সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জরুরি

আনিসুর রহমান এরশাদ

সাংবাদিকতার চিরচেনা জগত বদলে যাচ্ছে দ্রুততার সাথে। ফলে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সাংবাদিকতায় একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়েছে। গণমাধ্যম শিল্পের রূপান্তরের ধারবাহিকতা রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একাডেমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সাংবাদিকতায় একাডেমিক শিক্ষা নেই অথচ গণমাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ত আছেন এমন গণমাধ্যম কর্মীদেরও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন ও আধুনিক ধ্যান-ধারণা-তত্ত্ব-প্রবণতার সাথে পরিচিত হওয়া জরুরি। গণমাধ্যমকর্মীরা নিজেদের জ্ঞান-দক্ষতা না বাড়ালে পেশাদারিত্বের দিক থেকেও শাণিত-উন্নত হতে পারবেন না। পঠন-পাঠন কিংবা পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানও অবশ্যই জরুরি।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আবশ্যকতা

যোগাযোগবিদরা বলছেন, সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আবশ্যক। প্রকৃত ঘটনার তাৎপর্য বোঝার ক্ষমতা অর্জন করার জন্য সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জরুরি। সাংবাদিকতায় একাডেমিক শিক্ষাকে আমিও খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ এখন সংবাদমাধ্যমকে মাল্টিপ্লাটফর্মের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে সাংবাদিকতায় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত তৈরি হচ্ছে।

মান্ধাতার আমলের ধ্যান-ধারণা পরিহার

এখনতো গবেষকের বিশ্লেষণের পরিবর্তে সফ্টওয়্যার দিয়ে বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বহু সংবাদ সংস্থার জন্য সংবাদ তৈরি করে সাংবাদিকতা শিল্পকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। যখন রোবট সাংবাদিকতার উত্থান ঘটছে, তথ্য বিশ্লেষণ করে নিবন্ধ তৈরিতে অটোমেটেড ইনসাইটস সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড পর্যবেক্ষণ ও এনগেজমেন্ট বাড়াতে নিউজহুইপ ব্যবহার করা হচ্ছে; তখন  মান্ধাতার আমলের ধ্যান-ধারণা নিয়ে সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নেয়া যাবে না।

পেশার গুণগত মান অর্জন

যোগাযোগ মাধ্যমের খুব দ্রুত প্রসার ঘটছে এমন একটি যুগে সাংবাদিকতায় পড়া মানে সব বিষয়ের ওপর জ্ঞান রাখা। তাছাড়া বর্তমানে এর কর্মক্ষেত্রের পরিধিও ব্যাপক। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় ভালো ধারণা থাকলে কাজ করা যায়-যোগাযোগের বিভিন্ন সেক্টরে, ইনফরমেশন এন্ড ডকুমেন্টেশনে, পাবলিক রিলেশনসে, অ্যাড এজেন্সিতে, প্রোডাকশন হাউজে, ফিল্ম ইন্ড্রাস্টিতে ও এনজিওতে। আর যে কোনো পেশায়ই পেশাদারিত্ব অর্জন করার জন্য বা পেশার গুণগত মান অর্জনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাডেমিক- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জরুরি। আর সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তা আরো বেশি প্রয়োজন। যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে তারা অন্যান্যদের তুলনায় তাদের পেশাগত দায়িত্বটা অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারেন।

মিডিয়া ইন্ড্রাস্টিতে নতুনত্ব ও পরিবর্তন

স্মার্টফোন ব্যবহার করে সাংবাদিকতার ধারণাটি মিডিয়া ইন্ড্রাস্টিতে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কনভারজেন্স জার্নালিজম, ভিডিও জার্নালিজম, রেডিও জার্নালিজম, মোবাইল জার্নালিজম, স্মার্টফোন জার্নালিজম, সিটিজেন জার্নালিজম- কত বৈচিত্র্য, কত নতুনত্ব! ফেসবুকের একটি স্টাটাস, টুইটারে একটি টুইট হয়ে উঠছে সংবাদপত্রের লিডস্টোরী।

