পিতৃত্ব সন্তানের জীবনে শ্বাশত গভীরতম অনুভূতির অমুল্য সম্পদ । তবে সন্তানের প্রতি কিছু পিতার দায়িত্বহীনতা ও অবহেলা পিতৃত্ব নিয়ে চিরন্তন ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সাধারণত যে খাবারগুলো সন্তান পছন্দ করে, বাবার সাথে খেতে বসলে বাবা সেগুলো নিজে না খেয়ে সন্তানকে দেয়। সন্তান বাবা হওয়ার আগ পর্যন্ত এ কারণে বোকাও ভাবে। যদিও বাবা হওয়ার আগেই বাবার গুরুত্ব-মর্যাদা, আবেগ-অনুভূতিকে বুঝতে পারাই বেশি কল্যাণকর।
সন্তানের জন্ম বাবার শরীরেও পরিবর্তন আনে। হরমোনজনিত পরিবর্তন ঘটায় প্রভাবিত হয় মস্তিষ্ক ও আচরণ। সন্তানের দেখাশোনা করার জন্য পরিবর্তিত হয় মস্তিষ্ক। ফলে আবেগ ও সামাজিকতা সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। সন্তানের প্রতি যত্নবান বাবাদের মস্তিষ্ক এবং মায়ের মস্তিষ্ক একই রকমের কার্যকলাপ প্রদর্শন করে। মা ও শিশুর সাথে বাবার সংযোগ বেশি থাকলে এস্ট্রোজেন, অক্সিটোসিন, প্রোল্যাক্টিন ও গ্লুকোকরটিকয়েড হরমোনের মাত্রা বাবার শরীরে বেড়ে যায়। যেসব বাবা সন্তানের প্রতি বেশি ভালোবাসা প্রকাশ করেন ও বাচ্চার সাথে সময় বেশি কাটান, তাদের শরীরে অক্সিটোসিন হরমোনের পরিমাণ বেশি হয়। সন্তানের জন্ম বাবার মস্তিষ্কে নতুন নিউরনের গঠনকে প্রভাবিত করে। বাবারা হয়ে থাকেন সন্তানের কণ্ঠস্বরের প্রতি সংবেদনশীল; তারাও নিজ সন্তানের কণ্ঠস্বর অন্যদের চাইতে আলাদা করে চিনে ফেলতে পারেন।
থিয়াগোর জন্মের পর থেকে জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে বলে স্বীকার করেন বার্সেলোনার আর্জেন্টাইন সুপারস্টার লিওনেল মেসি। বিশ্বসেরা এ ফুটবলার পিতৃত্বকে দারুণ উপভোগ করেন। মেসি জানান, তার কাছে সবার আগে হলো থিয়াগো। থিয়াগোর পরে আসে অন্যসব বিষয়। এ চিন্তাই নাকি তাকে অনেক পরিণত করে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে। মেসি বলেন,‘ থিয়াগো ম্যাচ নিয়ে আমার দর্শন পাল্টে দিয়েছে। আগে কোনো ম্যাচে খারাপ করলে রাগে তিন চার দিন কারো সঙ্গে ঠিকমত কথা বলতে পারতাম না। কিন্তু এখন হারলে বাসায় ফিরে আমার ছেলেকে দেখে সব ভুলে যাই। তখন খেলা আমার কাছে গুরুত্বহীন মনে হয়। বাবা হওয়াটা আমার মানসিক বিকাশের পূর্ণতা দিয়েছে। আমি এখন ক্ষেপে না গিয়ে বুঝতে পারি যে, ফুটবলের বাইরেও একটা জীবন আছে। সেই জীবনটা অনেক সুন্দর। পিতৃত্ব আমাকে পরিণত করেছে।
দুই সন্তান প্রিন্স জর্জ আর প্রিন্সেস শারলটের কথা বলতে গিয়ে এবং নিজের পিতৃত্বের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স উইলিয়াম বলেন, কোনোকিছু নিয়ে আমি আগে কখনই এতটা উদ্বিগ্ন হতাম না, এখন যেমনটা হই। নতুন প্রিন্সের জন্মের পর থেকে একেবারে অনেক ছোট ছোট বিষয়ও আমাকে উদ্বেলিত করে, ভাবনায় ফেলে দেয়। আর প্রিন্সেসের জন্ম আমাকে অধিক আবেগপ্রবণ করেছে। বিশ্বজুড়ে ঘটছে এমন অনেক ঘটনাই আছে যা আমি এখন পিতৃত্বের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। পিতৃত্ব আমাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ করেছে। এর মাধ্যমে জীবনের মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছি। এখন জীবন আমার কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
