদের প্রতি এমন আচরণ করো, যাতে করে তাদের মেয়েকে তোমার বাড়ি পাঠানোর জন্য উতলা থাকে। সব সময় ভদ্র ও নম্রভাবে চলো এবং ভালো কথা বলো। কিন্তু অন্যায়ের সাথে আপস করো না।’