নতুন যুগের যারা সাংবাদিক ও কনটেন্ট নির্মাতা তাদের অনেক দূর দেখতে হবে, নিজের হাউজের বাইরে অন্য হাউজগুলো কী করছে তা জানাই যথেষ্ট হবে না; বিশ্বজুড়ে এই সেক্টরের পরিবর্তন-প্রবণতা-গতিধারা বুঝতে হবে এবং বুঝাতে হবে। রোবট প্রতিবেদকরা যখন প্রবন্ধ লিখছে, কুইল প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে; তখন দক্ষ মানবকর্মী হিসেবে সংবাদকর্মীদের গড়ে ওঠার কোনো বিকল্প পথ নেই।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতায়  সংকট

অনেকে হয়তো বলবেন- বাংলাদেশে এসব ভেবে লাভ নেই! এখানে চলে দলাদলি, হালুয়া-রুটির ভাগাভাগি! কথা হচ্ছে আপনি ঘুমাবেন না জেগে থাকবেন, ঝিমুবেন না হাটবেন, ধীরে চলবেন না জোরে চলবেন- সেই সীমানা তৈরির দায়িত্ব অন্যকে দিবেন নাকি নিজে নেবেন! নিজের চিন্তার সীমানা, কাজের সীমানা, দেখার সীমানা সংকীর্ণ করার জন্যতো আর অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই! নিজে এগিয়ে যেতে না চাইলে অন্য কেউ এগিয়ে দিতে পারবে না, আর নিজে এগিয়ে যেতে চাইলে কেউ থামিয়েও দিতে পারবে না। যোগ্যতা-দক্ষতা যত বাড়বে, কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত করার সুযোগও তত বাড়বে।

সাংবাদিক যখন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন অন্য পেশার লোক এসে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করে দিতে কখনো পারবে না! বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় শত্রু সাংবাদিকরাই, সাংবাদিকদের বিশ্বগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার অন্তরায়ও এই সাংবাদিকরাই। কারণ গুটি কয়েক নেতার স্বার্থ সুরক্ষা ও নিরাপদ ভবিষ্যত নিশ্চিত করার মাঝেই কোনো সংগঠনের কার্যত বিচরণ সীমাবদ্ধ থাকলে এবং অধিকাংশই উপেক্ষিত থেকে গেলে প্রকৃত কল্যাণ কখনো নিশ্চিত হবে না। আমি মনে করি- রাজনৈতিক, রেগুলেটরি, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, বিজ্ঞাপনের সংকুচিত বাজার, কন্টেন্ট সংক্রান্ত ব্যাপারের মতো বহুবিধ সংকট নিরসনে গণমাধ্যম কর্মীদের পেশাগত একতা দরকার। আসলে একটি পেশার অস্তিত্ব-উন্নতি-উৎকর্ষ অন্য আরেকটি পেশার লোকদের দখলে চলে যাওয়ার অর্থই ঐ পেশার সাথে জড়িতদের সম্মান-মর্যাদা অনিশ্চয়তায় পড়া।

সাংবাদিকতায় কৌশল ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান

পিআইবিতে সাংবাদিকতায় মাস্টার্সের শিক্ষার্থী হবার সুযোগে সাংবাদিকদের রুটিন বা গৎবাঁধা কাজের বাইরেও কাজের ক্ষেত্র নিয়ে ধারণা স্বচ্ছ হয়েছে। শিখেছি সাংবাদিকতায় কৌশল ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান কতটা জরুরি। সাংবাদিকতা শিক্ষা ও চর্চা একে অপরের পরিপূরক। সাংবাদিকতা না শেখানো গেলে সংবাদপত্র শিল্প যোগ্য কর্মী সঙ্কটে পড়বে। অযোগ্য-অদক্ষ কর্মী দিয়ে সাংবাদিকতা এগুবে না।

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ-পিআইবিতে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি- দেশের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার জগতের পথিকৃৎ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান স্যারকে, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও বাংলা একাডেমির সবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন স্যারকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারকে, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার এবং ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক গোলাম রহমান স্যারকে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রাবন্ধিক ও গবেষক অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান স্যারকে ।

