রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- ‘আমাদের শিক্ষাকে আমাদের বাহন করিলাম না, শিক্ষাকে আমরা বহন করিয়াই চলিলাম।’ ক্লাসে পরীক্ষার বৈতরণী পার নিয়ে কসরত আর লাইব্রেরিতেও চাকরির জন্য পড়ুয়াদের আনাগোনা!
সৃষ্টিশীল চিন্তা বা উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়ছে না, মানবিক মূল্যবোধ তৈরি হচ্ছে না, কল্যাণকর চিন্তা আসছে না, আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতা বাড়ছে, ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটছে না, নৈতিক মূল্যবোধ কমছে, পরের কল্যাণের কথা ভাবছে না।
সংস্কৃতি, রুচিবোধ, মানবতাবোধ ছাড়া শুধু বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে কী প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায়! আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, মানুষের শ্রদ্ধা-সম্মান-ভালোবাসা লাভ, মনের উদারতা ও কাজের উৎসাহ বাড়ানো। জীবনের প্রত্যাশা ও লক্ষ্য কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, নাকি সমাজকেন্দ্রিক!
মনুষ্যত্ব অর্জন ছাড়া শিক্ষিতরা সার্টিফিকেট নামধারী শিক্ষিত। অতি সহজে ডিগ্রি পাওয়া গেলেও আলোকিত মানুষ হওয়া ততটা সহজ নয়। সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য লেখাপড়া করে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা যায় না।
প্রকৃত শিক্ষিতরা মানসিকভাবে হয় পরিপক্ক, সবার সাথে ভালো ব্যবহারে পারঙ্গম এবং উন্নত ও রুচিশীল মন মানসিকতার অধিকারী; এরা যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষমতা রাখে, মানুষকে ইতিবাচকভাবে বোঝতে পারে। শিক্ষিত মানুষ বাড়লেও শিক্ষিত বিবেকের অভাবেই দুর্নীতি ও অন্যায় সর্বত্র; সার্টিফিকেটের অভাব নেই, কিন্তু মনুষ্যত্বের অভাব প্রবল।
প্রকৃত শিক্ষিতরা দেশ-সমাজ-মানবতার জন্য উপকারী, আর অপ্রকৃত শিক্ষিতরা দেশ-সমাজ-মানবতার অপকারী-ক্ষতিকর। যে শিক্ষা মূল্যবোধ জাগ্রত করে, মানুষের ভেতরের মানুষটাকে জাগায়ে তোলে তাই প্রকৃত শিক্ষা।
প্রকৃত শিক্ষিত মানে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে পাস করা নয়, এরাতো পুঁথিগত বিদ্যায় বিদ্বান। এরা দুর্বলের সাথে নির্মম আচরণ করে, অন্যের গবেষণা চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়, দলীয় কোন্দল টেনে বিভক্তির দেয়াল নির্মাণ করে, স্বার্থের জন্য পদ-পদবী-ক্ষমতাকে ব্যবহার করে।
এরা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে দ্বিধা করে না, নিয়োগ বাণিজ্য করতে লজ্জা পায় না, প্রমোশনের জন্য অনৈতিক সম্পর্ক গড়তেও ইত:স্তত করে না, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চর্চা করে না। জ্ঞান অর্জন করে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা এদের লক্ষ্য নয়; সম্পদের জন্য দুর্নীতি করে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে, লবিং করে, সিন্ডিকেট করে।
সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক শিক্ষা, নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, সার্টিফিকেট বিক্রি ও সার্টিফিকেট দেখে শিক্ষার মান বিচারের অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দেশ, জাতি ও সমাজের চেয়েও নিজেকেই যে বেশি মূল্যবান ভাবে, সে অকল্যাণই বয়ে আনে।
নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানো, দায়িত্বে ফাঁকি দেয়া অসাধু, অর্থলোলুপ কুলাঙ্গার আর কোচিং ব্যবসায়ীদের কল্যাণে ঘরে ঘরে সবাই একের পর এক পাস দিয়ে সনদধারী হচ্ছে। কিন্তু যোগ্যতার প্রশ্নে, দক্ষতার প্রশ্নে শূন্য কলসি ঠনঠন করে বাজে, বেকার বসে থাকে, মস্তিষ্কের সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ হয় না।
চাকরিনির্ভর প্রবণতা থেকে শুধুমাত্র ভালো চাকরি পাওয়া, অর্থ রোজগারের যন্ত্রে পরিণত হওয়ার ব্যস্ততা বাড়ে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা ও স্বার্থপরতা বাড়ে। মানবিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ কখনো সমাজ, দেশ ও দেশের জনগণের কথা চিন্তা করে না।
পড়াশোনার তাগিদটাই যদি হয় চাকরি ও অর্থ উপার্জন; তবে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে না, চেতনার মান উন্নত হয় না, সৃষ্টিশীল চিন্তাধারা ত্বরান্বিত হয় না, নতুন কিছু তৈরি করতে সাহায্য করে না।