বলিউড সুপারস্টার আমির খান দাবি করেছেন পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব একজন মানুষের জীবনকে পাল্টে দেয়। ঠিক তেমনই পিতৃত্ব তার জীবনেও এনে দিয়েছে পরিবর্তন। অভিনেতা আমির খান জানান, ‘আপনার জীবনে একটি সন্তান থাকা মানে সেটি অনেক আনন্দের। এটি এমন একটি জিনিস যা আপনার জীবনকে বদলে দিবে। আমার মনে আছে আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মা সবসময় একটি কথা বলতেন। তুমি যখন বাবা হবে তখন এর অনুভূতি বুঝতে পারবে। আমার প্রথম সন্তান জুনায়েদের জন্ম জীবনে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে।’
আমার পিতা হওয়া ও পিতা হয়ে ওঠায় অবদানের জন্যে কৃতজ্ঞতা দুই কন্যা ও তাদের মায়ের প্রতি; কারণ তাদের কারণেই বাবা হবার মতো বিরল সম্মান অর্জন করতে পেরেছি। স্রষ্টা অপার অনুগ্রহে পিতৃত্বের স্বাদ আস্বাদন, পিতৃত্বের গর্বে গর্বিত হওয়া, পিতৃত্বের মতো অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা লাভের মতো শ্রেষ্ঠতম অর্জনের সৌভাগ্য হয়েছে। পিতৃত্ব স্পার্ম শেয়ারিংয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু; তিলে তিলে সন্তানকে স্নেহ-মায়া-মমতায় বড় করে তোলা, দায়িত্ব নেয়া, কান্না-হাসির সাক্ষী হওয়া, হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, সাহস দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং আদরে-শাসনে মানুষ করে গড়ে তোলা ইত্যাদি। সন্তান জন্ম দিলেও সব পুরুষ পিতা হয়ে ওঠে না। জীবনের প্রতি পদে, প্রতিদিনই একটু একটু করে উন্নততর মানুষে রূপান্তরিত হয়ে পিতা হয়ে উঠতে হয়। প্রতিদিনের আদরে ভালোবাসায় মায়া-মমতার বহু কিছু শিখতে হয়। বন্ধুর মতো ব্যবহার করে পিতৃত্বকে একটি সৌহার্দ্যর ব্যঞ্জনা দিতে হয়। নিত্যদিনের ব্যবহারে সংবেদনশীলতা, স্নেহ, শর্তহীনভাবে ভালোবাসা, অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন শিখতে হয়।
অনেক যত্নবান পিতা সন্তানের সাথে কথা বলে, হোমওয়ার্কে সাহায্য করে, গল্প করে, খাবার খাওয়ায়, ডায়াপার পরিবর্তন করে দেয়, গোসল করায়, পোশাক পরায়, খেলা করে এবং কোলে নেয়। কোলে নিয়ে কিছুটা শুন্যে তুলে দেয়া, পিছন থেকে হালকা ধাক্কা দিয়ে স্থানান্তর করা, একটু সান্নিধ্য, হালকা রসিকতা ও দুষ্টুমি পিতা-সন্তানের মানবিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। বাবা-সন্তানের মধ্যকার সুসম্পর্ক উভয়ের সুস্বাস্থ্যের জন্যও দরকারি। বাবার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হলে তা সারা জীবন ধরে সন্তানের স্বাস্থ্য ও বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাবা ঘনিষ্ঠ শিশুদের কথা বলা ও শিক্ষণ দক্ষতা বাবা ঘনিষ্ঠ নয় এমন শিশুদের থেকে আরও ভালো হয়, পড়াশুনোয় ভালো হয়।