পিআইবিতে অতিথি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম- সিনিয়র সাংবাদিক- জুলফিকার আলী মানিক ভাইকে, নজরুল ইসলাম মিঠু ভাইকে, শিশির মড়ল ভাইকে, মাহবুব মেনন ভাইকে, স্বপন কুন্ডু ভাইকে ও আরিফুল ইসলাম আরমান ভাইকে। মোঃ শাহ আলম ভাই, নূরুর রহমান বাচ্চু ভাই, রেজা সেলিম ভাইকে। বিভিন্ন সেক্টরের অভিজ্ঞদের আলোচনায়  স্পষ্ট হয়েছে- দেশে দেশে সাংবাদিকতা যেভাবে আধুনিক ও মানসম্মত হচ্ছে তাতে মেধাবীদের আগ্রহ ধরে রাখতে না পারলে  প্রায়োগিক এই ক্ষেত্রে যথাযথ কৌশলও জানাদের  স্বল্পতা দেখা দেবে এবং বিশ্ব সাংবাদিকতার দৌঁড়ে দেশের সাংবাদিকতা তাল মেলাতে পারবে না। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান না বাড়াতে পারলে আধুনিক সাংবাদিকতায় ভালো করা যাবে না।

পিআইবির শিক্ষক পংকজ কর্মকার স্যার, কামরুন নাহার ম্যাম, শুভ কর্মকার স্যার, লাজিনা আক্তার জ্যাসলিন ম্যাম ছিলেন যথেষ্ট আন্তরিক। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি কৌশলগুলো শিখিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় তাদের চেষ্টার কমতি দেখিনি। তত্ত্বীয় বিষয়গুলো শেখানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজারের জন্য উপযুক্ত মানে তৈরি করার তাদের মেহনত-পরিশ্রম ভুলার নয়। সাংবাদিকতায় আরো মানোন্নয়নের জন্য পিআইবি গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিষয়ে মাস্টার্স চালু করে; আর এই লক্ষ্য পূরণে নিরলস কাজ করছেন তারা। আমি অত্যন্ত আশাবাদী সংবাদপত্র শিল্প এর সুফল পাবে। মাস্টার্স চালুর স্বপ্নদ্রষ্টা বিশিষ্ট সাংবাদিক ও পিআইবি’র মহাপরিচালক মো. শাহ আলমগীরের মৃত্যুতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দারুণ শোকাহত হয়েছিলেন। পরে মহাপরিচালক (ডিজি) পদে বিশিষ্ট সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ স্যার আসেন। মাস্টার্সে উদ্বোধনী ক্লাস নিয়েছিলেন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি জগতের কিংবদন্তীতূল্য ব্যক্তিত্ত্ব মোস্তাফা জব্বার।

ইন হাউজ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা প্রয়োজন

আমার কাছে মনে হয়েছে- সংবাদপত্রগুলোতে ইন হাউজ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। আধুনিক সাংবাদিকতায় একাডেমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলতে আমি এটা বুঝাচ্ছি না যে সাংবাদিকতায় আসতে হলে সাংবাদিকতায়ই অনার্স-মাস্টার্স থাকতে হবে। আমি বলতে চাচ্ছি- সাংবাদিকতার ন্যূনতম জ্ঞানটা নিশ্চিত করার কথা, সাংবাদিকতার কৌশলগুলো শেখা নিশ্চিত করার কথা, তুলনামূলক বিশ্লেষণের সামর্থ্য তৈরির কথা!  ক্লাসরুমে তো ধারণা দেয়া হয় মাত্র, বিস্তারিত জানার সুযোগ সীমিত। বিস্তারিতভাবে জানার দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের নিজেরই।

বিশেষায়িত প্রোগ্রাম বাড়ানো দরকার

বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান নিয়েও শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আসতে পারে। এমবিবিএস পাস করে হেলথ বিটে, অর্থনীতির শিক্ষার্থী অর্থনীতি বিষয়ে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়ে কূটনীতিক রিপোর্টিং, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে রাজনীতি বিটে কাজ করতেই পারে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে- গণমাধ্যম শিল্পের অবস্থার উন্নতির জন্য বিশেষায়িত প্রোগ্রাম বাড়ানো দরকার। অন্যান্য সেক্টরে কাজের উপযোগী করতে মিডিয়া স্টাডিজ, মার্কেটিং কমিউনিকেশন, বিজনেস জার্নালিজম, স্ট্রাটেজিক কমিউনিকেশন, মিডিয়া অ্যাডভোকেসি, অ্যাডভার্টাইজিং নামে ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে।

 

 

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *